আজকাল সংরক্ষণ নিয়ে নানা বিতর্ক থেকে অনেক বিষয় উঠে আসে। বলা হয়, তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি ছাত্রছাত্রীরা সংরক্ষণের মাধ্যমে চিরকাল সুবিধা পেয়ে এসেছেন। অল্প নম্বর পেয়ে কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। জয়েন্ট বা নিট পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হন। সংরক্ষণ প্রথা নাকি মেধাকে নষ্ট করছে।
ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায় যে, এক জন সংরক্ষণের সুযোগে ১০০-তে ৭০ পেয়ে উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছেন, আর এক জন সংরক্ষণের বাইরে থাকা ১০০-তে ৯০ পেয়ে ভাল প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পান না। এটাও শোনা যায়, ‘আমরা অধিক খাটনি দিয়েও আমাদের প্রাপ্য পাচ্ছি না, কিন্তু সংরক্ষণ থাকার কারণে কম খাটনি দিয়ে প্রয়োজনের তুলনায় অধিক পেয়ে যাচ্ছে।’ অ-সংরক্ষিত ছাত্রছাত্রীরা সংরক্ষণ ব্যবস্থার জন্য বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁদের মতে, পড়াশোনা বা চাকরিতে সংরক্ষণ থাকা উচিত নয়, তার পরিবর্তে তাঁদের আর্থিক দিক দিয়ে সাহায্য করা হোক। অঙ্কের হিসাবেও গরমিল করে দেখানো হয়, যাঁদের সংরক্ষণ আছে, তাঁরা সংরক্ষিত আসন পাওয়ার পরেও অ-সংরক্ষিত আসনেও ভাগ বসাচ্ছেন। তাঁদের জন্যই নাকি ১০০ শতাংশ আসন, সাধারণ ছাত্রছাত্রীর জন্য কিছুই নেই। ফলে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা হতাশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এমনই এক মনোভাব আজকের দিনে অনেকের কাছে তৈরি হয়েছে সংরক্ষণ বিষয়ে।
কেন্দ্র ও পশ্চিমবঙ্গ সরকার সংরক্ষণ বজায় রেখে, সাধারণ জাতির কিছু অংশকে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে এসেছে। ভারতে ২০১৯ সালে ১০৩তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে ১০ শতাংশ ইডব্লিউএস সংরক্ষণ দেওয়া হয়। সংরক্ষণের আওতায় আসার জন্য বেশ কিছু মানদণ্ড রাখা হয়েছিল, বার্ষিক আয় ৮ লক্ষের বেশি হলে হবে না, কৃষিজমির পরিমাণ ৫ একরের নীচে হবে, বাসভূমির পরিমাণ ১০০০ স্কোয়্যার ফুটের বেশি না হয়, তার সঙ্গে আরও কয়েকটি শর্ত পালনের কথা বলা হয়েছে। এই সংরক্ষণ সরকারি চাকরি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যকর করা হয়। যাঁরা ইতিমধ্যেই তফসিলি জাতি, জনজাতি অথবা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি সংরক্ষণের আওতাভুক্ত আছেন, তাঁরা এই সংরক্ষণের মধ্যে আসতে পারবেন না। ২০২২ সালের নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট এই সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা বহাল রাখে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও মোটামুটি কেন্দ্রের মতো শর্তে ১০ শতাংশ ইডব্লিউএস সংরক্ষণ দেওয়া শুরু করে। তার আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসির সংরক্ষণকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছিল, বর্তমানে তার মধ্যে কিছু সংশোধন করে কিছু জাতি এবং সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ফলে অনেক জাতি বা সম্প্রদায়ের সুবিধাও হয়েছে চাকরি বা ভর্তির ক্ষেত্রে।
হিসাবটা মোটামুটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, আর্থিক অসুবিধার জন্য যাঁরা পিছিয়ে পড়েছেন তাঁরাও সংরক্ষণের আওতায় এসেছেন। কিন্তু আলোচনাতে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসিদের ক্ষেত্রে মেধা নিয়ে কথা উঠলেও, ইডব্লিউএস সংরক্ষণের বিষয়টা আসে না। তাই সাধারণ জাতির অনেকে সংরক্ষণের সুযোগ পেলেও, গালাগালি খাওয়ার পাত্র হয় সেই তফসিলি জাতি এবং জনজাতিভুক্তরা।
সম্প্রতি বেশ কিছু পরীক্ষায় ইডব্লিউএস কাট-অফ মার্কস তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসিদের থেকে কম এসেছে, এই নিয়ে কিন্তু তথাকথিত সংরক্ষণবিরোধী শিবির চুপ আছে। অন্য দিকে, জনজাতিভুক্তদের ক্ষেত্রে পরীক্ষার কাট-অফ মার্কস কম হলে অনেকে সমাজমাধ্যমে ‘হা-হা’ প্রতিক্রিয়া দিতে ছাড়ে না, সঙ্গে নানা কুকথাও বলে থাকে।
এমনই এক ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমবঙ্গের স্কুল সার্ভিস কমিশনের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়। সেখানে তিনটি বিষয়ে প্রাপ্য নম্বরের ভিত্তিতে মেধা তালিকা প্রকাশ করে ইন্টারভিউ-এর পূর্বে নথিপত্র যাচাইয়ের জন্য ডাকা হয়েছে, আশা করা যায় এঁরা সকলেই ইন্টারভিউ-এর জন্য ডাক পাবেন। পরীক্ষায় লিখিত পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ ছিল ৬০ নম্বর, শিক্ষাগত যোগ্যতা বাবদ ১০ নম্বর এবং পূর্বে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার জন্য ১০ নম্বর। পরীক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁদের পূর্বে স্কুলে পড়ানোর অভিজ্ঞতা আছে, তাঁদের মেধা তালিকা প্রকাশিত হয়েছে ৮০ নম্বরের ভিত্তিতে। যাঁদের এই অভিজ্ঞতা নেই, তাঁদের ৭০ নম্বরের ভিত্তিতে। এখানে যাঁদের স্কুলে পড়ানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে এবং লিখিত পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছেন, তাঁদের সুযোগ বেশি নথিপত্র যাচাইয়ে ডাক পাওয়ার ক্ষেত্রে, এটাই স্বাভাবিক।
সেই হিসাবে মেধা তালিকা দেখলে বোঝা গেল, বেশির ভাগ পূর্বে চাকরি করা লোকজন ডাক পেয়েছেন, কিছু সংখ্যক অনভিজ্ঞও আছেন তাঁদের মধ্যে। প্রশ্নটা এখানে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা নিয়ে নয়, সংরক্ষণ নিয়ে। এ বারে ইডব্লিউএস সংরক্ষণ পাওয়া অনেকে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং ওবিসিদের থেকেও কম নম্বর পেয়ে নথিপত্র যাচাইয়ে ডাক পেয়েছেন, পরে চাকরিও পাবেন। এই নিয়ে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসিদের মধ্যে হতাশা তৈরি হলেও, ইডব্লিউএস সংরক্ষণ বিরোধী উক্তি তেমন শুনতে পাওয়া যায়নি।
প্রশ্ন হচ্ছে ইডব্লিউএস সংরক্ষণ পান কারা? নিশ্চয়ই তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসিদের মধ্যে কেউ নন— বাকি বামুন, বৈদ্য, কায়েত-সহ আরও কিছু উচ্চবর্ণের লোকজন। এই সংরক্ষণে উচ্চবর্ণের লোকজন আছেন, তার প্রমাণ স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রকাশিত মেধা তালিকাতেই পাওয়া যাবে। বর্ণহিন্দু পদবির অনেক নাম খুঁজে পাওয়া যাবে। এঁরাই দীর্ঘ কাল ধরে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে কথা বলে এসেছেন। যাঁরা মেধা নিয়ে বড় বড় কথা বলে এসেছেন, আজকে তাঁরা কিন্তু চুপ। ভদ্রলোক সমাজের অনেকে সায়েন্স বিষয়ে কম নম্বর পাওয়া জনজাতিভুক্তদের নিয়ে সমালোচনা করেছেন সমাজমাধ্যমে, কিন্তু ইডব্লিউএস সংরক্ষণ পাওয়া ওই উচ্চবর্ণের লোকজনদের নিয়ে চুপ আছেন। অন্য অনেক বিষয়ে তফসিলি জাতি, জনজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসিদের ছেলেমেয়েরা ইডব্লিউএসদের থেকে বেশি নম্বর পেয়েও ডাক পাননি, সেই বিষয়ে সহানুভূতির পর্বও চলছে সমাজমাধ্যমে। এই সব চর্চায় স্কুল সার্ভিস কমিশনকে দোষারোপ করলেও, ইডব্লিউএস সংরক্ষণ পাওয়া লোকজনের সমালোচনা কম। আগে বলা হত, জনজাতিভুক্ত লোকজন স্কুলে পড়ালে স্কুল উচ্ছন্নে যাবে। এখনও অবধি কাউকে বলতে শোনা যায়নি, ‘সোনার চাঁদ’, ‘সোনার টুকরো’দের জন্য স্কুল উচ্ছন্নে গিয়েছে, এ বার এঁদের জন্য যাবে।
এ বার শিক্ষকসমাজের মধ্যে বৈষম্য নিয়েও দু’-চার কথা বলা যাক। স্কুলে চাকরিরত তফসিলি জাতি বা জনজাতির শিক্ষকদের বৈষম্যের খবর শিরোনামেও আসে। অনেক শিক্ষক অনেক ভাল নম্বর পেয়ে পড়াতে গেলেও বলা হয় ‘কোটা’তে এসেছেন— কপালে জোটে তাচ্ছিল্য, কটূক্তি। কিছু দিন পর চাকরি পেয়ে ইডব্লিউএস সংরক্ষণ পাওয়া লোকজন স্কুলে পড়াতে যাবেন, তাঁদের আশা করি তাচ্ছিল্য, কটূক্তির শিকার হতে হবে না। যে-হেতু তাঁদের লেজুড়ে জুড়ে আছে বড় বড় পদবি। মেধা নিয়েও প্রশ্নও উঠবে না।
বিষয়টা তা হলে সংরক্ষণ-বিরোধিতা নিয়ে নয়, প্রশ্ন যাঁরা সংরক্ষণ-সুবিধা পাচ্ছেন, তাঁদের পরিচিতি নিয়ে। সংরক্ষণের মাধ্যমে চাকরি বা ভর্তির সুযোগ পাওয়া মানেই পড়াশোনাতে দুর্বল, কিছু জানে না, এই মনোভাব পোষণ করা নিয়ে। ইডব্লিউএস চাকরিপ্রার্থীরা চাকরি পেয়ে স্কুলে মন দিয়ে পড়ান, সেটা সমস্যা নয়। প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। জাতিভেদ বিষয়ক মনোভাব নিয়েই আসল প্রশ্ন। তফসিলি জাতি-জনজাতিভুক্তরা সামাজিক সিঁড়ি দিয়ে উঠবেন কেন, সেটাই আসল প্রশ্ন। উচ্চ জাতি পদবিভুক্ত মানুষ সংরক্ষণের সুবিধা নিলেও সেই প্রশ্নের আওতায় পড়েন না, পড়বেন না। সংরক্ষণবিরোধীরাও কিন্তু এই আসল কথাটা বলছেন না। অথচ সততার খাতিরে তাঁদের এগিয়ে এসে জোর গলায় বলা উচিত যে, সংরক্ষণ নামক ব্যবস্থাটিতে আসলে তাঁদের আপত্তি নেই— আপত্তি হল, কে সংরক্ষণের সুবিধা পাচ্ছেন, নিচুতলার লোকরা পেয়ে যাচ্ছেন কি না— সেটা নিয়েই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)