Advertisement
E-Paper

পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন

অভিরূপ সরকার (‘সন্ত্রাসের পাশাপাশি...’, ৫-১) দাবি করেছেন, তৃণমূল সরকারের আমলে অনস্বীকার্য এবং দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে এবং মানুষও তাই ধারাবাহিক ভাবে ভোট দিয়ে এই সরকারকে সমর্থন করছেন।

শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৬ ০০:০৯

অভিরূপ সরকার (‘সন্ত্রাসের পাশাপাশি...’, ৫-১) দাবি করেছেন, তৃণমূল সরকারের আমলে অনস্বীকার্য এবং দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে এবং মানুষও তাই ধারাবাহিক ভাবে ভোট দিয়ে এই সরকারকে সমর্থন করছেন। সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অর্গানাইজেশন (সিএসও) নামক কেন্দ্রীয় সংস্থার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নাকি কিছু ক্ষেত্রে বামফ্রন্টের জমানা থেকে তৃণমূল জমানার বৃদ্ধির হার বেশি।

অভিরূপবাবুর পরিসংখ্যান নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। তাঁর ব্যবহৃত তথ্যগুলি অনেকাংশে না সিএসও-র নিজস্ব পরিসংখ্যান, না সেগুলো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। বিশেষত, সিএসও কবে থেকে কৃষির তথ্য পেশ করা শুরু করল তা ঠিক জানা নেই। রাজ্য সরকারের অধীনে ব্যুরো অব অ্যাপ্লায়েড ইকনমিক্স অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিকস ও রাজ্য সরকারের কৃষি বিভাগই কৃষির তথ্য সংগ্রহ করে এসেছে। সাম্প্রতিক কালে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন ও তথ্য বিকৃতির গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, সেটাও স্মরণীয়। আগে প্রত্যেক বছর রাজ্য বাজেটের সঙ্গে আর্থিক সমীক্ষা ও পরিসংখ্যান পরিশিষ্ট প্রকাশিত হত। সেখানে রাজ্য সরকারের তরফে সমস্ত রকম তথ্য দেওয়া হত, যা ছাত্র ও গবেষকদের খুবই কাজে লাগত। তৃণমূল সরকার পরিসংখ্যান পরিশিষ্ট প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। অনেকেরই মতে, সরকারের তথ্য গোপনের অভিপ্রায় না থাকলে তা বন্ধ করার কোনও কারণ নেই। অনুরূপ ভাবে রাজ্য সরকারের তরফে কোনও কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা স্বীকার করা হয়নি এবং জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোকে এই সংক্রান্ত তথ্য পাঠানো হয়নি। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিমাংশু দেখিয়েছেন, কৃষক আত্মহত্যার দায় ঝেড়ে ফেলার সব থেকে বড় অস্ত্র হল স্বনিযুক্ত কৃষকের আত্মহত্যাকে কৃষিশ্রমিকের আত্মহত্যা হিসাবে দেখিয়ে দেওয়া। হিমাংশু দেখিয়েছেন, শুধুমাত্র ২০১৪-তেই তথাকথিত ২৩০ জন ‘কৃষিশ্রমিক’ আত্মহত্যা করেছেন পশ্চিমবঙ্গে অথচ কোনও কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেনি। অনেকেরই মতে, রাজ্য সরকারের ভ্রান্ত বিপণন নীতির জন্য কৃষকরা, বিশেষত আলুচাষিরা ফসলের দাম না-পেয়ে দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেছেন।

এ বার আসা যাক, অভিরূপবাবুর পেশ করা বৃদ্ধির হিসেবে। পণ্ডিতমহলের মতে, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে কৃষি ও পঞ্চায়েতরাজ-নির্ভর উন্নয়ন ঘটে, যা অভিরূপবাবুও তাঁর লেখার গোড়াতে স্বীকার করেছেন। এই উন্নয়ন প্রক্রিয়া বিরাট ভাবে ধাক্কা খায় ২০০৮-এ যখন বামেরা নীচের তলার বিরাটসংখ্যক পঞ্চায়েত আসনে হেরে বসে এবং তার দখল নেয় বিরোধী দল। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু নেত্রীর নির্দেশে তখন বিরোধী দলের প্রতিনিধিরা জেলা ও রাজ্য স্তরের সমস্ত রকম প্রশাসনিক মিটিং বয়কট করতেন। ঠিক যে ভাবে তাঁরা বিধানসভা ভাঙচুর ও পরে বয়কট করেছিলেন। যার ফলে ওই সময় থেকেই প্রশাসনের সঙ্গে পঞ্চায়েতের একটা দূরত্ব তৈরি হতে থাকে, যার কুফল সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াতেও প্রতিফলিত হয়। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের থেকে তাই ২০০৮-০৯ থেকে ২০১০-১১, এই তিন বছর বাদ দিয়ে অন্য জমানার সঙ্গে তুলনা করা উচিত। সেই হিসেবে বর্তমান পত্রলেখক তাঁর গবেষক ছাত্র রাজীব কাজির সঙ্গে যৌথ ভাবে অভিরূপবাবুর কৃষির তথ্য যাচাই করেছেন। কোনও বিশেষ সালে এসে মূল ধারার বৃদ্ধিতে কোনও পরিবর্তন এসেছে কি না, তা যাচাই করার সঠিক ও শ্রেষ্ঠ উপায় কিংকর্ড এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথ যা জেমস বয়েস তাঁর পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কৃষি নিয়ে প্রামাণ্য গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। ২০০১ থেকে টানা পরিসংখ্যান ও ২০০৮ ও ২০১১-য় দুটি কিংক নিয়ে দেখা যাচ্ছে ২০০১-০২ থেকে ২০০৭-০৮ অবধি শতকরা বার্ষিক কৃষিবৃদ্ধির হার ছিল ৪.২১ যা ২০০৮-০৯ থেকে ২০১০-১১-তে নেমে হয় ১.১৩ এবং তৃণমূল আমলে ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫’য় তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩.০৮ হলেও তা বামফ্রন্টের ২০০৭-০৮-এর আগের বছরগুলির থেকে কম।

কিন্তু সব কিছুর পরেও অভিরূপবাবুকে স্বীকার করতে হয়েছে উৎপাদন শিল্পে তৃণমূল আমলে বৃদ্ধি নেমেছে এবং তা বামফ্রন্টের শেষ তিন বছরের নীচে। এই তথ্য কেন্দ্রীয় সংস্থা সিএসও-র তৈরি। উৎপাদন শিল্পে তৃণমূল আমলের এই অবনমন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অভিরূপবাবু বলেছেন অনথিবদ্ধ উৎপাদন শিল্প বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের কথা, যার বৃদ্ধি তৃণমূল আমলে বেশি। প্রথম কথা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের এই বিকাশ আসলে কর্মসংস্থান বা উন্নয়নের কোনও লাভজনক বা গুণগত বিস্তার ঘটায় না। আমি সংগঠিত ক্ষেত্রে কোনও কাজ না-পেয়ে ফুটপাথে চপ আর তেলেভাজা বিক্রি করতে বসলাম, এটা কখনওই কোনও উন্নতি হতে পারে না। অসংগঠিতকরণের আর এক নাম দারিদ্রায়ণ।

অভিরূপবাবু মন্তব্য করেছেন, তৃণমূল সরকারের আমলে বিডিও, এসডিও, ডিএম-রা তৃণমূল স্তরের উন্নয়নের জন্য সরাসরি দায়বদ্ধ হয়ে পড়লেন খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। এক দিকে এই প্রশাসনিক ব্যক্তিদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া হল, অন্য দিকে বাড়ল এঁদের দায়বদ্ধতাও। বামফ্রন্টের আমলে কৃষি তথা গ্রামীণ উন্নয়নের মূল অক্ষ ছিল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। বর্তমান তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় ও নির্মল মুখার্জি কর্তৃক গঠিত কমিটি পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে দেওয়ালের মতো খাড়া হয়ে থাকা আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনে সামনের থেকে সরাসরি প্রত্যাঘাত বলে মত দিয়েছিলেন।

বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ প্রশাসনের ইতিহাসে গ্রামোন্নয়ন ও কৃষি অগ্রগতিতে পঞ্চায়েত রাজের নেতৃত্বের সফলতার কথা নিন্দুকেরাও অস্বীকার করতে পারেননি। আর পঞ্চায়েত রাজ শুধু পশ্চিমবঙ্গের ব্যাপার নয়। এটা ১৯৯৩ সালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে উপর থেকে চাপানো সরকারি আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের সমান্তরালে গ্রামের মানুষকে তার গ্রাম মহকুমা ও জেলা প্রশাসনকে নেতৃত্ব দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১৩ সালের নির্বাচনে পঞ্চায়েতের সমস্ত দখল সম্পূর্ণ করেও এই অবস্থানে বহাল রইলেন যে, পঞ্চায়েতকে আমলাতন্ত্রের অধীন হয়ে কাজ করতে হবে।

সুদীপ্ত ভট্টাচার্য। শিক্ষক অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি বিভাগ, অধিকর্তা অ্যাগ্রোইকনমিক রিসার্চ সেন্টার, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন

economy west bengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy