এটা সেই সময়ের কথা যখন ওরা সংবিধান স্থগিত করল। ওরা বলেছিল এটা সাময়িক। রাস্তায় কোন রায়ট হয়নি। সবাই রাতে বাড়িতে বসে টেলিভিশন দেখছিল, দিশা খুঁজছিল ভবিষ্যতের। এমন কোনও নির্দিষ্ট শত্রু ছিল না যার দিকে আঙুল তোলা যায়।” (দ্য হ্যান্ডমেড’স টেল, মার্গারেট অ্যাটউড)
সম্প্রতি প্রদর্শিত সমনামী জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ়ের জন্য মার্গারেট অ্যাটউডের দুঃস্বপ্নকল্প ‘ডিস্টোপিয়ান’ উপন্যাসটি সমাজমাধ্যমে আজ নতুন ভাবে চর্চিত। এর সঙ্গে অবশ্যই যুক্ত হয়েছে আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দক্ষিণপন্থী-জনবাদী নেতৃত্বের দ্বারা গৃহীত এমন কিছু রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ, যা নারীবাদী-সহ অন্য প্রগতিশীলবর্গকে আশঙ্কিত করেছে। অ্যাটউডের উপন্যাসে খ্রিস্টীয় মৌলবাদ-শাসিত রাষ্ট্র গিলিয়াড-এ নারীর অস্তিত্ব ও অধিকারের কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক স্বীকৃতি নেই, জন্মহারের ক্রমশপতনের সঙ্কটদীর্ণ এই সমাজে নারীর একমাত্র মূল্য তার গর্ভের উর্বরতায়। গিলিয়াড-এ সমকামিতা ও রূপান্তরকামিতার ঘোরতর বিরোধিতা-সহ চলে মুক্তচিন্তা ও নাগরিক অধিকারের নিত্য হনন। উপন্যাসের এ-হেন কল্পিত সমাজব্যবস্থা দেখে বাস্তবের ডোনাল্ড ট্রাম্প-শাসিত বর্তমান আমেরিকার সমাজের সঙ্গে তার কিছু আদর্শগত মিল খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। সেই সঙ্গে চলছে আমেরিকায় একদা প্রতাপশালী রাজনৈতিক উদারবাদের অকালমৃত্যুর আশঙ্কা।
সমসাময়িক বিশ্বপুঁজিবাদের অন্যতম নায়ক ইলন মাস্ক সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে বর্তমান আমেরিকায় সর্বপ্রধান সমস্যারূপে চিহ্নিত করেন ক্রমহ্রাসমান জন্মহারকে। ট্রাম্পের দলীয় সহকর্মী-সহ তাঁর অতি ঘনিষ্ঠ ধনকুবের শিল্পপতিরা বিভিন্ন সময়ে দেশে জন্মহার বৃদ্ধির স্বার্থে আমেরিকান মহিলাদের পেশাগত কর্মক্ষেত্র থেকে অব্যাহতি নিয়ে ঘর-সংসারে মন দিতে ও সন্তান লালনপালন করতে উদ্বুদ্ধ করছেন, এবং পেশাগত কর্মক্ষেত্রকে ‘পৌরুষ-সংস্কৃতি’র রঙে রাঙিয়ে নিতে ডাক দিচ্ছেন। গৃহশ্রম ও সন্তানপালনই খ্রিস্টীয় নারীর আদর্শ— এমন প্রচারের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে চলছে সেই সব নারীকে উপহাস ও অবমাননা, যাঁরা বিবাহ, পরিবার ও নারীত্বের প্রথাগত সংজ্ঞার বাইরে জীবনযাপন করেন। উদাহরণস্বরূপ ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্সের ‘সন্তানহীনা বিড়াল-মহিলা’দের প্রতি কটাক্ষ উল্লেখযোগ্য। রাজনৈতিক শিবিরের বাইরেও একটি বৃহত্তর জনবাদী সাংস্কৃতিক পরিসর গড়ে উঠেছে সমাজমাধ্যমে, যেখানে বিভিন্ন ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’রা নারীত্বের আদর্শ সংজ্ঞারূপে ‘ট্র্যাড ওয়াইফ’ (প্রথানুসারী/রক্ষণশীল পত্নী) বা তার অনুরূপ পৌরুষের সংজ্ঞারূপে ‘আলফা মেল’ (প্রতাপশালী পুরুষ) ইত্যাদি ধারণাগুলি নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। অন্যান্য দেশেও সিনেমা ও সমাজমাধ্যমের হাত ধরে নারীত্ব ও পৌরুষের এমন ধারণা ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে।
ধনকুবের উদ্যোগপতিদের এ-হেন বার্তায় এবং ট্রাম্পের মতো দক্ষিণপন্থী-জনবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁদের এমন প্রকাশ্য ঘনিষ্ঠতায় লিবারাল বা উদারবাদীরা, বিশেষত যাঁরা পুঁজিবাদের সঙ্গে উদারবাদকে সমার্থক মেনে এসেছেন তাঁরা যথেষ্ট শঙ্কিত। ঐতিহাসিক ভাবে রাজনৈতিক উদারবাদ ও পুঁজিবাদের উত্থান সমসাময়িক হলেও তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক ও বোঝাপড়া ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। এ ছাড়াও আমেরিকা-সহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে উদারবাদের ঘোষিত সমর্থকদের মনে উদারবাদ সম্পর্কে একটি সামাজিক প্রগতিশীলতার ফ্যান্টাসি বা রূপকল্প কাজ করে, যাকে অরেলিয়েন মোন্ডন, ডমেনিক লোসার্ডো-সহ তাত্ত্বিকেরা তাঁদের বিশ্লেষণে অনেকাংশেই অনৈতিহাসিক বলে দাবি করেছেন। উপনিবেশবাদ, ক্রীতদাসপ্রথা, বর্ণবাদ, নারীদের ভোটাধিকারের বিরোধিতার মতো বিষয়ে সাবেক উদারবাদীরা সময়ে সময়ে কপটতার আশ্রয় নিতে দ্বিধাবোধ করেননি। উদাহরণস্বরূপ তাঁর লিবারালিজ়ম: আ কাউন্টার-হিস্ট্রি বইতে লোসার্ডো উল্লেখ করেছেন মধ্য-উনিশ শতকে তৎকালীন আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট জন সি ক্যালহুনের কথা। ক্যালহুন রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মুক্তচিন্তা, সাংবিধানিক শাসন ও সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রবল সমর্থক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন দাসপ্রথারও সমর্থক, তিনি কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের আইনসম্মত সম্পত্তি রূপে গণ্য করতেন। বর্তমান ইউরোপে সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে অতীতবিলাসিতা, বা আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীদের পৌরুষের আস্ফালনের মাঝে চাপা পড়ে যায় বিগত উদারবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় চলে আসা প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদের অভিঘাত বা কেন্সীয় অর্থনৈতিক সমাজকাঠামোয় হয়ে চলা লিঙ্গভিত্তিক মজুরির অসাম্যের কথা।
সমসাময়িক কালে পুঁজিবাদের সঙ্গে দক্ষিণপন্থী-জনবাদ ও সামাজিক রক্ষণশীলতার এমন নিবিড় যোগাযোগকে বুঝতে হলে আমাদের যেতে হবে নব-উদারনীতিবাদ বা নিয়োলিবারালিজ়ম-এর শুরুর দিনগুলিতে। ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিমি সমাজে আমেরিকান আধিপত্যের স্বর্ণযুগে বিখ্যাত নব-উদারনৈতিক অর্থনীতিবিদ ফ্রিডরিখ ভন হায়েকের প্রতিষ্ঠিত মঁ পেলেরিন সোসাইটি-র সম্মেলনে প্রশ্ন ওঠে— কমিউনিজ়মের পতনের পর এবং নব-উদারনীতিবাদ প্রস্তাবিত সমাজকাঠামোয় যখন রাষ্ট্রের ভূমিকা সীমিত হয়ে আসে, তখন আর্থ-সামাজিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে কোন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা উচিত? উত্তরে পরিবার ও ধর্মীয় সমিতির কথা উঠে আসে।
মঁ পেলেরিন সোসাইটি-র সভ্যরা নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় সামাজিক আন্দোলনগুলি, যেমন পরিবেশবাদ, বর্ণবিদ্বেষবিরোধিতা, লিঙ্গসাম্য, কুইয়ার-ট্রান্স পরিচিতি ইত্যাদিকে সাবেক পরিবার ও ধর্মীয় চেতনার পক্ষে ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত করেন। এর বিপরীতে তাঁরা বিবর্তনবাদ, জেনেটিক্স ও আচরণমূলক তত্ত্বের আশ্রয় নিয়ে লিঙ্গভেদ, শ্রেণিভেদ ও বর্ণবিভেদের সপক্ষে সওয়াল করেন। তাঁদের মতে, মানুষে মানুষে প্রভেদ যেখানে প্রাকৃতিক, স্থায়ী ও বাজারের অর্থনীতির নিয়ম মেনে স্বাভাবিক ও কাম্য, সেখানে নারীবাদ প্রমুখ আন্দোলন সমাজে অযথা অস্থিরতা তৈরি করে।
বর্তমান সময়ের ধনকুবের শিল্পপতিদের বহুচর্চিত ভাষ্য এই নব-উদারনৈতিক ধ্যানধারণারই উত্তরসূরি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের প্রাধান্যের যুগে জন্মহার সঙ্কোচনের কারণে অদূর ভবিষ্যতে একই সঙ্গে শ্রমিকদের গণ-বেকারত্ব সামাল দেওয়া ও ক্রেতার সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা তাড়া করে বৃহৎ পুঁজিপতিদের। ফলস্বরূপ নারীদের সন্তানজন্ম, পালন ও গৃহকর্মে ব্যস্ত রাখার দাওয়াই দেওয়া হয়। মনে করা হয়, নারীদের পেশাগত কর্মজগৎ থেকে বিদায় ঘটলে কর্মপ্রত্যাশী শ্রমিকদের সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে, আবার জন্মহার বৃদ্ধির ফলে ভবিষ্যৎ ক্রেতার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে।
তাই কল্পিত রাষ্ট্র গিলিয়াড-এ ‘হ্যান্ডমেড’ বা ‘ওয়াইফ’দের মতো কঠোর নিয়মবদ্ধ জীবন পরিবেশন না করে পশ্চিমি সমাজের নতুন প্রজন্মের মেয়েদের একাংশকে প্রলুব্ধ করছে ইন্টারনেটে-সমাজমাধ্যমে জনপ্রিয় ‘ট্র্যাড ওয়াইফ’ কনটেন্ট। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে, পেশাগত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, ঘরে-বাইরে কাজ সামলে, কাজের জগতে অনবরত বৈষম্যের শিকার হয়ে, ক্রমবর্ধমান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির জেরে নাজেহাল ও ক্লান্ত এই মেয়েদের মনের আরাম হয়ে দেখা দেয় ট্র্যাড ওয়াইফ-জগতের কল্পিত এক সুখকর গৃহিণীজীবন।
অ্যাটউডের নায়িকা জুন অসবর্ন যেমন আসন্ন বিপদের আগমন সম্বন্ধে অবগত হতে বড় দেরি করে ফেলেছিলেন, ভয় হয়— বৃহৎ পুঁজি, আগ্রাসী জনবাদ ও সমাজমাধ্যমের ককটেল আমাদের মনের অজানতেই আমাদের নবপ্রজন্মকে কোনও দুঃস্বপ্নকল্পের বাসিন্দা বানিয়ে দেবে না তো?
পলিটিক্স বিভাগ, ক্রিয়া ইউনিভার্সিটি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)