E-Paper

বোতল-দৈত্য বেরিয়ে গেলে

প্রথম সমন্বয়বাদী ধারণাটি হালফিল ‘সেকুলারপন্থী’ বা ‘নেহরুবাদী’ বলে পরিচিত হলে, দ্বিতীয় একত্ববাদী ভাষ্যটি বহুত্ব/বৈচিত্রসঞ্জাত ঐক্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ।

শিবাজীপ্রতিম বসু

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৫ ০৮:৩৩
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য, না কি একত্বের মধ্যে বৈচিত্র? শব্দের খেলা বা ধাঁধার মতো লাগলেও এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে ভারতীয় ‘যুক্তরাষ্ট্র’ বিষয়ে দু’টি বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথমটা ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে, সরকারি বিজ্ঞাপনে, পদ্যে-গদ্যে-ছবিতে দেখেছি। বাঙালিমাত্রেই অতুলপ্রসাদ সেনের গানে সাংস্কৃতিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তার প্রথম পাঠ নিয়েছে: “নানা ভাষা, নানা মত নানা পরিধান,/ বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান…।” কবির আশা, বহুত্ব/বৈচিত্রের মধ্যে এই ঐক্য গড়ে উঠলেই ভারতে এক ‘মহাজাতি’র উত্থান হবে, তা দেখে ‘জগজন মানিবে বিস্ময়’।

বহুত্ব নিয়েও, দ্বন্দ্ব-দ্বৈরথ সত্ত্বেও, স্মরণাতীত কাল থেকে সহাবস্থানের ঐতিহ্য, বিশেষত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ভাষা-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই, অনেকের মতে, ভারতে এই ‘মহাজাতি’ গঠনের ভিত্তি। এই ছবিটিই বিরাট অংশের মানুষের কাছে ‘ভারত-ভাবনা’র মর্মার্থ হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’ কবিতার এটাই মূল ভাব। এই ভাবনারই একটি লঘু টেলিভিশন-ভাষ্য বহু প্রজন্ম পরে (১৯৮৮) জনপ্রিয় হয়েছিল— ভীমসেন জোশির গাওয়া ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’ গানের শেষে, সারা দেশের বৈচিত্রময় পরিক্রমা সেরে, তখনকার তিন সুপারস্টার, অমিতাভ-জিতেন্দ্র-মিঠুন হাসি-হাসি মুখে সুর মিলিয়েছিলেন।

কিন্তু যদি ‘বহুত্ব থেকে এক হয়ে ওঠা’র আখ্যানটাই উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিই? যদি ভাবি, একত্ব/ঐক্য আগে থেকেই ছিল, তার মধ্যেই বহুত্ব/বৈচিত্রর উদ্ভব হয়েছে? অনেকটা ঈশ্বরের ‘একোহং বহুস্যাম’— ‘আমি এক, বহু হব’-র মতো? ভারত দেশ ও সমাজ হিসাবে গোড়াতে একই ছিল, পরে নানা বৈচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে। জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এমন ব্যাখ্যা স্বাধীনতার আগে ও পরে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের তথা দীর্ঘ দিন পর্যন্ত ভারত সরকারের (‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’) ভাষ্যকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে। প্রথম সমন্বয়বাদী ধারণাটি হালফিল ‘সেকুলারপন্থী’ বা ‘নেহরুবাদী’ বলে পরিচিত হলে, দ্বিতীয় একত্ববাদী ভাষ্যটি বহুত্ব/বৈচিত্রসঞ্জাত ঐক্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ। দেড় দশক আগেও ভারতীয় জনতা পার্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা, লালকৃষ্ণ আডবাণী, যিনি নেহরুপন্থী তথা বাম-উদারবাদীদের ‘ছদ্ম সেকুলারপন্থী’ আখ্যা দিয়েছিলেন, ভারতে ঐক্য ও বহুত্বের সম্পর্কের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ভারতকে ‘বৈচিত্রের সমন্বয়’ হিসাবে না দেখে যদি ‘ঐক্য/একত্বের মধ্যে বৈচিত্র’ রূপে দেখি, তবে সমস্যা থাকে না। এটাই বিজেপি তথা তার প্রাণকেন্দ্র রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)-এর দৃষ্টিভঙ্গি। যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র ও রাজ্যসমূহের মধ্যে নিছক সাংবিধানিক ক্ষমতা-বিতরণের ব্যবস্থা হিসাবে দেখলে একত্ববাদী-দের সমস্যা থাকে না। গোল বাধে যখন রাজ্যগুলির মধ্যে ‘সাংস্কৃতিক বহুত্বের’ উপাদানও যুক্ত হয়।

১৯৫০ সালে চালু হওয়া সংবিধানেও এই সমস্যা ছিল না। সংবিধানের এক নম্বর ধারা ‘যুক্তরাষ্ট্র’ না বলে ভারতকে কেবল ‘রাজ্যসমূহের সঙ্ঘ/ইউনিয়ন’ আখ্যা দিয়ে, পরে এই সঙ্ঘ (বা ‘কেন্দ্র’) ও রাজ্যগুলির মধ্যে ক্ষমতার তিনটি তালিকা প্রকাশ করেছিল (সপ্তম তফসিল)। এই ঘোরতর কেন্দ্রমুখী সংবিধানকে শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ কে সি হুইয়ার ‘আধা-যুক্তরাষ্ট্র’ তকমা দিয়েছিলেন। ক্ষমতা-বিন্যাসের এমন অসম দলিলটির সামনে প্রায় ‘মডেল’ হিসাবে হাজির ছিল ঔপনিবেশিক ‘ভারত শাসন আইন’ (১৯৩৫)। তারও আগে ১৯১৯ সালের ‘ভারত শাসন আইন’-ই প্রথম বার সীমিত অর্থে, কেন্দ্র ও ‘প্রদেশ’গুলির মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ করেছিল।

সাংস্কৃতিক-বৈচিত্রে বিরোধীদের সমস্যা দেখা দিল, যখন ব্রিটিশ আমলের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি থেকে তেলুগু-ভাষীদের পৃথক রাজ্যের দাবিতে টানা ৫৮ দিনের অনশনে পট্টি শ্রীরামুলু প্রাণ বিসর্জন (১৯৫২) করলে তড়িঘড়ি পৃথক তেলুগু-ভাষী অন্ধ্রপ্রদেশ এবং ‘রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন’ গঠন করা হয়। কমিশনের সুপারিশে প্রথম ভাষাভিত্তিক ‘রাজ্য পুনর্গঠন আইন’ (১৯৫৬) প্রণীত হলে, ভারত জুড়ে, বিশেষত মাদ্রাজ বা বম্বে প্রেসিডেন্সির মতো বহুভাষাভাষী অঞ্চলে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনের দাবিতে রাজনীতি সরগরম হয়ে ওঠে। এই ভাবে, সংবিধানে বলা না-থাকলেও, সাংস্কৃতিক-বৈচিত্রের প্রধান উপাদান, ‘ভাষা’ হয়ে দাঁড়াল ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে রাজ্য পুনর্গঠনের অন্যতম ভিত্তি। কিন্তু ভাষাগত আত্মপরিচিতি যদি অন্য ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে বিবাদ/সংঘর্ষে লিপ্ত হয় তবে তো জাতীয় সংহতির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়বে। কিছু ভাষাকে আবার (যেমন উর্দু) নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা শুরু হল, হিন্দিকে ‘উত্তর ভারত’-এর ভাষা হিসাবে, যার বিরুদ্ধে তামিলভাষীরা আন্দোলনে অনমনীয় হয়ে উঠলেন। এই প্রেক্ষাপটে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যবিধানের প্রয়োজনীয়তা পুনরায় স্মরণ করাতে নেহরু ‘জাতীয় সংহতি পরিষদ’ (১৯৬১) গঠন করলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা আহূত হলেন। আরএসএস-এর তৎকালীন প্রধান (সরসঙ্ঘচালক), মাধব সদাশিব গোলওয়ালকরও, যিনি ‘গুরুজি’ নামেই জনপ্রিয়।

ভারতীয় জাতীয়তার চূড়ান্ত একত্ববাদী প্রবক্তা গোলওয়ালকর ছিলেন সাংস্কৃতিক-বহুত্বের প্রতীক হিসাবে ‘যুক্তরাষ্ট্র’-এর ধারণার উপরেই হাড়ে-চটা। কারণ, তা ভারতীয় জাতির (যা, তার মতে, ‘হিন্দুসত্তা’-নির্ভর) অখণ্ডতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়। ক্ষোভ উগরে পরিষদের প্রথম অধিবেশনের আগে তিনি লিখলেন— “আজকের যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ব্যবস্থা কেবল বিচ্ছিন্নতাবাদের অনুভূতির জন্মই দেয় না বরং তা পুষ্টও করে।… এর প্রকৃতি বিভাজনমূলক। এটিকে সম্পূর্ণ রূপে উপড়ে ফেলতে হবে, সংবিধানকে সংশোধন করে শুদ্ধ করতে হবে, যাতে এককেন্দ্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা যায়।” তিনি চেয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রীয় বিষয়ক আলোচনা বন্ধ করে, সব ‘স্বায়ত্তশাসিত’ বা আধা-স্বায়ত্তশাসিত ‘রাজ্য’-এর অস্তিত্ব বিলোপ করে এক দেশ, এক রাজ্য, এক আইনসভা তথা এক প্রধান/‘নির্বাহী’-র (‘এগজ়িকিউটিভ’ অর্থে) নিযুক্তি। ১৯৬০-এর দশকের গোড়ায় যখন গোলওয়ালকর একত্ববাদী জাতিরাষ্ট্রের এই ঘোষণাপত্র জারি করছিলেন, তখন দেশের কোথাও সঙ্ঘ পরিবারের রাজনৈতিক সংগঠন, ভারতীয় জনসঙ্ঘের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দৃশ্যমান ছিল না। ফলে, খোলা মনে ভাবপ্রকাশের বেলায় আগুপিছু ভাবতে হত না।

পরবর্তী সাড়ে পাঁচ দশকে অবশ্য গঙ্গাদি পুণ্যতোয়া দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। সে দিন যা অসম্ভব মনে হত, ৯০ দশকের শেষ দিকে বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গড়লে তা প্রথম বার ‘সাকার’ হল; ২০১৪ থেকে এ-তাবৎ যা সবচেয়ে বড় ‘রাজনৈতিক বাস্তব’। ভারতীয় রাজনীতির সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার বিজেপির যাত্রাপথটি জাতীয় কংগ্রেসের সম্পূর্ণ বিপরীত। স্বাধীনতার পর প্রথম দু’দশক কংগ্রেসের দাপট কেন্দ্র ও রাজ্যে এমন সর্বময় ছিল যে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারি ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ‘কংগ্রেস ব্যবস্থা’ বলেছিলেন। এই অত্যুচ্চ স্থান থেকে নামতে নামতে বর্তমানে এই প্রাচীন দলটির পক্ষে নানা দলের সঙ্গে জোট না গড়ে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসা অসম্ভব।

বিপরীতে, বিজেপি (জনসঙ্ঘের উত্তরসূরি) ক্ষুদ্র থেকে নানা ছোট-বড় দলের সঙ্গে জোট/বোঝাপড়া করতে করতে এই বৃহদায়তনে পৌঁছেছে। এই দলগুলির বেশির ভাগই আঞ্চলিক— ভাষা, জাতপাত এমনকি, সম্প্রদায়নির্ভর। অনেকেই রাজ্যের হাতে ‘অধিক ক্ষমতা’র দাবিদার। গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদীও অনেক সময় তা-ই চেয়েছেন। এই ‘নতুন পরিস্থিতি’তে সঙ্ঘেরও প্রয়োজন হল ‘যুক্তরাষ্ট্র’ বা মুসলিম/খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ‘গুরুজি’র বলা, বাঞ্চ অব থটস-এ সঙ্কলিত চরম অভিমতগুলির কিছুটা সংশোধন। বর্তমান সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত খানিকটা সেই চেষ্টা করেছেন। ২০১৮ সালে জানিয়েছিলেন, বাঞ্চ অব থটস-এ প্রকাশিত বেশ কিছু অভিমত প্রেক্ষাপট-নির্দিষ্ট, চিরকালীন নয়। গত জুলাই মাসে দিল্লিতে মুসলিম বুদ্ধিজীবী ও ইমামদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি ভারতে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সংহতি ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার উপরে জোর দেন, কেননা ‘উভয়েরই ডিএনএ এক’। এর আগে, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মনে ভয় জাগাতে হিংসাত্মক কার্যকলাপকে ‘গুন্ডামি’ আখ্যাও দিয়েছিলেন।

আরএসএস-এর শতবর্ষে, ভাগবতের এ সব বক্তব্য কি নিছক কথার কথা, না কি মনের? প্রবল সন্দেহ জাগে, রাজ্যগুলির যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্রমবর্ধমান তাচ্ছিল্য ও নীরবতা দেখে। মণিপুর-সহ নানা প্রান্তে সম্প্রদায়গত হিংসায় দেশের সংহতি সঙ্কটজনক হলেও এই আমলে এক বারও জাতীয় সংহতি পরিষদ-এর মিটিং ডাকা হয়নি। কোনও নির্দিষ্ট ভাষা/ধর্মকে মিশিয়ে ‘বিদেশি চিহ্নিত করে’ আইনি ও সামাজিক হুমকিতে কী ভাবে আক্রান্তের মনে ভয় জাগানো হয়, বাঙালি সংখ্যালঘু পরিযায়ী শ্রমিকরা সম্প্রতি ভালই টের পেয়েছেন! মুখে যা-ই বলুন, ভাগবত জানেন, বোতল থেকে বেরোনো দৈত্যকে ফের বোতলে পোরা অসম্ভব।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BJP Mohan Bhagwat RSS

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy