E-Paper

রাজনীতিতে মেয়েরা কম কেন

আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিক ভাবে ছ’জন মহিলার নাম উঠে এলেও একে একে সরে গিয়েছেন সবাই। অন্য দিকে, কমলা হ্যারিস তখন শুধু ধর্ষণের হুমকি কিংবা যৌনগন্ধী মেসেজই পাচ্ছেন না, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রীতিমতো সংগঠিত ক্যাম্পেন চলছে নানা রাজ্যে।

প্রহেলী ধর চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:২৫

২০২৪ সালে মেক্সিকোর প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ক্লডিয়া শ্যেনবম। দিনকয়েক আগে মেক্সিকো শহরের জাতীয় প্রাসাদের সামনে জনসাধারণের সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি। সমর্থকদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়ের মাঝে হঠাৎই এক ব্যক্তি পিছন থেকে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় ক্ষণিকের জন্য স্তম্ভিত হয়ে যান ক্লডিয়া। সেই সুযোগে লোকটি আরও অভব্য ভাবে তাঁকে জড়িয়ে ধরে। অবশেষে দেহরক্ষীরা ছুটে এসে প্রেসিডেন্টকে উদ্ধার ও লোকটিকে গ্রেফতার করে। পুলিশের কাছে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেছেন ক্লডিয়া। বলেছেন, “আমার এই অভিযোগ এক জন সাধারণ নারী হিসেবেই। দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এমন ঘটলে, সাধারণ মহিলাদের নিরাপত্তা যে অনিশ্চিত, তা বলা বাহুল্য।”

কয়েক বছর আগের কথা। আমেরিকার ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিক ভাবে ছ’জন মহিলার নাম উঠে এলেও একে একে সরে গিয়েছেন সবাই। অন্য দিকে, কমলা হ্যারিস তখন শুধু ধর্ষণের হুমকি কিংবা যৌনগন্ধী মেসেজই পাচ্ছেন না, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে রীতিমতো সংগঠিত ক্যাম্পেন চলছে নানা রাজ্যে। ওই সময় আমেরিকার জনসাধারণের উপর করা একটি সমীক্ষা দেখাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে কোনও মহিলা পদপ্রার্থীর কাছে হারতে পারেন, এমনটা সে দেশের সাধারণ মানুষ বিশ্বাসই করেন না। বিশেষ করে ২০১৬ সালে তিনি হিলারিকে হারানোর পর থেকে। ট্রাম্পকে হারানোর মরণ-বাঁচন লড়াইতে ঝুঁকি নিয়ে কোনও মহিলা প্রার্থীকে দাঁড় করাতে চাইছিল না ডেমোক্র্যাটরা।

এমন ঘটনার কোনও শেষ নেই। ভারতীয় রাজনীতিক সুপ্রিয়া শ্রীনেত থেকে ইটালির লরা বোলদ্রিনি, সুইডেনের সেন্টার পার্টির নেত্রী অ্যানা-কারিন হ্যাট বা অ্যানি লুফ— লিঙ্গবিদ্বেষী কথাবার্তা, গালিগালাজ থেকে ধর্ষণ, খুন, এমনকি তাঁদের কন্যাসন্তানদেরও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। ক্লডিয়া শ্যেনবমের ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগেই তাই সুইডেনের সেন্টার পার্টির নেত্রী পদ থেকে সরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করলেন অ্যানা-কারিন হ্যাট। বললেন, ক্রমাগত কুকথা, হুমকি ইমেল, মেসেজ বা সমাজমাধ্যমে ঘৃণামন্তব্য তাঁকে প্রবল নিরাপত্তাহীনতার মুখে ঠেলে দিয়েছে। তিন বছর আগে তাঁর পূর্বসূরি অ্যানি লুফও একই কারণে পদত্যাগ করেছিলেন।

মারিয়েল ফ্র্যাঙ্কো তখন ব্রাজ়িলের সিটি কাউন্সিলের সদস্য। একাধারে তিনি রাজনীতিবিদ, নারীবাদী, কৃষ্ণাঙ্গ এবং উভকামী। সক্রিয় রাজনীতি এবং নারীবাদী ধর্না, মিছিল-সহ সকল কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য বহু ভাবে চমকানো হয়েছিল তাঁকে। কাজ হয়নি। ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ একটি অনুষ্ঠান শেষে ঘরে ফিরছিলেন ফ্র্যাঙ্কো। রিয়ো ডি জেনিরোর রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হল তাঁকে। বলিভিয়ার কাউন্সিলর হুয়ানা কিস্পেকেও খুন করা হয়েছিল। মৌখিক বা শারীরিক ভাবে যৌন হেনস্থা করে, অপরাধের তিরটি চরিত্রের দিকে ঘুরিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দান থেকে বার করে দেওয়ার চেনা পদ্ধতিটি ঘেঁটে দিচ্ছিলেন তিনি। সেই অপরাধেই ২০১২ সালে কুপিয়ে খুন করা হয় তাঁকে।

১৮৮৯ সালে প্যারিসে স্থাপন করা হয় বিশ্ব আন্তঃসংসদীয় সমিতি। ১৮০টি জাতীয় সংসদ নিয়ে নির্মিত এই আন্তর্জাতিক সংস্থা সম্প্রতি ২০১৬ সালে ৩৯টি দেশের ৫৫ জন মহিলা রাজনীতিকের উপর একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষাটি দেখায়, ৮২ শতাংশ মহিলা রাজনীতিকই রাজনৈতিক জীবনে সরাসরি মৌখিক বা শারীরিক যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন। কারও ক্ষেত্রে বিষয়টি ঘটেছে এক বার, কারও ক্ষেত্রে নির্যাতন চলেছে দীর্ঘ দিন। আন্তঃসংসদীয় সমিতি এ বার সমীক্ষার পরিধি বিস্তীর্ণ করে। সমিতির মহিলা কার্যক্রম বিভাগের দায়িত্বে থাকা জ়েইনা হিলাল বলেন, “এই যৌন নিগ্রহ কিন্তু আদপেও যৌন নিগ্রহের উদ্দেশ্যে নয়। নারীকে ক্ষমতার শীর্ষে দেখার অপারগতা, পুরুষ হয়ে এক জন মহিলার শাসন মেনে নেওয়ার অক্ষমতাই এমনতর নির্যাতনকে হাতিয়ার করে নেয়।” পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই অবদমনই মহিলাদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পথটি সঙ্কীর্ণ করে।

আজ রাজনীতির বিভিন্ন স্তরে মহিলা পদের ন্যূনতম সংখ্যা বেঁধে দেওয়ার ফলে লিঙ্গবৈষম্যে ভরপুর দেশগুলিরও এক বড় সংখ্যক মহিলা রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন বটে, কিন্তু সেই পদের আসল দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁর স্বামী বা পুত্র। মহিলা পঞ্চায়েত প্রধান— লোকে যাঁর নামই জানে না, চেনে অমুকের মা আর তমুকের স্ত্রী পরিচয়ে, তাঁর শাসন মানবে জনসাধারণ, এ কি হয়! আবার শীর্ষস্তরীয় নেতৃত্বে এই ভাবে পৌঁছনো যায় না বলেই বিশ্ব জুড়ে শীর্ষনেতৃত্বে মেয়েদের স্থান এত কম।

অবশ্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে ক’দিন পর হয়তো সেই মুশকিলও আসান হয়ে যাবে। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের দেশ আলবানিয়া এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসেই দিয়েলা নামক এক মহিলা এআই প্রতিমন্ত্রী তৈরি করেছে। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী আবার দিয়েলার প্রতিমন্ত্রী হওয়ার দু’মাসের মধ্যেই তার গর্ভবতী হওয়ার খবর ঘোষণা করেছেন। জানিয়েছেন, তাঁর এআই প্রতিমন্ত্রী শীঘ্রই ৮৩ জন সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে। এই ৮৩ জন ভার্চুয়াল সন্তানের প্রত্যেকেই তাঁর সোশ্যালিস্ট পার্টি দলের সাংসদদের দফতরের কাজে সহকারী হিসাবে নিযুক্ত হবেন।

এই না হলে সভ্যতার অগ্রগতি?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

politicians Politics

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy