ঘোড়ামারা বাজারে চায়ের দোকানে রিনটিনটিনটিন শব্দ উঠেছে। গেলাসে-গেলাসে লাল চা, দুধ চা গোলা হচ্ছে। মাঝে টিলার মতো উঁচু। তার ঢালে চায়ের দোকানের কাছে শানবাঁধানো বাবলাতলার আলোছায়া। মোসাদ্দেক সেইখানে আসর জমিয়ে বসেছে। সুপারস্টার মোসাদ্দেক, স্টোরিটেলার মোসাদ্দেক।
স্টোরিটেলার তো হবেই৷ মোহনায় এ রকম একলা দাঁড়িয়ে থাকা একটা দ্বীপ, ব্যর্থ প্রকল্পের দায়ে তিনভাগ খেয়ে যাওয়া একটা দ্বীপের বাসিন্দা এ রকম বুনো মেছুয়া আর নাবিক হলে সে স্টোরিটেলার হবে না? মোসাদ্দেক উবু হয়ে বসে একলা একশো হয়ে গল্প করছে। তার স্বরের ওঠানামা, হাহা হাসি, চোখের ভঙ্গিতে আসর থেকে ওঠা যাবে না। কারণ মোসাদ্দেক তার সব ভাঙনের গল্প বলে পাথরকোঁদা চেহারায়, হেসে হেসে। এই জমি চলে গেল। এই নৌকা বন্ধ হল। এই কেরলে চলে গেলুম। এই কেরলে গিয়ে কেমন করে আর একটা ঘোড়ামারা বানালুম। কিঞ্চিৎ জমি গ্রামে এখনও আছে, তাতে কী চাষ করলুম। এই বর্ষায় ধান কাটতে এলুম।
পরিশ্রমী মানুষের মুখ ঠিক ভাঙাচোরা হয় না, হয় ভাস্কর্য। মোসাদ্দেকের ব্যাটা বড়। বিএড করে মনখারাপ করে ঘুরে বেড়ায়। বাপ ছেলের চেয়ে উজ্জ্বল বেশি, ছেলের মতো স্কিলড নয় বলে। স্কিলড ছেলেদের সমস্যা অনেক। স্কিল হলে হবে? স্কিল হলে সভ্য হতে হবে। সভ্য মানে মাটি ছাড়তে হবে, গেরাম ছাড়তে হবে। খাবার থালা, গায়ের জামা সব পাল্টাতে হবে। চাকরি করতে হবে। শহরের দিকে ঘর করতে হবে। না হলে লোকে কী বলবে। অনেক সঙ্কট। চাপ অনেক। মোসাদ্দেকের চাপ কম, সে ‘আনস্কিলড লেবার’ বলে।
তা অবশ্য ঠিক। এমনিতে তার তো অভিমান নেই। সারা গায়ে নোনা গন্ধ। নোনাজলে চামড়া কুঁচকে গেছে। মুখে সারা ক্ষণ মিষ্টিপান। ঘোড়ামারার মাটি সোনা ছিল বটে। পান তরমুজ ধান আনাজপাতি, বীজ হাত থেকে গললে আর ভাবতে নেই, গোলা ভরে দেবে। ক্যাশ টাকার গুমোর ছিল না অত। বাপজেঠারা বলে হাতে একশো টাকা থাকলে পুলিশ চলে আসে ঘরে, এত টাকা কী করে এল?
এই ভাঙা দ্বীপে এখনও যাত্রাদল আছে। নৌকা বেয়ে যাবে। গ্রামকে গ্রাম কাঁপিয়ে আবার ফিরবে। তাদের তো ভাঙা দেওয়ালে ঘুঁটে নিয়ে সমস্যা নেই। হিন্দু মুসলিম নিয়ে সমস্যা নেই। গা-গতর নিয়ে সমস্যা নেই। আঁশগন্ধ নিয়ে সমস্যা নেই৷ বিয়ে দিতে গেলে দেখবে খেটে খেতে পারে কি না। এ সব স্কিল-ফিল চ্যাংড়া কথা, লঘু কথা। গা-গতরই স্কিল। শব্দটা আজকাল চলছে। মোসাদ্দেকরা জানত না, শুনে শেখা। এই সব স্কিল-ফিল।
নাবিক মোসাদ্দেক, মেছুয়া, জেলে মোসাদ্দেক, দুরন্ত কৃষক মোসাদ্দেক, মজুর খাটা মোসাদ্দেক, নিজের ঘর নিজে বানিয়ে সারিয়ে নিতে পারা মোসাদ্দেক, তার স্কিল কে বিচার করবে? কত বড় ব্যাটা আছে বাপের? কোন সিলেবাস আছে? সিলেবাসটা বানানোর বুকের পাটা কার আছে?
এক কিলোমিটার রাস্তা ধানের বোঝা মাথায় নিয়ে আঙুলে ভর দিয়ে মাড়ার পর মাড়া, রাস্তার পর রাস্তা, ঢালের পর ঢাল পার হয়ে যে কৃষক গোলার দিকে আসছে, ভরা ধানগাছের শিষে দোলা লেগে নির্ভুল ছন্দে শব্দ উঠেছে ঝম-ঝম-ঝম। আরে ব্যাটা তোর কোন ইউনিভার্সিটি কোন স্কিল সার্টিফিকেট দেবে রে? তোর স্কিল জানে ভেজা মাঠে ডালের বীজ ছড়ায় কী করে? ধান কী করে কাটে?
মোসাদ্দেকের সার্টিফিকেট নেই। লালচে গরানকাঠে নিজের নৌকা নিজে বানিয়ে নিতে পারা প্রণবেরও নেই। কোনও স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ই পারেনি এদের স্কিল সার্টিফিকেট দিতে।
আসলে বল, গোষ্ঠী ভাঙতে চাইছিলি। আসলে বল, দিনপ্রতি মজুরির হিসাবে গোটা গুষ্টিকে ঢুকিয়ে না ফেলতে পারলে তোদের লেবার-এর প্রয়োজন মিটছিল না। গেরামের পর গেরাম না ভাঙলে এত লেবার আসবে কোত্থেকে?
লেবার মানে শুধু লেবার। সংখ্যা। মোসাদ্দেক না, প্রণব না, আসমান না, রেবতী না, মিনতি না। সংখ্যা। দায়হীন সংখ্যা। ঠিকেয় ধরা গতর। এসেছে তোদের প্রাসাদ নির্মাণে, এলাচ বাগানে, এখানে ওখানে। পেমেন্ট দিবি কম। আনস্কিলড লেবার বলে। সার্টিফিকেট নেই। মরে গেলে টাকা দিবি না। দায়িত্ব শেষ। স্কিলড মানে একটা ‘বেসিক পে’, ‘পে-স্লিপ’। গোটা দুনিয়াটাকেই মধ্যবিত্ত করে দিবি, ভয় ঢুকিয়ে দিবি অসুখের মতো। মোসাদ্দেকের ব্যাটাকে তোরা সেই ভয়ে পেয়ে গেছিস।
মোসাদ্দেকদের ভয় নেই। ওরা বুনো। ওদের গতর পাবি। আর কিছু পাবি না। গরিব লোকের আবার ডায়াস্পোরা হয়? হয়, একটু সময় দে। ওই যে গতর পেয়েছিস, ভাবছিস সংখ্যা, তোরা জানিস না ওরা সব একটু মাটির জন্য খাটছে। টাকা হলেই মাটি ধরবে। আবার সেই গেরাম। আবার সেই ধান পান কলাই আনাজ শাক কালিমুগ ডাল। আবার একটা নৌকা করে এ দিক-ও দিক। এ সব তোরা বুঝবি না। বড় যন্ত্র না। রাষ্ট্রযন্ত্র। বড় যন্ত্র কোনায় কোনায় যেতে পারে না। বেধে যায়।
মোসাদ্দেকরা বুনো, ওরা ঠিক বুঝে নেয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)