E-Paper

কতটা কাজ করলে তবে...

গুজরাতের নতুন আইনে সাপ্তাহিক মোট কাজের সময়সীমা ৪৮ ঘণ্টা স্থির রেখে দৈনিক কাজের ঘণ্টা ৯ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হল। অর্থাৎ, যে সব কলকারখানায় আগে তিনটে শিফ্‌ট চলত, সেগুলিতে এখন ১২ ঘণ্টা করে দুই শিফ্‌ট চলবে।

রঞ্জিত শূর

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:৩৩

কতক্ষণ কাজ করলে তবে ‘শ্রমিক’ বলা যায়? গুজরাতের বিজেপি সরকার বিধানসভায় আইন পাশ করে কল-কারখানায় ১২ ঘণ্টার শ্রম দিবস চালু করল ১০ সেপ্টেম্বর। ফ্যাক্টরি অ্যাক্ট ১৯৪৮-এর এই সংশোধন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকারের মন্ত্রিসভাও। দৈনিক কাজের সময় ১২ ঘণ্টা করার আইন আনা হবে মহারাষ্ট্রের বিধানসভাতেও। বস্তুত অধিকাংশ বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই হয় আইন করে, অথবা অর্ডিন্যান্স জারি করে শ্রম দিবস ১২ ঘণ্টা করা হয়েছে, বা হতে চলেছে। কর্নাটক বা তেলঙ্গানার মতো কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যে বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। তামিলনাড়ুতে ফ্যাক্টরি আইন সংশোধন (২০২৩) করে বলা হয়েছে, শ্রমিকরা চার দিনের কর্মসপ্তাহ বেছে নিলে দিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে।

গুজরাতের নতুন আইনে সাপ্তাহিক মোট কাজের সময়সীমা ৪৮ ঘণ্টা স্থির রেখে দৈনিক কাজের ঘণ্টা ৯ থেকে বাড়িয়ে ১২ করা হল। অর্থাৎ, যে সব কলকারখানায় আগে তিনটে শিফ্‌ট চলত, সেগুলিতে এখন ১২ ঘণ্টা করে দুই শিফ্‌ট চলবে। এক জন শ্রমিক চাইলে চার দিনে ৪৮ ঘণ্টা কাজ করে বাকি তিন দিন ছুটি উপভোগ করতে পারবেন। মহারাষ্ট্র সরকার সাপ্তাহিক কাজের সময় ৬০ ঘণ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঐতিহাসিক মে দিবসের লড়াইয়ে অর্জিত ৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা আমোদ-প্রমোদের অধিকার আপাতত হারালেন গুজরাতের শ্রমিকরা। হারাতে চলেছেন মহারাষ্ট্র ও অন্যান্য রাজ্যের শ্রমিকরাও। অথচ ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)-র প্রস্তাবিত ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের নথিতে প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশগুলির অন্যতম ছিল ভারত।

গুজরাতের আইনে অবশ্য কাগজে-কলমে বলা আছে দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রম দিবস এক জন শ্রমিক চাইলে নাও করতে পারেন। পুরনো নিয়মেই দৈনিক ন’ঘণ্টা শ্রম দিবস মেনে কাজ করতে পারেন। যদিও বাস্তবে এক জন শ্রমিকের পক্ষে এটা কতটা সম্ভব, সে প্রশ্ন থাকছেই। কারণ ১২ ঘণ্টা শ্রম দিবসের ফরমান মানতে রাজি না হলে শ্রমিকের কাজ চলে যাবে না, বা অন্য কোনও ভাবে তাঁকে হয়রান করা হবে না, এ রকম কোনও ধারা আইনে রাখা হয়নি। ফলত আইনে যা-ই থাকুক সাধারণ ভাবে সব শ্রমিকই ১২ ঘণ্টা কাজের নির্দেশ মানতে বাধ্য হবেন, তার সম্ভাবনাই বেশি। ছোট ছোট কলকারখানায় ১২ ঘণ্টার শ্রম দিবস বাড়তি মজুরি ছাড়াই বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে, সে-ও প্রায় অবধারিত।

সরকার ও মালিকপক্ষের যুক্তি হল, ১২ ঘণ্টা শ্রম দিবসের ফলে উৎপাদন বাড়বে। পুঁজিপতিরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। যা উল্লেখ করা হয়নি তা হল, বৃহৎ লগ্নি অনিশ্চিত হলেও নিয়োগকারীদের লাভ নিশ্চিত। কারণ, তিন শিফ্‌ট কাজ মানে দু’বার মেশিন বন্ধ হওয়া। দু’বার শ্রমিক বদল হওয়া। ১২ ঘণ্টা করে দুই শিফ্‌ট হলে মেশিন এক বার বন্ধ হবে। শ্রমিক বদল এক বার হবে। এর ফলে টানা মেশিন চলবে। তাতে সময় নষ্ট হবে কম, উৎপাদন বাড়বে। শ্রমিকসংখ্যাও কমবে। পুরনো পদ্ধতিতে ১২ ঘণ্টা কাজ করাতে হলে তিন ঘণ্টা ওভারটাইম দিতে হত। তাতে দেড়গুণ বা দ্বিগুণ মজুরি দিতে হত। দেখা গিয়েছে, অনেক কলকারখানায় অনেক সময় মালিকপক্ষ শ্রমিকদের ওভারটাইম করাতেই পছন্দ করেন, যাতে মেশিন বন্ধ না হয় এবং বাড়তি উৎপাদন পাওয়া যায়।

সবই ঠিক, কিন্তু শ্রমিকদের লাভটা কী হচ্ছে, তা বোঝা গেল না। একই টাকায়, অথবা সামান্য বেশি মজুরিতে (যার হার অনির্ধারিত) আরও বেশি সময় কাজ করে কী ভাবে লাভবান হবেন মজুররা?

বিশেষত ভারতে শ্রমিকদের যা শারীরিক সক্ষমতা, যথাযথ পুষ্টি, চিকিৎসা ইত্যাদির যেমন অভাব দেখা যায়, তাতে তাঁদের পক্ষে কি একটানা ১২ ঘণ্টা কাজ করা সম্ভব? এর ক্ষতিকর প্রভাব কি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, মানসিক স্বাস্থ্য ও কাজের মানের উপরে পড়বে না? দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়বে, সেই সম্ভাবনা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? দীর্ঘ সময় চাপের মুখে কাজ করলে শ্রমিকদের কর্মজীবনের মেয়াদ কমবে, সেই আশঙ্কাও থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরও লাভের আশায় শ্রমিকদের উপর এই বাড়তি চাপ সোনার ডিম-পাড়া হাঁস কেটে ফেলার মতো হতে চলেছে। এতে শেষ বিচারে সামগ্রিক ভাবে শ্রম সর্ম্পক, উৎপাদন, লাভ, সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আবার অনেকে বলছেন, আধুনিক মেশিনে ১২ ঘণ্টা কাজ করা কঠিন নয়। কারণ আধুনিক মেশিনে শারীরিক পরিশ্রম কম লাগে। কিন্তু যে সব শিল্পে উচ্চপ্রযুক্তির মেশিন চলছে, সেখানে শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা কী? তাঁরা দেখছেন যে আধুনিক মেশিনে গায়ের জোর কম লাগলেও যেমন নিবিড় ভাবে মস্তিষ্কের প্রয়োগ করতে হয়, বৌদ্ধিক শ্রম দিতে হয়, তাতে শ্রমশক্তির উপযোগ হয় বেশি। তাই বহু দেশে আধুনিক মেশিনের কলকারখানায় ট্রেড ইউনিয়নগুলি আন্দোলন করে দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা বা তারও নীচে নামিয়ে এনেছে। যেমন ফ্রান্সে সাপ্তাহিক শ্রম সময় ৩৫ ঘণ্টা।

বিশ শতকের গোড়ার দিকে কাজের সময় ৮ ঘণ্টায় বেঁধে দেওয়ার জন্য শ্রমিকরা আন্দোলন করেছিলেন ভারত-সহ নানা দেশে। সেই অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং সারা বিশ্বের, বিশেষত উন্নত বিশ্বের অবস্থানের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ১২ ঘণ্টা শ্রম দিবস চালু হচ্ছে ভারতে। যা নিয়ে তেমন ভাবে কোনও বিতর্কই হচ্ছে না আইনসভায়, বা সমাজে। এ দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, বা কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো তেমন ভাবে সরব হচ্ছে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Labour Workers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy