পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর প্রক্রিয়ার প্রথম তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত। রাজনৈতিক স্তরে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হচ্ছে, কিন্তু মতুয়া গোসাঁইদের একাংশের ১৩ দিনের অনশন বাদে এসআইআর-বিরোধী গণ-প্রতিরোধ দানা বাঁধেনি। দেখা যাচ্ছে, মঞ্চ বেঁধে, শিবির করে, সামাজিক পরিচয়ের রাষ্ট্রীয়করণের পথ মসৃণ করাই বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ডান-বাম নির্বিশেষে পাড়া-রাজনীতির প্রধান উপজীব্য। এবং, এসআইআর নিয়ে যত প্রশ্ন এবং আপত্তি বঙ্গীয় রাজনীতিতে উঠছে, তা মূলত প্রায়োগিক— অর্থাৎ, এত দ্রুত গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ করতে চাইলে তাতে ভ্রান্তির সম্ভাবনা, সামাজিক ও প্রশাসনিক চাপ ইত্যাদি। এসআইআর নিয়ে কোনও বনিয়াদি বা মৌলিক আপত্তি এখনও অবধি তেমন ওঠেনি। অথচ, সে আপত্তির কারণ আছে।
পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তু সমাজের সব গোষ্ঠীর অভিবাসনের সময় এবং অভিজ্ঞতা অভিন্ন নয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ প্রধানত শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত এবং তথাকথিত উঁচু জাতের ভদ্রলোক উদ্বাস্তুরা এ-পারে চলে আসেন, এবং রাষ্ট্রীয় পরিচয় কাঠামোর মধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৪৯ সালের পরে পূর্ব পাকিস্তানে একাধিক কমিউনিস্ট-বিরোধী পুলিশি অভিযান, বর্বরতা এবং দাঙ্গার ফলে আদিবাসী এবং নমশূদ্র সমাজের মানুষ ভারতে পালিয়ে আসতে শুরু করেন। বর্তমানে, দেশভাগের ইতিহাসের নতুন ধারার চর্চায় নমশূদ্র উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে লেখালিখি হলেও, সাঁওতাল, শবর, চাকমা, বেদে এবং ওরাওঁ জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু অভিজ্ঞতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরে অচেনা। তাঁদের বিস্থাপনের প্রক্রিয়া চলেছে ১৯৪৯ থেকে ২০০১ অবধি। একাধিক দাঙ্গায়, রাজনৈতিক হিংসায় এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের সিংহভাগ দেশ ছাড়েন। ১৯৫০ সালের পর থেকেই ভারতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কেন্দ্রীয় স্তরে সঙ্কুচিত হতে শুরু করেছিল। ১৯৭১ সালের পরে রাষ্ট্রীয় স্তরে এই অভিবাসনের আর কোনও হিসাব বা দলিল রাখা হয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই জাতি রাষ্ট্রের মূলস্রোতের প্রান্তে বাঁধা-পড়া এই মানুষদের কাগুজে-ঘাটতি আছে বিলক্ষণ। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তুরা সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং জাতি রাষ্ট্রের স্থানিক সীমান্তের প্রতিচ্ছেদে বসবাস করেন। সেই সীমান্তের ক্ষমতা কাঠামো নিয়ত বদলায়, পাল্টে যায় অভিবাসন সংক্রান্ত অলিখিত নীতি। সেই পরিবর্তনের সঙ্গে দর কষাকষি এই মানুষদের প্রাত্যহিকতার অঙ্গ। রাষ্ট্রীয় সন্দেহের চাপ সামলানোর অভিজ্ঞতা তাঁদের কাছে মধুর নয়, তবে নতুনও নয়।
পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী তালিকার ব্যাপক সংশোধন এবং কাটছাঁট দাবি করার ইতিহাস লম্বা। ১৯৪৯ সালে নাচোলের আদিবাসী-বিরোধী দাঙ্গার পরে মালদহ অঞ্চলে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়েছিল অনেকটাই। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় এই অঞ্চলে অভিবাসন আরও বেড়ে যায়। উদ্বাস্তু জনতার সংগঠন পুনর্বাসনের জন্য জমি দাবি করে, যা মালদহের তৎকালীন সম্পন্ন কৃষক সমাজের কাছে ছিল একান্ত অপ্রীতিকর। মধ্যবাংলার সম্পন্ন কৃষকদের প্রতিনিধি, মালদহের অবিসংবাদী কংগ্রেস নেতা গনি খান চৌধুরী ১৯৭৯ সালে নির্বাচনী তালিকায় ব্যাপক সংশোধনের দাবি তুললেন। তাঁর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে নেমেছিল কিছু ছোট রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সংগঠনের একটা জোটবদ্ধ মঞ্চ। সে আন্দোলন জোটবদ্ধ হলেও বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি। এর পরে বঙ্গে অভিবাসন-বিরোধী, রাষ্ট্রীয় সন্দেহের রাজনীতি আরও পরিপক্ব হয় ১৯৯০-এর দশকে নির্বাচনী পরিচয়পত্রের আন্দোলনের মাধ্যমে, এবং ২০০১ সালে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংঘাতের পরে তৈরি হওয়া অভিবাসন-সংক্রান্ত আতঙ্কের আবহাওয়ায়। ২০০৩ সালে যখন নতুন নাগরিকত্ব আইন সংসদে গৃহীত হয়, তখন ডান-বাম নির্বিশেষে সবাই সে আইন সমর্থন করেছিল। ‘বেআইনি অভিবাসী’ শব্দের উপরে সেই সময় সিলমোহর পড়েছিল সব রাজনৈতিক দলের তরফেই।
২০০২ থেকে ২০১০-এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় পূর্ণ এবং আংশিক সংশোধন হয়েছে বহু বার, এবং প্রতি বারই বাদ পড়েছে অসংখ্য নাম। বলাগড়, ফরাক্কা, গোমস্তাপাড়া ইত্যাদি দলিত উদ্বাস্তু অধ্যুষিত অঞ্চলে, বহু মানুষের মনে আজও জেগে আছে ‘নাম কাটা যাওয়া’র ভয়, এবং তার পরের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার ভোগান্তি। তবে উদ্বাস্তু অঞ্চলের বর্তমান রাজনীতির ধারা বইছে তাঁদের স্মৃতির বিপরীতে। একটি অসমাপ্ত ক্ষেত্র সমীক্ষার অংশ হিসাবে বিভিন্ন অঞ্চলে ভোটার তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়া রূপায়ণের অভিজ্ঞতা আলোচনা করতে গিয়ে জানলাম যে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং উদ্বাস্তু বসতি এলাকায়, মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাগজপত্র নিজেদের ফর্মের পাশাপাশি তৈরি করে রাখছেন। অনেকেই নিত্যনতুন কাগজের স্ক্যান পাঠিয়ে জানতে চাইছেন, সেটা কাজে লাগবে কি না; ১৯৫২ সাল থেকে সমস্ত ভোটার তালিকা ছেপে তাতে তিন পুরুষের নামের পাশে টিক চিহ্ন দিয়ে বিএলও-র অপেক্ষা করছেন।
২০১৯ সালে এক কবি বলেছিলেন, ‘হম কাগজ় নহি দিখায়েঙ্গে’। পাঁচটা বসন্ত ঘুরতেই দেখা গেল যে, প্রান্তিক এবং উদ্বাস্তু সমাজের মানুষ কাগজ বরং দেখাতেই চান— একটা পাকাপোক্ত সমাধানের আশায়। স্থানীয় সমাজ, রাজনীতি এবং রাষ্ট্রের সন্দেহের মোকাবিলা করতে গিয়ে উদ্বাস্তু এবং প্রান্তিক পরিযায়ী জনতা কাগজপত্র তৈরি রাখার কাজে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছে। এই দক্ষতার একটা ঐতিহাসিক উদাহরণ অসমের মাজুলি। অসমিয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ভাষ্যে মাজুলি দ্বীপ ছিল সন্দেহভাজন মানুষদের এলাকা, অনাগরিক, অভিবাসীদের বস্তি। অথচ ২০১৯ সালে যখন নাগরিকপঞ্জির চূড়ান্ত তালিকা বেরোল, দেখা গেল সেখানে নাম বাদ পড়েছে সামান্যই। বাংলার উদ্বাস্তু সমাজের সংখ্যাগুরু অংশ হয়তো আজ নিজেদের এই দক্ষতার ভরসায় ফের রাষ্ট্রীয় পরিচয় কাঠামোর সঙ্গে আলাপ জমাতেই ব্যস্ত। এই প্রক্রিয়ার বিরোধিতা তাঁদের কাছে অনভিপ্রেত।
২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল মতুয়া উদ্বাস্তুদের নেতৃত্বে। সেই অনশন আন্দোলনে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একাধিক গোসাঁই পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর ঘোষণার পরে ফের অনশনে বসলেন। তাঁদের দাবি ছিল নতুন এবং সরলীকৃত এমন একটি আইন, যেখানে বাংলাদেশের কাগজপত্র, ধর্মীয় প্রমাণপত্র ইত্যাদি শর্ত ছাড়াই তাঁদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত এবং নিরাপদ করা হবে। এসআইআর সম্বন্ধে তাঁদের দাবি নাগরিকত্বের তুলনায় গৌণ বা আনুষঙ্গিক। ভোটাধিকার নিশ্চিত করা আন্দোলনকারীদের কাছে পূর্ণ, নিঃশর্ত নাগরিকত্বের অঙ্গ। প্রতীকী সংগ্রামের জমানায় দলিত উদ্বাস্তু সংগ্রাম ব্যতিক্রমী। দর কষাকষির রাজনীতির থেকে আলাদা পথের খোঁজ করছেন এই আন্দোলনের নেতৃত্ব। তাঁদের কাছে আইনসিদ্ধ, আনুষ্ঠানিক, পূর্ণ নাগরিকত্বের দাবি বনিয়াদি এবং নৈতিক। তাঁরা বিশেষ দেশের বা বিশেষ ধর্মের উদ্বাস্তু হিসাবে নিজেদের পরিচয় প্রমাণ করতে অনাগ্রহী। তাঁদের কাছে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় জাতীয় সমাজে তাঁদের পূর্ণ অন্তর্ভুক্তি। এই দাবি একই সঙ্গে যেমন তাঁদের বিশেষ সামাজিক অবস্থানের গুরুত্ব দর্শায়, তেমনই তাঁদের একান্ত আপন, তাঁদের নিজেদের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সমাজের থেকে আলাদাও করে রাখে। ঠাকুরনগরে এই অনশন আন্দোলনের সমান্তরালে চলছিল হিন্দু সার্টিফিকেট বিলি করার কাজ। অনশন আন্দোলনের ছোট পরিসরের বাইরে বৃহৎ কর্মযজ্ঞে দিনে প্রায় তিন হাজার সার্টিফিকেট বিলি হয়ে চলেছে। নমশূদ্র এবং দলিত উদ্বাস্তু সমাজের অন্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগুরু অংশ বেশি আগ্রহী সেই ‘হিন্দু কার্ড’ সংগ্রহ করতে।
এই মনোভাবের দুটো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বঙ্গের রাজনীতিকে রূপান্তরিত করতে পারে। প্রথমত, এই প্রক্রিয়া যদি নির্বিরোধে সম্পন্ন হয়, তা হলে বাঙালি উদ্বাস্তু সমাজ, ‘প্রকৃত উদ্বাস্তু’ এবং ‘বেআইনি অভিবাসী’ এই দু’ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এবং তার ফলে ২০০১ সালের পরে আসা দলিত এবং আদিবাসী উদ্বাস্তু পরিবারগুলির কাছে সিএএ-তে আবেদন করা ছাড়া বিকল্প থাকবে না। দ্বিতীয়ত, এসআইআর প্রক্রিয়াতে সফল হওয়া সংখ্যাগুরু উদ্বাস্তু সমাজের মানুষের কাছে সিএএ এবং নাগরিকপঞ্জির মতো প্রক্রিয়া সামাজিক স্তরে বৈধ এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। আগামী দু’মাসের ঘটনাক্রম বলবে, বাংলা কোন পথে হাঁটবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)