Advertisement
E-Paper

কৃষ্ণচূড়া নয়, চাই নিম, সোঁদাল

ফুলের আগুন লেগেছে কলকাতায়। বৈশাখ আসতেই কৃষ্ণচূড়া অজস্র লাল ফুলে উদ্ধত, অপরূপ। পাশে গুলমোহরের উজ্জ্বল হলুদ, জারুলের স্নিগ্ধ বেগুনির ছোঁয়া। পলাশ-শিমুলের আগুনে রং কলকাতায় তত দেখা যায় না, যেমন যায় রাঢ় বাংলায়।

পুলক লাহিড়ী

শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৭ ১৪:২০

বেগুনী জারুল ফুল, হলুদ শিরিষ পাশাপাশি...

দূর থেকে মনে হয়, এ-সময় কলকাতায় আসি।

এ-সময়ে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ফুলের আগুন লেগেছে কলকাতায়। বৈশাখ আসতেই কৃষ্ণচূড়া অজস্র লাল ফুলে উদ্ধত, অপরূপ। পাশে গুলমোহরের উজ্জ্বল হলুদ, জারুলের স্নিগ্ধ বেগুনির ছোঁয়া। পলাশ-শিমুলের আগুনে রং কলকাতায় তত দেখা যায় না, যেমন যায় রাঢ় বাংলায়। কৃষ্ণচূড়াই শহরবাসীর রঙের মহোৎসব।

আবার ওই লাল রংই বিপদের ইঙ্গিত। কৃষ্ণচূড়া সুন্দর, কিন্তু রাস্তার পাশের গাছ হিসেবে মোটেই উপযোগী নয়। এর শিকড় তেমন গভীর নয়, অথচ মাথাটা অনেকটা ছড়ানো, ভারী আর উঁচু। ঝড় জোরে এলে ভেঙে পড়তে চায়। বছর ছয়েক আগে একটা বড় ঝড়ের পর রবীন্দ্র সরোবর অঞ্চলের প্রায় দেড়শো পড়ে-যাওয়া গাছের সমীক্ষা করে দেখেছি, অধিকাংশই ছিল কৃষ্ণচূড়া-গুলমোহর।

কথাটা অনেক আগে বলেছিলেন উদ্ভিদ-বিশেষজ্ঞ এ পি বেন্থাল। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত বইতে (ট্রিজ অব ক্যালকাটা অ্যান্ড ইটস নেবারহুড) তিনি লিখছেন, হলুদ বা লাল ফুলে ভরা গুলমোহর দেখতে বেশ লাগে, কিন্তু পার্ক ছাড়া লাগানো উচিত নয়। সহজে উলটে যায় ঝড়ে। তবু কৃষ্ণচূড়া এখন কলকাতার ফুটপাথে অঢেল। কারণ, এগুলো বড় হয় দ্রুত, জল লাগে কম। ফুল ফুটলে দেখতেও সুন্দর লাগে। একই কারণে গুলমোহর বা রাধাচূড়া বেশি লাগাতেন পুরকর্তারা। জারুল, বকুল আর ছাতিম গাছও অনেক লাগানো হয়েছে কলকাতার ফুটপাথে। ছাতিমে সুন্দর ফুল আসে হেমন্তে, কিন্তু এই ফুলের পরাগ থেকে অ্যালার্জি হয়। জনবহুল জায়গায় এ গাছ না লাগানোই ভাল।

গাছের বৈচিত্র নিয়েও চিন্তা চাই। বেন্থাল কলকাতার রাস্তার গাছের ৬৯টি প্রজাতি শনাক্ত করেছিলেন। তার মধ্যে ডুমুর, যজ্ঞডুমুর, বেল, পাকুড়, চালতা, আমড়া, করঞ্জ, তেঁতুল, সজনে, হিজল, কেয়া, কালোজামের উল্লেখ করেছেন। আছে বাঘ ভেরেন্ডা, খুদি জাম, কুকুরচিতার মতো গাছ। এর অনেকগুলো আজ পাওয়া কঠিন। তবে সে যুগের লেখকও দুঃখ করছেন, পঞ্চাশ বছর আগে যে সব গাছ কলকাতায় মিলত সেগুলো আর মেলে না, যেমন জায়ফল। তবে ফলসা, কামরাঙা, কদবেল গাছ সাহেবি কলকাতায় ছিল অঢেল। এমনকী ময়দান অঞ্চলে কনকচাঁপাও ছিল। রাস্তার ধারের উপযোগী গাছ হিসেবে তিনি চিহ্নিত করছেন জিয়াপাতা, দেবদারু, বকুল, দিশি বাদাম গাছকে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিকল্পনা করছে, রাজ্যের অনেকগুলো শহরকে ‘গ্রিন সিটি’ করা হবে। সাধু প্রস্তাব, কিন্তু কী গাছ লাগালে ভাল হয় তা নিয়ে চিন্তারও প্রয়োজন রয়েছে পুরকর্তা আর বনবিভাগের কর্তাদের। সত্তরের দশকে বালিগঞ্জ অঞ্চলে দেখেছি মেহগনি গাছ বেশ কিছু ছিল। তার অনেকগুলি কেটে নিয়ে গিয়েছে কারা। দামি কাঠের গাছ রক্ষা করা মুশকিল। শান্তিনিকেতনে যেমন প্রায়ই চুরি যায় চন্দন গাছ। আবার পেয়ারা বা কাঁঠালের ভাগ নিয়ে প্রায় দাঙ্গা বেধে যায়, ফল পাড়তে গিয়ে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। বট, অশ্বত্থের মতো বৃহৎ গাছ দেওয়াল, ভিত ফাটিয়ে দিতে চায়। তাই শহরে এগুলোকেও এড়িয়ে চলতে হয়।

যে গাছটি নানা দিক থেকে উপকারী, তা হল নিম। নিমের পাতা ডাল মানুষের কাজে লাগে। শুধু তা-ই নয়, নিমের ফুল দেখতে সুন্দর, গন্ধও মিষ্টি। নিমের ফল-ফুল পাখি আর কীটপতঙ্গদের খুব প্রিয়। তাই যেখানে নিম, সেখানে গাছকে ঘিরে সমৃদ্ধ এক বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে। নিম শক্তপোক্ত গাছও বটে। অথচ নিমগাছ শহরগুলোতে লাগানোর চল তেমন দেখা যায় না। ইউক্যালিপটাস বাদ দেওয়া চাই। পাখপাখালির উপযোগী নয় এই গাছ।

ছায়া দেওয়ার জন্য সত্যিই উপযোগী দিশি বাদাম গাছ। মুঘল আমলেও নাকি এ গাছ লাগানো হত পথের দু’পাশে, যাতে আরাম পায় সেনারা। দ্রুত বেড়ে ওঠে, ডালপালা ছড়িয়ে দেয়।

চোখ-জোড়ানো ফুল চাইলে কৃষ্ণচূড়া, গুলমোহরের চাইতে ভাল হতে পারে সোঁদাল বা বাঁদরলাঠি গাছ। ঝাড়লণ্ঠনের মতো হলুদ ফুল ঝোলে অনেক দিন, গাছের উচ্চতা বেশি নয় বলে উপড়ে যাওয়ার ভয় থাকে না। তবে গাছ লাগানোর সময়ে এমন ভাবে পরিকল্পনা করা দরকার যাতে সারা বছর ফুল পাওয়া যায়। যেমন শিমুল (বসন্ত), সোঁদাল (গরম), বকুল, কদম (বর্ষা), কাঞ্চন (শীত)। অনেক রাস্তায় দেখা যায়, পর পর বকুল গাছ। সে নেহাত দায়সারা কাজ।

গাছ লাগানোতেই কাজ শেষ নয়। গাছের অসুখে চিকিৎসা হয় না। যেমন-তেমন করে ডালপালা কেটে তার ভারসাম্য নষ্ট করা হয়। গুঁড়ি অবধি সিমেন্টে বাঁধিয়ে দিয়ে শ্বাস আটকানো হয়, গাছের গুঁড়িতে পেরেক ঠুকে বিজ্ঞাপন লাগানো হয় হরদম। এ সব বন্ধ হোক। দূষিত শহরে গাছের চাইতে ভাল প্রতিবেশী আর কে আছে।

প্রাণী-বিদ্যার শিক্ষক

Trees Roadside plantation Eco-system Herbal trees
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy