Advertisement
১০ মে ২০২৪
Farm Bill

রাষ্ট্র ও প্রতিবাদী

বিক্ষোভরত কৃষকরা যে দাবি করিতেছেন, তাহা পূরণ করা ভারতীয় শাসকদের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন।

—ফাইল চিত্র

—ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২১ ০১:০৬
Share: Save:

এখনও অবধি ষাট জনেরও অধিক বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হইয়াছে। তাঁহাদের মধ্যে এক জনও পুলিশের গুলিতে মারা যান নাই, তাহা সত্য। উত্তর ভারতের হাড় হিম করা ঠান্ডায় পুলিশ জলকামান ব্যবহার করিয়াছে, কিন্তু গুলি চালায় নাই। বিক্ষোভস্থলের মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলিতে কর্মরত চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা জানাইয়াছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ চরম আবহাওয়া, অথবা বিক্ষোভের প্রবল ধকল সহ্য করিতে না পারা। তবে কি এই মৃত্যুগুলির দায় মৃতদেরই, অথবা বৃহত্তর অর্থে, বিক্ষোভকারীদের— কতখানি সহ্য করিতে পারিবেন, তাহা না ভাবিয়াই অবিমৃশ্যকারী আন্দোলনে জড়াইয়া পড়িবার ফল এই করুণ পরিণতি? কেন্দ্রীয় সরকারের, বা প্রধানমন্ত্রীর উপর কোনও দায়ই কি তবে বর্তায় না? এই প্রশ্নটির উত্তর সম্ভবত কেন্দ্রীয় কর্তারা জানেন— এবং, জানেন বলিয়াই এই মৃত্যু-মিছিল বিষয়ে একটি শব্দও তাঁহারা উচ্চারণ করেন নাই। তাঁহারা জানেন, মৃত্যুর আপাত-কারণ যাহাই হউক না কেন, প্রকৃত কারণ রাষ্ট্রীয় নির্মমতা। অস্বীকার করিবার উপায় নাই, ২০১৯ সালের শীতে যখন শাহিন বাগে নয়া নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী বিক্ষোভ চলিতেছিল, তখনও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নির্মমতার অভিযোগ উঠিয়াছিল। সৌভাগ্যক্রমে শীত সত্ত্বেও সেই বারের বিক্ষোভে এত প্রাণহানি হয় নাই। কিন্তু, প্রতিবাদী নাগরিক আন্দোলনের সম্মুখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনাধীন রাষ্ট্রযন্ত্র কেমন আচরণ করে, দুই বৎসরের দুইটি ঘটনায় তাহা স্পষ্ট।

বিক্ষোভরত কৃষকরা যে দাবি করিতেছেন, তাহা পূরণ করা ভারতীয় শাসকদের পক্ষে আদৌ সম্ভব কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন। আন্দোলন চরম সীমায় পৌঁছাইলেই যদি সরকার নতিস্বীকার করে, তবে তাহা একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে কি না, সেই প্রশ্নটিও থাকে। কিন্তু, যাঁহারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতেছেন— শান্তিপূর্ণ পথে, এক বারও হিংসার আশ্রয় না লইয়া— তাঁহারা এই রাষ্ট্রেরই নাগরিক, রাষ্ট্রের শত্রুপক্ষ নহেন। সুতরাং, নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের যাহা কর্তব্য, প্রতিবাদী নাগরিকের প্রতিও রাষ্ট্রকে সেই কর্তব্য সম্পাদন করিতে হইবে। তাঁহাদের নিরাপত্তা বিধান করিতে হইবে, তাঁহাদের বাক্‌স্বাধীনতা নিশ্চিত করিতে হইবে। জানুয়ারির বৃষ্টিতে প্রতিবাদকারীরা ভিজিলে তাঁহাদের জন্য আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য— তাঁহাদের বিপন্নতায় উল্লসিত হওয়া নহে। এবং, একই সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানসূত্রে পৌঁছাইবার চেষ্টা অব্যাহত রাখিতে হইবে। আন্দোলনকারীদের সব দাবি মানিতে হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নাই— এমনকি, একটিও দাবি না মানাও যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য বিকল্প— কিন্তু, সেই অবস্থানে পৌঁছাইতে হইবে আলোচনার মাধ্যমে, সম্মতি নির্মাণের প্রক্রিয়ার দ্বারা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের উপর গায়ের জোরে সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দেওয়া চলে না।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সহিত অহিংস পথে আন্দোলনকারী নাগরিকের সম্পর্ক কেমন হওয়া বিধেয়, আশঙ্কা হয়, সে বিষয়ে বর্তমান শাসকদের ধারণা খুব স্পষ্ট নহে। নাগরিক সংজ্ঞাগত ভাবেই রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ— অর্থাৎ, তাঁহারা আত্মজন, ‘অপর’ নহেন, বহিরাগত শত্রু নহেন। তাঁহাদের দমন করিবার অর্থ, রাষ্ট্রকেই আহত করা। সরকার সেই কাজটি করিতে পারে না। আবার, রাষ্ট্রের ভূমিকা নাগরিকের অভিভাবকেরও নহে— তাঁহারা নাগরিক, প্রজা নহেন। অভিভাবকসুলভ খবরদারি বা শাসনের মাধ্যমেও নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করা গণতন্ত্রে অসিদ্ধ। তাহা হইলে, রাষ্ট্র ও প্রতিবাদী নাগরিকের সম্পর্কটি ঠিক কেমন হওয়া বিধেয়? নাগরিকের ‘এজেন্সি’ শাসকদের স্বীকার করিতে হইবে, এবং মানিতে হইবে, তাঁহারা যে দাবি করিতেছেন, তাহাও রাষ্ট্রের উন্নতিকল্পেই। নাগরিকদের বাদ রাখিয়া রাষ্ট্রের অবয়ব গঠিত হয় না। নরেন্দ্র মোদীরা দৃশ্যত এই কথাটি বুঝিতে ব্যর্থ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Farmers Protest North India Farm Bill
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE