E-Paper

এক যে ছিল বাঘ...

প্রধানত রাজস্থানেই থাপরের কাজ। রণথম্ভোরের তদানীন্তন বনাধিকারিক ফতেহ্ সিংহ রাঠৌর ছিলেন তাঁর বাঘ-গুরু। রাঠৌরের সহায়তায় পশুদের পর্যবেক্ষণ করে থাপর বাঘবিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন।

চিরশ্রী মজুমদার 

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ ০৫:৪৮

মনে করুন, সূর্যাস্তের নিবন্ত আলোয়, লোকালয় ছাড়িয়ে একটা সরু রাস্তা ধরেছেন। বন ক্রমশ গ্রাস করছে আপনাকে। পাশেই ভাঙা দুর্গের পাঁচিল। জীর্ণ বোর্ডে লেখা সতর্কবার্তা। তখনই যদি পাশের ঘন সবুজে হঠাৎ জেগে ওঠে অতিকায় মাথা আর জ্বলন্ত দুটো চোখ? কল্পনা নয়, এমনই রোমাঞ্চ থিকথিক করছে ভারতীয় অরণ্যে। এ রহস্য অফুরন্ত, কিন্তু তত দিনই, যত দিন বন থাকবে, আর রাজত্ব করবে শ্বাপদ। বাঘ, সিংহ, লেপার্ড, হায়েনা, শিয়াল, নেকড়ে ও তাদের ঘিরে আবর্তিত জীবনশৃঙ্খলা। দেশি রাজারাজড়া আর ব্রিটিশরা এই গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছিল বলেই না এত জাঙ্গল পার্টি, ফরেস্ট রেস্ট হাউস! কিন্তু তারা তো সব লুট করে খতমই করে গিয়েছিল প্রায়। ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫— এর মধ্যেই আশি হাজার বাঘ মারা পড়েছে। স্বাধীন ভারতে সত্তরের দশক থেকে শিকার-রোধী বন্যপ্রাণ আইন ও প্রোজেক্ট টাইগার বলবৎ হতে, ধীরে ধীরে আবার পুষ্ট হয়েছে অরণ্যের অধিকার।

এই পুনর্জাগরণেরই অন্যতম কান্ডারি সদ্যপ্রয়াত বল্মীক থাপর। এই যে ভারতে বন, বাঘ বাড়ল, বন্দুকধারী ‘অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্ট’ থেকে কলম ও ক্যামেরার ‘অ্যাডভেঞ্চার আর্ট’-এ রূপান্তরিত হল অরণ্যাভিযান, শিকারির শিং-চামড়া সংগ্রহের অনাচারের শাপমুক্তি ঘটল জীব সংরক্ষণে, তার জন্য অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ। ‘বিলি’ অর্জন সিংহ, ফতেহ্ সিংহ রাঠৌর, সঞ্জয় দেবরায়, জি ভি রেড্ডি, রঘু চন্দওয়ত, উল্লাস করন্থ— প্রত্যেকে দিকপাল। কিন্তু, প্রথাগত তালিম-বিহীন থাপর-ই ভারতের বাঘ-মানব নামে অধিকতর পরিচিত। দিল্লির অভিজাত বিদ্বান পরিবারের সন্তান, ইন্দিরা গান্ধীর স্নেহাস্পদ, শীর্ষ স্তরে চিরকাল সম্মানিত, টাইগার টাস্ক ফোর্স-সহ শতেক কমিটির সদস্য। তাঁর মেঘমন্দ্র হুঙ্কারেই বাঘ সংরক্ষণের বাধা টলে যেত। একাধারে চিত্রগ্রাহক, তথ্যচিত্রকার, সংরক্ষণবিদ, লেখক। আফ্রিকার ধাঁচে ভারতে সাফারির নকশার অন্যতম পরিকল্পক।

প্রধানত রাজস্থানেই থাপরের কাজ। রণথম্ভোরের তদানীন্তন বনাধিকারিক ফতেহ্ সিংহ রাঠৌর ছিলেন তাঁর বাঘ-গুরু। রাঠৌরের সহায়তায় পশুদের পর্যবেক্ষণ করে থাপর বাঘবিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। পঞ্চাশ বছর আগে, থাপর তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ রণথম্ভোরে যখন পৌঁছন, তখন ছাপোষা এক স্টেশন থেকে তাঁকে টাঙ্গা চেপে গিয়ে হোটেলের মাকড়সার জালে ভরা ঘরে গিয়ে উঠতে হয়েছিল। আর আজকের রণথম্ভোরের বাইরে অগুনতি পাঁচতারা। সেই জৌলুসের গণ্ডি থেকে অল্প এগোলেই অন্ধকারের বাঘ-বিশ্ববিদ্যালয়।

এই প্রতিবেদকের সামান্য অভিজ্ঞতা বলে, এখানকার বাঘেরা কাছে যাওয়ার, বারে বারে, বহু ক্ষণ ধরে, তাদের সঙ্গলাভের সুযোগ দেয়। থাপর নিজে এখানে প্রথম বাঘ দেখেন আসার তিন সপ্তাহ পর, প্রথম ছবি তোলার সুযোগ আসে তিন মাস বাদে। তখন তো বাঘই দশ-পনেরোর বেশি নয়। সেই অবস্থান থেকে কী ভাবে এই শৃঙ্গে উঠে দাঁড়ানো গিয়েছে ইতিবৃত্ত আছে থাপরের বইগুলিতে। গ্রামের পর গ্রাম উঠিয়ে, মনুষ্যসংসর্গ মুক্ত করে বনের আয়তন চার গুণেরও বেশি বাড়ানো হয়েছে, প্রায় ১৭০০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত। একশোরও বেশি গ্রামকে বাঘ-শিল্প ও সংস্কৃতিতে যুক্ত করেছেন বল্মীক। পরিত্যক্ত গ্রামের স্কুলের দাওয়ায়, রাজাদের শিকার-ভিলার ধ্বংসস্তূপে যখন অশরীরীর মতো নিঃশব্দে আবির্ভূত হয় হলুদ ডোরাকাটা, হতবাক পর্যটককে তখন বিদ্যুতের চমকটি দেন সেই গ্রামেরই পূর্বতন বাসিন্দা, থাপরদেরই উদ্যোগে যিনি গাইডের কাজ করছেন। “বয়স্করা বলেন, শত্রুরা আক্রমণ করলে জলজহর উদ্‌যাপনে, রণথম্ভোরের দিঘিতে ঝাঁপ দেন বীর হাম্মীরের অন্তঃপুরিকারা। তাঁরাই বাঘ হয়ে ফিরেছেন। লক্ষ করুন কেমন রাজসিক রূপ!”

কী ভাবে চোরাশিকার, স্থানসঙ্কট, বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্বকে এড়িয়ে সংরক্ষণ এগোতে হবে, সেই নিয়ে আলোচনা করেছেন থাপর প্রায় পঞ্চাশটি বইতে। আকবর-জাহাঙ্গিরের শিকার-কৌশল, আবুল ফজ়ল, জেমস টডের বর্ণনা থেকে ব্রিটিশ আমলের বিদেশি শিকারির নথিবদ্ধ করা বাঘমুহূর্তের কথাকাব্য সব একত্র করেছেন। ইতিহাস আর বন্যপ্রাণের এই মেলবন্ধনের কারণেই রণথম্ভোরের বিশ্বজোড়া নামডাক। খ্যাতির উৎসে তো থাপরের ঝর্নাকলমের ভালবাসাও। গত দশকে এই লোকই কিন্তু দু’বার প্রবল ধিক্কারের মুখে পড়েছেন। উস্তাদ বাঘকে আজীবন কয়েদে রাখতে উদ্যোগী হলে থাপরকে তুলোধোনা করেন কিছু তথাকথিত পশুপ্রেমী। থাপর ঠান্ডা উত্তর দেন, উস্তাদ মানুষখেকো। সে সোজা চোখের দিকে তাকায়, যেন ছিঁড়ে খাবে।

তাঁর তেজ সমস্যায় ফেলে বর্তমান সরকারকেও। থাপর চিতা প্রত্যাবর্তনের বিরোধী। কিছুটা কৈলাস সাঙ্খালার (প্রোজেক্ট টাইগারের প্রাণপুরুষ) পদাঙ্ক অনুসরণে বলতেন, চিতা আর সিংহ অতীতে এখানে থাকত না। তাদের অন্য দেশ থেকে আনায় রাজপুরুষরা। ভারত বাঘের দেশ।

এর তাবড় ব্যাখ্যা রয়েছে তাঁর, রোমিলা থাপর ও ইউসুফ আনসারির একজোটে লেখা ইগজ়টিক এলিয়েনস: দ্য লায়ন অ্যান্ড চিতা ইন ইন্ডিয়া-য়। প্রভূত প্রমাণ দর্শিয়ে পিসি রোমিলা-র প্রশ্ন, “কচ্ছে সিংহ থাকলে, সিন্ধু সভ্যতায় তার প্রমাণ কই? আমার বিশ্বাস, আলেকজ়ান্ডারের কাছাকাছি সময়ে সিংহকে ভারতে আনা হয়।” ভাইপো বল্মীকের শ্লেষ, গুজরাত সরকার আচরণে জুনাগড়ের নবাব। সিংহ তাদের সম্পত্তি, অন্য প্রদেশ ভাগ পাবে না।

রণথম্ভোরে ছয় সাফারির মধ্যে মাত্র একটিতে বাঘ পাইনি, কিন্তু সেখানেই দেখেছিলাম এই বাঘপুরুষকে। জঙ্গলে বাঘের মতোই, স্বয়ং বল্মীক থাপরকে দেখার স্মৃতিও সম্মোহনী। মর্মভেদী দৃষ্টি, বৃষস্কন্ধ গাম্ভীর্য, শরীরের ওই গনগনে লাল রং সাধারণ মানুষের হতে পারে না! যে জল-জঙ্গলে বাঘের পাশাপাশি নির্ভীক তিনি হেঁটেছেন, সেখানে তাঁর প্রিয় বটবৃক্ষটি পেরিয়ে যোগীমহলের জানলায় বাঘ উঁকি দেওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণে, মহাকাল নিশ্চয় জঙ্গলের উপকথারই অংশ করে নেবে ব্যাঘ্রমানবের গাথা। ...এক থা টাইগার!

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Valmik Thapar Tigers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy