E-Paper

ঘৃণা তৈরিই সন্ত্রাসের লক্ষ্য

‘স্টার্ট’-এর তথ্য-ভান্ডারটি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কিত বিশ্বে সর্ববৃহৎ কেন্দ্র। এঁরা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, সন্ত্রাসবাদীরা ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হত্যালীলা চালায় না— তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ঘৃণা এবং ক্রোধের সঞ্চার।

সুগত লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫ ০৬:৪৯

সন্ত্রাসবাদী মনস্তত্ত্বের বিশেষজ্ঞ হিসাবে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড-এর এরিয়ে ক্রুগলান্সকি, এবং ব্রায়ান মর কলেজের সোফিয়া মস্কালেঙ্কো ও ক্লার্ক ম্যাকলে সুপরিচিত। তিন জনই আমেরিকার হোমল্যান্ড সিকিয়োরিটি বিভাগের সন্ত্রাস প্রতিরোধ-সংক্রান্ত গবেষণা কেন্দ্র (স্টার্ট)-এর সঙ্গে যুক্ত। ‘স্টার্ট’-এর তথ্য-ভান্ডারটি সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কিত বিশ্বে সর্ববৃহৎ কেন্দ্র। এঁরা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দেখিয়েছেন যে, সন্ত্রাসবাদীরা ত্রাস সৃষ্টির উদ্দেশ্যে হত্যালীলা চালায় না— তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হল ঘৃণা এবং ক্রোধের সঞ্চার।

২০১৫ সালের নভেম্বরে প্যারিসে ‘আইএস’ হামলার বলি হয়েছিলেন ১৩০ জন, আর আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছিল ৩৫০। একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, যা মূলত ইরাক এবং সিরিয়ায় সুন্নি শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জেহাদ চালায়, তারা হঠাৎ ফ্রান্সের রাজধানীকে কেন বেছে নিল সন্ত্রাসের লক্ষ্য হিসেবে? প্রচুর সংখ্যক জেহাদি, উগ্রপন্থী, এবং সন্ত্রাসবাদীর দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারভিউ এবং অন্যান্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে ম্যাকলে ও মস্কালেঙ্কো বলছেন, ‘আইএস’-এর হামলার উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন দেশে, বিশেষত ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে— যেখানে প্রচুর ইসলাম ধর্মাবলম্বীর বাস— সেখানকার মুসলমানদের খেপিয়ে তোলা। এই হামলার পর, ‘আইএস’-এর ছক মতোই ফ্রান্সে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষের বিরুদ্ধে তৈরি হয় ঘৃণা এবং বিদ্বেষের পরিবেশ। সেই গণ-রোষের পরিবেশে বেশ কিছু ভেদাভেদমূলক এবং দমন-পীড়নমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা করা হয়, যার ফলে সমগ্র মুসলিম সমাজের মধ্যে তৈরি হতে থাকে বিরূপতা এবং বিচ্ছিন্নতা। আর এটাই তো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য— এতে সহজেই শক্ত হয় তাদের প্রতি সমর্থনের ভিত্তিভূমি। সামাজিক, প্রশাসনিক, এবং প্রাতিষ্ঠানিক অতি-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অজানতেই নিহিত থাকে নতুন জেহাদি তৈরির বীজ। অতি-প্রতিক্রিয়া উস্কে দেওয়ার এই কৌশলটিকেই দুই লেখক বলেছেন ‘সন্ত্রাসবাদের জুজুৎসু প্যাঁচ’— অর্থাৎ, প্রতিপক্ষের ওজনকে ব্যবহার করে তাকেই ধরাশায়ী করার কায়দা।

পহেলগাম হামলার পর ভারতেও অনুরূপ বিদ্বেষ ও বিরূপতার ঢেউ ওঠাটা তাই প্রত্যাশিত ছিল। এটাই সন্ত্রাসবাদীদের অন্যতম ঈপ্সিত লক্ষ্য। শুধু কাশ্মীরি টুরিস্ট-গাইড, টাট্টুওয়ালা, বা ফল বিক্রেতাই নয়, এই হামলার ঘটনার পরে ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের বিরূপতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, আমরা তা দেখেছি। অন্য দিকে, ভারতীয় সামরিক প্রত্যুত্তরের ফলে সন্ত্রাসবাদীরা পাকিস্তান সরকার এবং সেনাকেও মেঘের আড়াল থেকে বার করে এনে ভারতের বিরুদ্ধে খোলাখুলি যুদ্ধে নামিয়ে দিতে পেরেছে। ভারতের ক্ষেপণাস্ত্রে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জঙ্গিঘাঁটি পাক সরকারি খরচে পুনর্নির্মাণের আশ্বাস, ক্ষতিপূরণের ঘোষণা, সন্ত্রাসবাদীদের শেষকৃত্যে সেনা আধিকারিকদের অংশগ্রহণ— এ সবে পরিষ্কার প্রকাশ্য সমর্থন। অপারেশন সিঁদুরের পরে পাকিস্তানে হওয়া একটি গ্যালপ-পোলে দেখা যাচ্ছে সেই সহানুভূতি এবং সমর্থনের ঢল। ভারতের সঙ্গে এই যুদ্ধের পর পাকিস্তানের ৯৩% নাগরিকের মনে সেনাবাহিনী সম্পর্কে ধারণা আগের তুলনায় উজ্জ্বল হয়েছে। সেনার কাজকে সুনজরে দেখছেন ৯৭% মানুষ, আর বিরূপ মনোভাব পোষণ করছেন এক শতাংশেরও কম। সন্ত্রাসবাদীদের লক্ষ্য এবং লাভ এটাই।

এই জুজুৎসুর জাঁতাকল থেকে নিষ্ক্রমণের উপায় কী? বিশেষত, যেখানে সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধের প্রচলিত উপায়গুলি— যেমন, র‌্যাডিক্যালাইজ়েশন বা চরমপন্থায় দীক্ষার বৃত্তটি সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই চিহ্নিতকরণ, সংশোধন এবং সংস্কারমূলক কার্যক্রম (যেমন, ব্রিটেনের ‘প্রিভেন্ট’, ডেনমার্কের ‘অরহুস’, সৌদি আরবের ‘প্র্যাক’ ইত্যাদি)— এই সীমান্ত-পারের সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে অচল, কারণ জঙ্গিকরণের সমগ্র প্রক্রিয়াটিই ঘটছে অন্য দেশের মাটিতে। মস্কালেঙ্কোরা বলছেন, অতি-প্রতিক্রিয়ার বিপজ্জনক পরিণাম সম্পর্কে সচেতন করাই এ ক্ষেত্রে একমাত্র দীর্ঘমেয়াদি উপায়। র‌্যাডিক‌্যালাইজ়েশন টু টেররিজ়ম: হোয়াট এভরিওয়ান নিডস টু নো গ্রন্থে তাঁরা ব্যাখ্যা করেছেন: “উগ্রপন্থী এবং সন্ত্রাসবাদীরা আমাদের সেই দিকে ঠেলে দিতে চায়, যেখানে আমরা যেতে চাই না। আমাদের এই শত্রুরা আমাদের মধ্যে বিভাজন চায়, আমাদের নিজেদের মধ্যে লড়াই বাধিয়ে দিতে চায়, যাতে আমাদের মনোযোগ এবং শক্তি সেই লড়াইয়ে ব্যয় হয়ে যায়। তারা তখনই সফল হয় যখন আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি যে আমাদের রাজনৈতিক বিরোধীরা, আমাদের নিজের দেশের মানুষ হলেও, আসলে উন্মত্ত শয়তানের দল। রাজনৈতিক সহনশীলতার অর্থ হল সেই অভ্যন্তরীণ বিভাজনের দুই প্রান্তের মধ্যে সেতু বন্ধন।”

কঠিন সামরিক লড়াইয়ে আমরা জয়ী হয়েছি ঠিকই, কিন্তু এই জুজুৎসু প্যাঁচের বিরুদ্ধে সামাজিক এবং মানসিক লড়াই আরও কঠিন। আর এই যুদ্ধেও আমাদের জিততে হবে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy