৫৭টি বাণিজ্যসঙ্গী দেশের উপরে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঐতিহাসিক ‘পাল্টা শুল্ক’-র হার ঘোষণা করার পর, যে দিন থেকে এই শুল্ক চালু হওয়ার কথা, সে দিনই জানা গেল, আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত থাকছে সিদ্ধান্তটি। তবে, চিন যে-হেতু এই ‘পাল্টা শুল্ক’-র পাল্টা দিয়ে সব আমেরিকান পণ্যের উপরে ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল, তাই আমেরিকা তার পাল্টা ঘোষণায় চিনের পণ্যের উপরে ১৪৫% আমদানি শুল্ক চাপাল— বস্তুত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে দু’বার এই হার বাড়ালেন; প্রথমে ৫৪% থেকে ১০৪%, তার পর ১৪৫%।
আধুনিক বৈশ্বিক বাণিজ্য-কূটনীতির ক্ষেত্রে এটি অন্ধকারতম পর্যায়, যেখানে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থব্যবস্থা পরস্পরের সঙ্গে এমন বিপুল মাত্রায় পাল্টা দেওয়ার লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। গোটা দুুনিয়াকেই বিপন্ন করতে পারে এই শুল্ক-যুদ্ধ। ইয়েল ইউনিভার্সিটির বাজেট ল্যাব-এর হিসাব অনুযায়ী, ২ এপ্রিল তারিখে যে ‘পাল্টা শুল্ক’ ঘোষিত হয়েছে, তা আমেরিকার এফেক্টিভ ট্যারিফ রেট বা কার্যকর আমদানি শুল্কের হারকে ১১.৫ শতাংশ-বিন্দু বাড়িয়ে পৌঁছে দিয়েছে ২২.৫ শতাংশে— ১৯৩০-এর দশকের পরে এত চড়া শুল্কের হার আর কখনও নির্ধারিত হয়নি।
প্রেসিডেন্ট হিসাবে ট্রাম্পের প্রথম পর্বেই বোঝা গিয়েছিল, তাঁর বাণিজ্যনীতির কেন্দ্রে থাকতে চলেছে শুল্ক। এই নির্বাচনের প্রচারপর্বও শুল্ক-ময়। বস্তুত, এক সাক্ষাৎকারে কোনও রাখঢাক না করেই নিজের শুল্ক-প্রীতির কথা ঘোষণা করেছিলেন তিনি। এ দফায় ওভাল অফিসের দখল নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর বাণিজ্যনীতির মূল অভিমুখ স্পষ্ট করে দেন ট্রাম্প— দীর্ঘ দিন ধরে বাণিজ্য ঘাটতি এবং তার ফলে তৈরি হওয়া অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত ঝুঁকির সমস্যা দূর করার জন্য শুল্কের অস্ত্রই ব্যবহার করা হবে। ফলে, আপাতত নব্বই দিনের জন্য বর্ধিত শুল্ক আদায় স্থগিত থাকলেও তাতে নিশ্চিন্ত হওয়ার বিশেষ কারণ নেই।
ট্রাম্পের রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতির সঙ্গে আশ্চর্য মিল আমেরিকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর বাণিজ্যনীতির। ১৯২১ সালে আমেরিকান কংগ্রেস টেম্পোরারি ইমার্জেন্সি ট্যারিফ অ্যাক্ট পাশ করে; পরের বছরে তৈরি হয় ফোর্ডনি-ম্যাককাম্বার ট্যারিফ অ্যাক্ট, ১৯২২। তাতে প্রেসিডেন্টের হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়— বাণিজ্যসঙ্গী দেশের উৎপাদনের ব্যয়ের সঙ্গে আমেরিকার উৎপাদন ব্যয়ের সাযুজ্য বজায় রাখতে তিনি আমদানি শুল্কের হার ৫০ শতাংশ বাড়াতে বা কমাতে পারবেন। ১৯২৮ সালে হার্বার্ট হুভার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বাণিজ্য-রক্ষণশীলতা আরও বাড়ে— ‘রক্ষণশীল শুল্কের হার কোনও অর্থব্যবস্থার মৌলিক ও অপরিহার্য নীতি’ বলে তারা বিশ্বাস করে, জানায় রিপাবলিকান পার্টি। তারা বলে, ‘দেশের আর্থিক সমৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে’ এবং ‘আমেরিকানদের জীবনযাত্রার মান সর্বকালীন সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়ার জন্য’ এই নীতি মেনে চলতেই হবে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করে ১৯৩০ সালে স্মুট-হলি ট্যারিফ অ্যাক্ট পাশ করার মাধ্যমে সে দেশে গড় শুল্কের হার পৌঁছয় ৪২ শতাংশে— আমেরিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
স্মুট-হলি ট্যারিফ অ্যাক্টের দু’টি প্রত্যক্ষ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঘটে— এক, ফ্রান্স, সুইটজ়ারল্যান্ড, ইটালি এবং কানাডা-সহ মোট ন’টি দেশ আমেরিকার পণ্যের উপরে পাল্টা চড়া শুল্ক চাপানোয় শুরু হয় বাণিজ্য-যুদ্ধ, আর তার ফলে এই দেশগুলোতে আমেরিকার রফতানির পরিমাণ কমে ২৮-৩২%; এবং, এই ইটের পাল্টা পাটকেল নীতির ফলে ১৯২৯-এর শেয়ার বাজারের ধসের প্রভাব গভীরতর হয়, যা শেষ অবধি আধুনিক কালের ভয়ঙ্করতম ও দীর্ঘতম আর্থিক সঙ্কট গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দায় পৌঁছয়।
ট্রাম্পের শুল্ক-নীতিও বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থাকে বিপন্ন করছে— আরও একটি আর্থিক মন্দার কালো মেঘ জমছে বাণিজ্যের আকাশে। দুনিয়া জুড়ে শেয়ার বাজারে যে উথালপাথাল ঘটছে, তা ট্রাম্পের একতরফা নীতির ফলে তৈরি হওয়া আর্থিক অনিশ্চয়তার একটি উল্লেখযোগ্য মাপকাঠি। গোল্ডম্যান স্যাকস এবং জে পি মর্গান-এর মতো ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কগুলির পূর্বাভাস, ২০২৫ শেষ হওয়ার আগেই আমেরিকা আর্থিক মন্দার মুখে পড়বে— ফলে, গোটা দুনিয়াতেই আর্থিক সঙ্কোচন ঘটার আশঙ্কা। কিন্তু, ট্রাম্পের নীতির দীর্ঘমেয়াদি কুপ্রভাব এর চেয়েও মারাত্মক। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে স্বচ্ছ এবং অনুমানযোগ্য ভাবে চলবে, তা নিশ্চিত করার জন্য নীতিভিত্তিক যে বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, ট্রাম্পের শুল্ক-সিদ্ধান্ত তার পক্ষে প্রাণঘাতী।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর দুনিয়ায় বিশ্ব বাণিজ্যের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েছে এবং, তা সুস্থায়ী হয়েছে বহুপাক্ষিক স্তরে স্বীকৃত কিছু নিয়ম মেনে চলার জন্য— প্রথম জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড (গ্যাট) চালু করার মাধ্যমে, এবং তার পরবর্তী কালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজ়েশন বা ডব্লিউটিও) অধীনে রূপায়িত চুক্তির মাধ্যমে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে, ২০২৪ সালে বিশ্ব বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৯৫০ সালের ৪৫ গুণ— যে হারে বৈশ্বিক আয় বেড়েছে, বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়েছে তার চেয়ে বেশি হারে।
গ্যাট/ডব্লিউটিও নীতিকাঠামোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি ছিল ‘নন-রেসিপ্রোসিটি’ বা পাল্টা শুল্ক চালু না করার নীতি। অর্থাৎ, উন্নত দেশগুলি যখন তাদের বাজার খুলে দিতে সম্মত হয়েছিল, তখন তুলনায় অনুন্নত দেশগুলিকে উদারীকরণের বোঝা থেকে বহু দূর অবধি নিস্তার দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে অনুন্নত দেশগুলি তাদের সদ্য গড়ে ওঠা শিল্পক্ষেত্রগুলিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ময়দানে প্রতিযোগিতা থেকে আড়াল করতে পেরেছিল। এই দেশগুলি যত উন্নতি করছিল, বিশ্ব বাণিজ্যে তাদের অবদান যত বাড়ছিল, বৈশ্বিক আয়ও বাড়ছিল— ফলে উন্নত দেশগুলির বাণিজ্যও লাভবান হয়েছিল।
ট্রাম্পের বাণিজ্য নীতি— বিশেষত তাঁর ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপের সিদ্ধান্ত— এই পারস্পরিক লাভের কাঠামোটিকে ঘেঁটে দিচ্ছে। এবং, এর ফলে ডব্লিউটিও-র কাজের মূল ভিত্তিটিই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম দফাতেও ট্রাম্প বেশ কিছু গুরুতর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, বিশেষত ডব্লিউটিও-র বিবাদ নিষ্পত্তিকারী সংস্থাটির কাজে তার বিপুল প্রভাব পড়েছিল। এই সংস্থার কাজ বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত নীতিগুলি যাতে যথাযথ ভাবে পালিত হয়, তা নিশ্চিত করা। এই দফায় ট্রাম্প যে বাণিজ্য-যুদ্ধের সূচনা করলেন, তা বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার অস্তিত্বকেই সঙ্কটে ফেলবে।
বাণিজ্য যুদ্ধে কেউ বিজয়ী হয় না। এ কথাটি হার্বার্ট হুভার ১৯৩০-এর দশকে বহুমূল্যে শিখেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও তা শিখতে হবে, সে সম্ভাবনাই প্রবল। এ দফায় বাণিজ্য-যুদ্ধে নামার হঠকারিতা করার আগে তাঁর প্রথম দফার রক্ষণশীল নীতির কুপ্রভাবের কথা মাথায় রাখা উচিত ছিল। ২০১৬ সালে যখন ট্রাম্প ক্ষমতায় এলেন, তত দিনে আমেরিকার রফতানি ক্ষেত্রটি ২০০৭-এর মন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠেছে— ২০১১ সালে বিশ্ব বাণিজ্যে সে দেশের ভাগ দাঁড়িয়েছিল ১০.২%, ২০১৬-তে তা বেড়ে হয় ১১.৫%। কিন্তু, ২০২১-এর গোড়ায় ট্রাম্প যখন হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিলেন, তখন বিশ্ব বাণিজ্যে আমেরিকার ভাগ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ১০.৪ শতাংশে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এ কথাটিও খেয়াল করলে ভাল করতেন যে, সেই একই সময়কালে বিশ্ব বাণিজ্যে চিনের ভাগ ১১.৫% থেকে বেড়ে হয়েছিল ১৩.৪%।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)