Advertisement
০৮ মে ২০২৪
Haj House

ভারততীর্থ

হজ হাউস।—ফাইল চিত্র।

হজ হাউস।—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:১২
Share: Save:

করোনা-কাল নূতন করিয়া চিনাইতেছে ভারতকে। বিগত চল্লিশ দিন ধরিয়া নিউটাউনের মদিনাত-উল-হুজ্জাজ’এর হজ হাউস আর কেবল মুসলমান সম্প্রদায়ের আবাসস্থল নহে। ৩১ মার্চ কোয়রান্টিন সেন্টারে পরিণত হইয়াছিল এই হজ হাউস, জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে তাহা হয় ‘সেফ হোম’, অর্থাৎ সামান্য উপসর্গ-বিশিষ্ট রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র। সেইখানে সর্ব ধর্মের রোগীর সহাবস্থান। যথাযথ পথ্য, ঔষধ ও চিকিৎসার ব্যবস্থাপনায় বাসিন্দারা সন্তুষ্ট। পরিষেবা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাহা অপেক্ষা বিশিষ্ট তাঁহাদের বন্ধুত্বের কাহিনিগুলি। নিউটাউনের হজ হাউসে সব সম্প্রদায়ের মানুষ মেলামেশা করিয়া থাকিতেছেন, সুখ-দুঃখ ভাগ করিয়া লইতেছেন। ভারতের সামাজিক বুনটে ইহাই সর্ববৃহৎ সত্য। এই দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ভিত্তিক পরিচিতিতে বাঁচিলেও তাহাতে প্রতিবেশীর সহিত শত্রুতার কোনও স্থান নাই, আছে যৌথ দিনযাপনের। কোনও কোনও শক্তি ধর্ম-সম্প্রদায়ের সত্তাকে উস্কাইয়া দিয়া সেই বন্ধুত্ব বিনষ্ট করিতে চাহে, সামাজিক বুনটের ক্ষতি করিতে চাহে। কিন্তু এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৈনন্দিনতায় সম্প্রীতিই জয়ী হয়।

ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সূচনাকালে দিল্লির নিজ়ামুদ্দিন মারকাজ় মসজিদে একটি জমায়েত লইয়া বিস্তর জলঘোলা হইয়াছিল। নিরন্তর প্রচার চলিয়াছিল, কোনও এক বিশেষ ধর্ম-সম্প্রদায়ের কারণেই দেশের সর্বত্র ভাইরাস সংক্রমিত হইয়া পড়িতেছে। তাহাতে রাজনীতির ইন্ধনই ছিল প্রধান। সময় যত গড়াইয়াছে এবং ভাইরাস যত ছড়াইয়াছে, তত এই মিথ্যা প্রচারের অসারতা প্রমাণিত হইয়াছে। সেই গোত্রের বিষাক্ত প্রচারকে প্রশমিত করিবার অস্ত্র হইতে পারে হজ হাউসের উদাহরণ। অতিমারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ধর্মপরিচয় যে কোনও বাধা নহে, সমস্ত ধর্মের মানুষই যে অপরাপর সম্প্রদায়ের সহিত কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া অতিমারি ঠেকাইতে তৎপর, তাহাই প্রমাণিত হইল। ইহা হয়তো স্বাভাবিক জ্ঞান; কিন্তু সময় ও সমাজে অযুক্তির চাষ প্রকট হইলে দৈনন্দিন কাহিনিগুলিকেই তুলিয়া ধরিতে হয়।

এগজ়াইলড অ্যাট হোম গ্রন্থে আশিস নন্দী বর্ণিত বহুপরিচিত কাহিনিটি স্মরণে আসে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় অযোধ্যায় সমাজ-গবেষণার অভিজ্ঞতা মন্থন করিয়া সমাজতত্ত্ববিদ জানাইয়াছিলেন, বিংশ শতাব্দীতেও অনেক দিন অবধি বাবরি মসজিদের নমাজিদের বড় ভরসা ছিলেন স্থানীয় মন্দিরের পুরোহিতরা। নমাজ পড়িতে যাইবার কালে তাঁহাদের চটি-জুতার দেখভাল করিতেন বৈরাগীরা, নমাজের শেষে তাঁহারা প্রসাদও গ্রহণ করিতেন। স্মরণীয় বিষ্ণু দে-র সন্দ্বীপের চর কাব্যগ্রন্থটিও; গ্রামে গ্রামে বৈঠক করিয়া হিন্দু ও মুসলমান নেতারা একসঙ্গে রুখিয়াছিলেন দেশভাগ-পূর্ববর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। অতিমারির কালে অশুভ ঘটনাই অধিক, কিন্তু তাহার ভিতরেও ভারতের আত্মাটিকে বুঝিয়া লইবার যে সুযোগ মিলিয়াছে, তাহা শাশ্বত শুভাকাঙ্ক্ষাকে ফের চিহ্নিত করিতেছে। বহু ধর্মের, বহু সম্প্রদায়ের এই দেশে পরস্পরের সম্পর্কের ভিতর দ্বন্দ্ব বা ধন্দ বিদ্যমান, তবে সকলের উপরে ঐক্যই সত্য। প্রতি দিনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সকলে মিলিয়া এক সমাজের নির্মাণই তাহা বুঝাইয়া দেয়। অন্যায় বিভাজনের বিপ্রতীপে তাহার ধারাবাহিক উদ্‌যাপনই কর্তব্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Haj House Coronavirus Quarantine Centre
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE