মেয়েদের ক্ষমতায়নের জন্য যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দরকার, তা নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আসবে কী ভাবে? প্রথমেই মনে আসে, মেয়েরা অনেক বেশি করে বাইরের কাজে যুক্ত হবেন, যে কাজ থেকে রোজগার হয়। ভারতে মেয়েদের কাজের বাজারে যোগদানের তথ্য সম্প্রতি কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি করেছে। ২০১৭-১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে কাজে যোগদানের হার ছিল ২৩.৩%, যা অধিকাংশ দেশের তুলনায় খুবই কম। তা-ই নয়, ২০০৫ থেকে তা কমেছে। অথচ ২০২৩-২৪’এ দেখা যাচ্ছে তা বেড়ে হয়েছে ৪১.৭%। এতটা বৃদ্ধি অবিশ্বাস্য। আসলে, এই বৃদ্ধির প্রায় সবটাই হয়েছে ‘গৃহ উদ্যোগ’-এ, যার মধ্যে কৃষিকাজ অনেকটা, যা থেকে পরিবারের মহিলা সদস্যের হাতে কোনও নির্দিষ্ট আয় আসে না— পরিভাষায় যাকে বলে ‘আনপেড ফ্যামিলি লেবার’। ও-দিকে আমেরিকায় মহিলাদের কাজে যোগদানের হার ৫৬.৫%, ইংল্যান্ডে ৫৭.৩%, সুইৎজ়ারল্যান্ডে ৬২%, সুইডেনে ৬১.৭%, জাপানে ৫৫.৩%, চিনে ৫৯.৬%। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এই হার ৫০ থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে।
মেয়েদের অর্থনৈতিক অধিকার কায়েমের দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে সরাসরি নগদ হস্তান্তর, বহু দেশে যা প্রচলিত ও জনপ্রিয়। ব্রাজ়িল, ইকোয়েডর, জ়াম্বিয়ায় এ রকম প্রকল্প শুরু হয়েছে ২০০৩-এ, মেক্সিকোতে চলছে ১৯৯৭ থেকে। এই প্রকল্পগুলির কোনওটি শর্তাধীন, কোনওটা নিঃশর্ত। শর্ত থাকলে, টাকা হাতে পেতে গেলে সেই শর্ত পূরণ করতে হবে। যেমন, সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে হবে ইত্যাদি। দেখা গেছে এই প্রকল্পগুলির ফলে পারিবারিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটা বেড়েছে। এ ছাড়া কিছু গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, মহিলাদের হাতে অর্থ এলে তাঁরা বেশির ভাগটাই খরচ করেন তাঁদের পরিবার ও সন্তানের মঙ্গলের জন্য, যেটা পুরুষরা অনেক সময়েই করেন না। হস্তান্তরের টাকা সাধারণত পাঠানো হয় মেয়েদের নিজস্ব ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। এর ফলে ব্যাঙ্কের কাজকর্মের বিষয়েও মহিলারা অবহিত হন, বাড়ির বাইরে তাঁদের গতিবিধি বাড়ে।
নানা গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, এর ফলে মহিলাদের কাজে যোগদানের উৎসাহও বৃদ্ধি পায়। মধ্যপ্রদেশে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে শুরুর দিকে যখন মজুরির টাকা বাড়ির পুরুষদের হাতে দেওয়া হত, তখন একটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। দু’টি দলে উপভোক্তাদের ভাগ করে নেওয়া হয় প্রথমে— এক ভাগের ক্ষেত্রে প্রকল্পের টাকাটা শুধু মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানো হত; আর অন্য ভাগে পুরুষকর্তার অ্যাকাউন্টে। কয়েক বছর পর দেখা গেল, যে মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হত, সেই মহিলারা আরও বেশি করে কাজ খুঁজতে শুরু করলেন। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, দেখা গেল সে-সব বাড়ির পুরুষকর্তারাও নারীদের কাজে যোগ দেওয়াটা সমর্থন করতে থাকলেন অন্যদের তুলনায় বেশি। যত বেশি সংখ্যক মহিলা কাজের জগতে পা রাখবেন, সামাজিক বাধাগুলি তত কমতে থাকবে।
আমেরিকার মতো উন্নত দেশেও বিবাহিত মেয়েদের কর্মনিযুক্তির হার কমে গিয়েছিল ১৮৩০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যে। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণা থেকে পাচ্ছি যে, ১৭৯০-এ আমেরিকায় ৬০% মহিলা কর্মরত ছিলেন। উনিশ এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে এই হার খুব দ্রুত কমতে থাকে। আবার ১৯৩০ থেকে এই হার বাড়তে থাকে, কারণ মহামন্দার ফলে বেঁচে থাকার তাগিদেই মেয়েরা চাকরি খুঁজতে বাধ্য হলেন। ১৯৪১-এর শুরুতে আরও বেশি করে মহিলারা কর্মরত হতে থাকলেন, কারণ বাড়ির পুরুষরা তখন যুদ্ধে গিয়েছেন। এই সময় থেকে আমেরিকার সরকার মেয়েদের কলকারখানার মতো ক্ষেত্রে নিয়োগ করতে শুরু করল, যা আগে শুধুমাত্র পুরুষদের ক্ষেত্র ছিল। নারী-স্বাধীনতার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ল ১৯৫০ থেকে, যা আরও বৃহৎ আকার ধারণ করল ১৯৬০-এ কিছু সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ক্লডিয়া গোল্ডিন বলে থাকেন, মেয়েরা বেশি বেশি করে কর্মে নিযুক্ত হবেন এটাই কাম্য, কিন্তু তার জন্য সব দেশে মহামন্দা বা বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির হয়তো দরকার নেই।
আমেরিকায় দেখা গিয়েছে যে, মেয়েরা যত বেশি শিক্ষিত হয়েছেন, তাঁদের কর্মজগতে প্রবেশের হারও তত বেড়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের শহরাঞ্চলে মেয়েরা শিক্ষিত হয়েও কর্মজগতে প্রবেশ করছেন না। এর দু’টি কারণ— মজুরি কম; এবং, দরকষাকষির আপেক্ষিক ক্ষমতা কম। সাধারণত দেখা যায়, শিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে তাঁদের চেয়ে বেশি শিক্ষিত পুরুষদের সঙ্গে। এই স্বামীদের রোজগার সচরাচর পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর পক্ষে যথেষ্ট, এবং তাঁদের স্ত্রীরা পছন্দসই কাজ না পেলে বাইরের কাজ নেন না। এই মহিলারা অনেকে সন্তানদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বেশি নজর দেওয়ার দায়িত্বের কথা বলেন, কম আয়ের বাইরের কাজ নিলে তা সুষ্ঠুভাবে হয় না এমনই মনে করেন। অন্য দিকে, গ্রামের মেয়েদের মধ্যে সামাজিক প্রথাগত বাধার ভূমিকাটি প্রধান। কাউকে হয়তো বাড়ির কাজ করতে হয় অনেক বেশি, যেমন সন্তান বা বয়স্কদের দেখাশোনার প্রধান দায়িত্বটাই থাকে বাড়ির মহিলাদের উপরে। আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্বামীরা মনে করেন যে, স্ত্রী বাইরে কাজ করতে গেলে অন্যরা মনে করবে তিনি স্ত্রীর ভরণপোষণ করতে পারেন না, যা সামাজিক দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রামাঞ্চলে কৃষির বাইরে মহিলাদের অন্য কাজের সুযোগও অনেক কম।
কাজের বাজারের চিন্তা থেকে সরে বর্তমানে মহিলাদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উপরে জোর দেওয়া হচ্ছে খুব। ফলাও করে জানানো হচ্ছে যে, ভারতে এই মুহূর্তে নারী ও পুরুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকার হার প্রায় সমান। প্রধানমন্ত্রী জনধন যোজনার ফলে মেয়েদের অ্যাকাউন্ট ৩৫% থেকে বেড়ে ৮০% হয়েছে ২০১১ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ সব অ্যাকাউন্টের ৪৩% ব্যবহার হয় না আদৌ। তাই শুধুমাত্র অ্যাকাউন্ট খুলে দিলেই মেয়েরা বেশি করে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ব্যবহার করবেন, এটা ঠিক নয়। এর জন্য প্রয়োজন মেয়েদের নিজস্ব আয় ও সম্পদের মালিকানা। মেয়েদের হাতে সম্পদের মালিকানা থাকলে পরিবারে মেয়েদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বেড়ে যায়, সঞ্চয়ের উৎসাহ জাগে। এই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব হবে যদি তা আইন-সমর্থিত হয়, যেমন জমিতে মহিলাদের মালিকানা।
অর্থাৎ, মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়ে সরকারের দু’টি সাম্প্রতিক দাবি— কর্মনিযুক্তি, এবং ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তি’ দুই-ই বেড়েছে— তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে, সেগুলি যথাযথ নয়। খাতায়-কলমে কর্মনিযুক্তি বাড়লেও তার বেশির ভাগটা ‘আনপেড ফ্যামিলি লেবার’, আর মহিলাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বাড়লেও তার প্রায় অর্ধেক ব্যবহৃত হয় না। তাই মনে হয়, সরকার যা করছে, তার সঙ্গে পরিবারের অন্দরে বণ্টনের কথাটিও বার বার আনতে হবে। এর জন্য বাড়ির পুরুষদের রোজগারের একটা অংশ বাড়ির মাহিলাদের হাতে তুলে দেওয়া দরকার, যা তাঁরা ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারেন। পারিবারিক উদ্যোগে ‘আনপেড লেবার’ হোক বা গৃহস্থালির কাজ হোক, মহিলাদের শ্রমের যথাযথ মূল্য যে মহিলাদের হাতে যেতে হবে, এই কথাটি হালকা করে দেখলে চলবে না।
খরচ করার স্বাধীনতা মহিলাদের হাতে থাকলে পারিবারিক ও সামাজিক মঙ্গল কী কী হতে পারে, তা গবেষণা থেকে স্পষ্ট। আরও যা যোগ করা যায় তা হল, এর ফলে স্বামীরা তাঁদের স্ত্রীদের বাইরে কাজ করতে বিশেষ বাধা আর দেবেন না হয়তো, কারণ স্ত্রী যদি বাইরে থেকে রোজগার করেন তা হলে আর স্বামীর রোজগার থেকে ভাগ দিতে হবে না। অন্য দিকে, গৃহস্থালির কাজেও মহিলার দরকষাকষির সুযোগ বাড়বে। এর ফলে আরও বেশি করে মহিলারা কর্মে নিযুক্ত হবেন। এই সম্ভাবনাটি ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’-এর মতো সরকারি নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের ক্ষেত্রে তেমন নেই। তবে এদের একে অপরের বিকল্প হিসাবে না দেখে পরস্পরের পরিপূরক হিসাবেই দেখতে হবে।
ইনস্টিটিউট অব ইকনমিক গ্রোথ, দিল্লি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)