Advertisement
০৫ মে ২০২৪
First Apple Store in India

ভারতের বাজারে অ্যাপলের প্রবেশ কি মারুতি সুজ়ুকির মতো প্রভাব ফেলতে পারবে?

মোবাইল ফোন আর গাড়ি নির্মাণ শিল্প সমজাতীয় নয়। আর চল্লিশ বছর আগেকার জায়গায় অর্থনীতিও দাঁড়িয়ে নেই। ফলে সুজ়ুকির সাফল্য কি অ্যাপলের কাছ থেকে আশা করা যাবে?

Will Apple be as successful in Indian market as Suzuki did forty years ago

অ্যাপল কতটা সাফল্য পাবে ভারতে? — ফাইল চিত্র।

টি এন নাইনান
টি এন নাইনান
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৩০
Share: Save:

বাজার এবং উৎপাদনের ভিত্তি হিসাবে ভারতের প্রতি অ্যাপল-এর নজর খানিকটা দেরিতেই পড়েছে। চল্লিশ বছর আগে যখন সুজ়ুকি (মারুতি) ভারতের গাড়ির বাজারে আসে, তখনও কি তার প্রবেশ এমনই বিলম্বিত ছিল? এর উত্তরে হ্যাঁ অথবা না, দুই-ই বলা যায়, যদিও দু’টি ঘটনার প্রেক্ষিত এক নয়। সুজ়ুকি প্রবেশ করেছিল এক অতি ক্ষুদ্র গাড়ির বাজারে, যেখানে গাড়ির মডেল ছিল সাবেকি আর তাদের গুণগত মানও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। সংস্থা আশা করেছিল, কম দামে গাড়ি নিয়ে এসে তারা নাটকীয় ভাবে বাজারের সম্প্রসারণ ঘটাবে। কিন্তু আজ অ্যাপল যে বাজারে প্রবেশ করতে চলেছে, তা ইতিমধ্যেই মোবাইল ফোনের বৃহত্তম বাজার এবং সুজ়ুকির মতো তারা বাজারের শীর্ষস্থান দখলের লক্ষ্যও রাখেনি। সে কারণেই অ্যাপল তার মার্কেট শেয়ারের ইউনিট ৫ শতাংশের আশেপাশে রেখেছে, যা শেয়ারের ফেসভ্যালুর দিক থেকে দেখলে ১৮ শতাংশ দাঁড়াবে (সর্বোচ্চ স্থানে থাকে স্যামসাং-এর ২২ শতাংশের ঠিক পরেই)।

সরকারের অংশীদার হিসেবে ভারতে তার ব্যবসা শুরু করেছিল সুজ়ুকি এবং সেই সূত্রে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিল। একটি বড় সময়সীমা পর্যন্ত প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষাকবচ লাভ করেছিল। সে তুলনায় অ্যাপল ও তার সরবরাহকারী সংস্থাদের যে সব সুবিধা প্রদান করা হচ্ছে, সেই সব সুবিধা তাদের প্রতিযোগীদেরও দেওয়া হয়। সুজ়ুকি ভারতের বাজারে সেই সময়ের সাম্প্রতিকতম গাড়ি নিয়ে এসেছিল (পাশাপাশি কয়েকটি জাপানি সংস্থা একই সময়ে মোটরসাইকেল এবং মালবাহী গাড়ি নিয়ে এ দেশের বাজারে প্রবেশ করে) এবং সেই সময় থেকে ছোট গাড়ির বাজারে তারা প্রাধান্য পেয়ে আসছে। সে দিক থেকে দেখলে অ্যাপল এমন এক বাজারে আসতে চলেছে, যেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র এবং ইতিপূর্বেই সেই বাজার উন্নত গুণমানের এবং সব থেকে সস্তা পণ্যের সঙ্গে পরিচিত।

লক্ষণীয় এই যে, সুজ়ুকি তার সঙ্গে এক শ্রেণির জাপানি সংস্থাকে নিয়ে এসেছিল, যারা ভারতের বাজারে তাদের ব্যবসা শুরু করে এবং মারুতি গাড়ির জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ বা অন্য পণ্যের সরবরাহকারী হয়ে ওঠে। এর ফলে ভারতের মোটরগাড়ি শিল্পের সহযোগী শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতার অংশীদার হয়ে ওঠে। সেই সময় থেকেই গাড়ি নির্মাণ কারখানাগুলি আসলে হয়ে দাঁড়ায় যন্ত্রাংশ জোড়া লাগানোর কারখানা। যে ‘ভেন্ডার ইকোসিস্টেম’ বা সহযোগী সংস্থার পরস্পর-নির্ভর ব্যবস্থা সুজ়ুকি গড়ে তুলেছিল, তা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় এ দেশের ইস্পাত উৎপাদন শিল্পও, যারা ডিপ-ড্রইং স্টিলের মতো বিশেষ ধরনের ইস্পাত নির্মাণ শুরু করতে বাধ্য হয়।

যদি ভারত সত্যিই মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশ তৈরি এবং তা ‘সাব-অ্যাসেম্বলিং’-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়, অ্যাপল তবে অবশ্যই সুজ়ুকি-র মতো অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারবে। কিন্তু নীতিগত দু’টি বিষয়কে (উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ইনসেন্টিভ এবং শুল্ক প্রদানের রক্ষাকবচ, যা নিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই আপত্তি জানিয়ে রেখেছে) একই সঙ্গে অবস্থান করতে হবে। তেমন ক্ষেত্রে কি ভারত থেকে বিদেশে মোবাইল ফোন রফতানির ক্রমবর্ধমান ব্যবসা অব্যাহত এবং অপরিবর্তিত থেকে যাবে? এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

দ্বিতীয় গুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি এই যে, সুজ়ুকি-র সময় বিশ্বের অন্যান্য গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলি ভারতের দিকে লক্ষ্য রাখছিল। ভারতে গাড়ির বাজারের বিস্তার ঘটলে তারা একে একে সুজ়ুকি-র পদাঙ্ক অনুসরণ করে। এর ফল অবশ্য বিভিন্ন রকমের হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এর ফলে গাড়ির বাজারে দু’টি ভারতীয় উদ্যোগ এবং মোটরসাইকেলের বাজারে তিনটি ভারতীয় সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে শুরু করে। এখন মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রেও কি তেমনটা ঘটবে? ইতিমধ্যেই স্যামসাং ভারতের বাজারকে তেমন সুবিধাজনক মনে না করায় ভিয়েতনামের দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু দিল্লির কাছেই তাদের একটি উৎপাদনকেন্দ্র রয়েছে। প্রশ্ন হল, তারা কি এই উৎপাদনকেন্দ্রের সম্প্রসারণ ঘটাবে, বিশেষ করে যে দেশের বাজারে তাদের টেলিভিশন সেট এবং অন্যান্য ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তর চাহিদা রয়েছে?

ভারতের বাজারে অ্যাপল-এর সাফল্যের পরিমাণ নির্ভর করবে নিছক একটি ফোন-নির্মাণকারী সংস্থা হিসাবে নয়, বরং স্যামসাং-এর মতো ভোগ্যপণ্যের বৈচিত্র বাড়ানোর উপরে, তাদের উৎপাদিত সম্পূর্ণ পণ্যতালিকার উপরে। সেই লক্ষ্য স্থির রাখলেই তারা ভারতের বাজারে লক্ষ লক্ষ ল্যাপটপ, ট্যাবলেট এবং ঘড়ি বিক্রি করতে সমর্থ হবে, ভারত তাদের গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন ক্ষেত্র তথা অ্যাসেম্বলিং ইউনিটে পরিণত হবে। উদাহরণ হিসেবে প্রশ্ন তোলাই যায়, টাটা কি ভারতের ফক্সকন অথবা রিস্ট্রনের চাইতেও ভাল অবস্থায় পৌঁছতে পারেনি? অথবা ভারত তার নমনীয় শ্রমনীতি এবং দক্ষ উৎপাদন নিয়ে জগৎসভায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করতে কি সমর্থ হবে? এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় অবশ্য এখনও আসেনি।

দু’টি বিষয়ে দক্ষতার স্বীকৃতি এ ক্ষেত্রে অপেক্ষা করছে। প্রথমটি এই যে, যখন ভারতে একটি গাড়ি এবং তার যন্ত্রাংশ তৈরি হয়, দেশ জুড়ে তার ‘ভ্যালু চেন’ (কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে উৎপাদন, বিপণন, ভোগ এবং পুনর্নবীকরণের শৃঙ্খলা)-ও গড়ে ওঠে। কিন্তু মোবাইল ফোনের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে বিষয়টি এক রকম নয়। মোবাইল ফোনের উৎপাদন ব্যয় তার বাজারমূল্যের তুলনায় অনেকটাই কম। তা ছাড়া, অ্যাপল-এর ভ্যালু চেন-এর বৃহদাংশ আমেরিকায় অবস্থান করছে। এবং দ্বিতীয় বিষয়টি এই, যদিও অ্যাপল-এর সিইও ভারতে সংস্থার বর্তমান কর্মীসংখ্যা এক লক্ষ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ বা তিনগুণ করার কথা বলেছেন, তবুও এই পর্যায়ে ভারতে বৈদ্যুতিন পণ্য উৎপাদন/ অ্যাসেম্বলিং শিল্প গাড়ি নির্মাণ শিল্পের মতো নিয়োগ-নিবিড় বা ভ্যালু চেন তৈরির উপযোগী হয়ে উঠবে, এমন আশা করাই যায় না। তবুও, এই মুহূর্তে বৈদ্যুতিন শিল্পের অ্যাসেম্বলিং এবং রফতানি আশাব্যঞ্জক জায়গায় রয়েছে। এ থেকে বৃহত্তর কিছু ঘটতে পারে, এমন আশাও রাখা যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Apple Suzuki Indian Econmy Indian Industry
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE