Advertisement
E-Paper

পদক জয়ের বিলিতি শিক্ষা

দেখতে দেখতে অলিম্পিকের পদক তালিকায় ব্রিটেন উঠে এসেছে দু’নম্বরে। গত দু’দশকে কী এমন ঘটল সেখানে, যাতে চিনেরও ঘাম ছুটে যেতে পারে?১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আটলান্টা অলিম্পিকে টিম জিবি-র (ব্রিটেন ও নর্দান আয়ার্ল্যান্ড) স্থান ছিল ৩৬— সে দেশের অলিম্পিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন, মাত্র একটা সোনা। এ হেন হেরো টিমের গ্রাফ তার পর থেকে শুধুই ঊর্ধ্বমুখী।

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
অভিবাদন। দেশে ফিরল ব্রিটিশ অলিম্পিক দল। এএফপি

অভিবাদন। দেশে ফিরল ব্রিটিশ অলিম্পিক দল। এএফপি

১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আটলান্টা অলিম্পিকে টিম জিবি-র (ব্রিটেন ও নর্দান আয়ার্ল্যান্ড) স্থান ছিল ৩৬— সে দেশের অলিম্পিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন, মাত্র একটা সোনা। এ হেন হেরো টিমের গ্রাফ তার পর থেকে শুধুই ঊর্ধ্বমুখী। গত তিন বারের অলিম্পিকে, বেজিংয়ে (২০০৮), লন্ডনে (২০১২) ও এ বছরের রিও ডি জেনেইরোতে ব্রিটেন যথাক্রমে চতুর্থ, তৃতীয় ও দ্বিতীয়। এ হেন সাফল্যে শুধু খেলার জগৎ নয়, তার বাইরেও সকলের তাক লেগে যাবারই কথা, হয়েছেও তাই। রাশিয়া, চিন, উত্তর কোরিয়া মায় অস্ট্রেলিয়ার পদক জেতার গল্প তো আমরা শুনেছি। তা বলে টিম জিবি! স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে, বিলেতে গত দু’দশকে কী এমন ঘটল, যাতে চিনেরও ঘাম ছুটে যেতে পারে?

প্রথম কথা হল, চমকে দেওয়ার মতো যা-ই ঘটুক, তা কিন্তু মোটেই হঠাৎ হয়নি। জীবনের নানা ক্ষেত্রের মতো এই সাফল্যের কাহিনির পিছনেও সুপরিকল্পনা। মেডেলগুলো কষ্টার্জিত তো বটেই, তবে তা অর্জনের জন্যে এই পরিকল্পনাটাই আক্ষরিক অর্থেই অভূতপূর্ব ও অভাবনীয়— যা আগে কেউ করেনি, ভাবেওনি। মেডেল জেতার কিছু সাবেকি মডেল আছে। নিজের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করানো থেকে আরম্ভ করে অফিসে বস্‌ হিসেবে অধস্তন কর্মীদের থেকে কাজ বার করে নেওয়া, এমনকী টি-২০-র ম্যাচ জেতানোর জন্যেও হামেশাই আমরা এগুলো ব্যবহার করি। প্রোদুনোভার মঞ্চও তাই এর ব্যতিক্রম নয়। যেমন, ভারতের মতো পুরস্কারের বন্দোবস্ত: প্রচুর টাকা, জমি, ফ্ল্যাট ইত্যাদি পুরস্কার এবং অর্জুন, খেলরত্ন-র মতো নানাবিধ সম্মান গাজর হিসেবে ঝুলিয়ে দাও খেলোয়াড়দের চোখের ঠিক সামনে। খেলোয়াড় আরও জোরে ছুটবে, আপসে পদক আসবে। অথবা, উত্তর কোরিয়ার মতো শাস্তির বিধান: পদক জিততে না পারলেই বেত্রাঘাত, চাকরি চলে যাবে— এমত শাস্তি। অতএব, সেই ভয়েই খেলোয়াড় আরও জোরে লাফাবে, পদক আসবে। কিংবা, চিন, জাপানের মতো এই দুইয়ের মিশ্রণ— পুরস্কার ও শাস্তির যৌথ নিদান। এর বাইরেও অবশ্য এক চিরাচরিত মডেল আছে, যাতে আমরা বাঙালিরা অতীব দড়, তবে এর সাম্প্রতিক সাফল্যের জন্যে মার্ক জুকেরবার্গ নামক এক ব্যক্তির কৃতিত্বই বেশি— মুখে ও আঙুলেই মারিতং জগৎ। ছেলেরা বেশি দক্ষ না মেয়েরা, এ জাতীয় নানাবিধ তর্ক জুড়লেই যেন পদক মেলে।

তা বিলেত কী এমন আলাদা কাজ করল? গল্পটা পুরোপুরি আলাদা, কারণ সেখানে অনুসৃত প্রকল্পে চ্যাম্পিয়ান গড়াটা উদ্দেশ্যই নয়। খেলায় যোগদানটাই জরুরি, জেতা নয়। লক্ষ্য হল: চ্যাম্পিয়ান নয়, খেলোয়াড় তৈরি হোক। তত্ত্বটা নতুন নয়। প্রাচীন যুগে গ্রিস থেকে ভারত, সর্বত্রই এই ধারণা প্রচলিত ছিল। তবে আধুনিক চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিটা বিলেতে নয়া আর সাবেকি পুরস্কার ও শাস্তির মডেল থেকে একেবারেই ভিন্ন জাতের। গত দুই দশকে বিলেতে স্পোর্টস মানেই, আক্ষরিক অর্থে বাল্য থেকে শুরু করে বৃদ্ধ ও বনিতা, সকলের জন্য। নানা ভাবে সকলকে কোনও না কোনও খেলায় অংশ নিতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সমস্ত নাগরিকই যাতে নিজের নিজের পছন্দসই কোনও খেলায় যোগ দিতে পারেন, সে জন্যে গ্রামে গ্রামে, শহরের পাড়ায় পাড়ায় নানাবিধ আয়োজন করা হয়েছে— ইন্ডোর হল, সুইমিং পুল, খেলার পার্ক সাজানো হয়েছে নানান সরঞ্জাম সহযোগে। কোনও খেলারই আয়োজন আলাদা করে পেশাদার খেলোয়াড়দের জন্য সংরক্ষিত নয়। ধরুন, একই ইনডোর স্টেডিয়ামে আপনি আর আমি এক কোর্টে সন্ধেবেলা ব্যাডমিন্টন খেলছি, তখন তার ঠিক পাশের কোর্টেই হয়তো কোনও অলিম্পিয়ান খেলছেন।

বিলেতের এই পরিকল্পনায় সোনা যে ফলেছে, তা তো গত দুটো অলিম্পিেকর টেবিল দেখলেই মালুম হবে। ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, হকি ইত্যাদি যে-সব খেলায় এশীয় দেশগুলোর রমরমা ছিল, সেখানেও এখন বিলেতের জয়। তবে, মেডেল যদি না-ও মেলে, তাতেও ক্ষতি ছিল না।

এই প্রকল্পের নানাবিধ গুণ। প্রথমত, অলিম্পিকে যা-ই হোক, এ ভাবে গোটা জাতির স্বাস্থ্য ভাল হবে, নরেন দত্ত যে কারণে সবাইকে বিকেলে ঠাকুরঘরে গীতা নিয়ে না বসে মাঠে নেমে ফুটবলে লাথি মারতে বলেছিলেন। দুই, জনসাধারণ বুঝতে শিখবে কোন খেলা পেশা হিসেবে নেওয়াটা কী বিষম বস্তু! একমাত্র নিজে খেললেই খেলোয়াড়দের কদর করতে পারা যায়, আর এই ভাবে সম্মান প্রদর্শন দেশের ও সমাজের পক্ষে জরুরি। যেমন, আমাদের সমাজে সংগীতশিল্পীর সঙ্গে দরকার সমঝদারদেরও, যাদের গান ভালবাসার কান তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বের হল, না চাইতেও এই পদ্ধতিতে চ্যাম্পিয়ান তৈরি হয়ে যাবে। সবাই যোগ দিলে খেলোয়াড়-পিরামিডের ভিতটা অনেক চওড়া হবে আর তা হলে পিরামিডের উপরে ওঠার ধাপ-সংখ্যাও বাড়বে। আর সেই ধাপ বেয়ে উপরে উঠতে হলে, মানে, পাড়ার খেলোয়াড় থেকে ভাল খেলতে হবে এই জেদ থাকলে খেলোয়াড়দের দক্ষতা বাড়বে। আর একদম চুড়োয় যাঁরা যেতে চাইবেন, আপসেই তাঁরা চ্যাম্পিয়ন, তাঁদের সামনে আলাদা করে গাজর ঝোলানোর দরকার নেই!

বলাই বাহুল্য, দেশ জুড়ে এ হেন কর্মকাণ্ড চালাতে গেলে টাকা চাই। শুধু এককালীন বিনিয়োগ তো নয়, বার্ষিক ব্যয়। কাকতালীয় হতে পারে, তবে ১৯৯৬ সালেই বিলেতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এক অন্য প্রকল্প শুরু করেছিলেন— ন্যাশনাল লটারি। লটারির মতো জুয়ার সঙ্গে খেলার সম্পর্কটা মধুর। গত কুড়ি বছরে প্রতি সপ্তাহে বুধ ও শনি দুই বার বিলেতের জনগণ যত লটারির টিকিট কেটেছেন, সেই অর্থের একাংশ থেকে তকালীন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর এক ফান্ড তৈরি করেন: দ্য লটারি ফান্ড, যা থেকে জনকল্যাণমূলক নানাবিধ প্রকল্পে টাকা দেওয়া হয়। এই লটারি ফান্ডের অনেকটাই নানা খেলার আয়োজনে ব্যয় হয়। তারই ফলে এ বারের অলিম্পিেক বিলেতের দ্বিতীয় স্থান।

তবে শুধু টাকার জোগাড় হলেই জনগণের অংশগ্রহণ ঘটত না। মানসিকতাটাও জরুরি। আর সেটাই হয়তো এই বাংলায় বিরল। তাই, ক্লাবে ক্লাবে লক্ষ-লক্ষ সরকারি টাকার অনুদান এলেও আমরা খেলোয়াড় হতে পারি না। দেশের কথা ভাবার দরকার নেই, নিজের স্বাস্থ্যের জন্যই কেবল ক্যারম আর তাস না পিটিয়ে ঘাম ঝরাতে পারি আমরা। তা হলে সোনা ফলতে পারে। নিজের জন্যে, দেশের জন্যেও।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy