Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

বহু ইতিহাসের সাক্ষী কালনার গির্জা

কালনায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ও মেন্ট ব্রিক্টের উদ্যোগে যিশুর বাণী প্রচারের জন্য গঠিত হয়েছিল ‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি’। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস শুরু ১৮০০-’০৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। লিখছেন সোমনাথ ভট্টাচার্য কালনায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ও মেন্ট ব্রিক্টের উদ্যোগে যিশুর বাণী প্রচারের জন্য গঠিত হয়েছিল ‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি’। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষ বাস শুরু ১৮০০-’০৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। লিখছেন সোমনাথ ভট্টাচার্য

কালনার সেই গির্জা। (ডান দিকে) গির্জার পুরনো নথি। ছবি: লেখক

কালনার সেই গির্জা। (ডান দিকে) গির্জার পুরনো নথি। ছবি: লেখক

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:১২
Share: Save:

বঙ্গদেশের যত বেশি এলাকা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি করায়ত্ত হচ্ছিল, তত বেশি করে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তার লাভ করছিল খ্রিষ্ট ধর্ম। কালনা সেই প্রভাব বহির্ভূত ছিল না। সে ইতিহাসের সাক্ষী হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে কালনার গির্জা।

তৎকালীন কালনা ছিল নৌপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ইংরেজরা প্রথম জলপথে কালনায় আসে। ইতিহাসবিদদের একাংশের ধারণা, ১৭৫৫ সালের এক দল ইংরেজ বণিক কালনা থেকে বর্ধমানে যান। এর পরে ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় চালের অভাব পূরণের জন্য কোম্পানির তৎকালীন সচিব বর্ধমানের কালেক্টর টমাস ব্রুককে কৃষিতে সমৃদ্ধ কালনা থেকে নদীপথে কলকাতায় চাল সরবরাহের আবেদন করেন। ১৭৯০ সালে কালনা অঞ্চলে ইংরেজদের ঘাঁটি স্থাপিত হয়।

কালনায় খ্রিস্টধর্ম প্রচার শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ও মেন্ট ব্রিক্টের উদ্যোগে যিশুর বাণী প্রচারের জন্য গঠিত হয়েছিল ‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি’। কালনায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করতে শুরু করেন ১৮০০-১৮০৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। ‘ইউনাইটেড ফ্রি চার্চ অব স্কটল্যান্ড’-এর উদ্যোগে উঁচুঝাপট এলাকার মিশনপাড়ায় প্রোটেস্টান্ট ধর্মাবলম্বীদের জন্য এই গির্জাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন ১৮২৫ সাল। প্রতিষ্ঠার কাজে সাহায্য করেছিলেন রেভারেন্ড জেল মেরিন নামে এক মহিলা। পরবর্তী কালে রেভারেন্ড লালবিহারী দে-ও কালনার এই গির্জাটির দায়িত্বে ছিলেন।

শতাব্দী প্রাচীন এই গির্জাটির অবস্থা বর্তমানে সঙ্গিন। সংরক্ষণের অভাবে একাংশ ভেঙে পড়েছে। তবে আজও এই গির্জায় রয়ে গিয়েছে পুরনো কাঠের চেয়ার, টেবিল এবং প্রার্থনা করার ডেস্ক। একটি প্রাচীন পিয়ানোও ছিল এখানে। শোনা যায়, এই পিয়ানো বাজাতেন উইলিয়াম নামে এক সাহেব। গির্জার ভিতরে প্রার্থনার সভাস্থলে একটি ফলক রয়েছে। তাতে লেখা, ‘রেভারেন্ড বিকে সরকারের স্মরণার্থক ফলক— ইনি পাঁচ বৎসর এই মণ্ডলীর পৌরোহিত্য করিয়া ১৯২৮ সালে ১৫ জুন প্রভুতে নিদ্রিত হন’। মাদার টেরিজা ১৯৯৪ সালে কালনার তৎকালীন বিডিও-কে কালনার গির্জাটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি চিঠি দিয়েছিলেন।

নথিপত্র যাচাই করে দেখা যায়, এই গির্জায় এক কালে বহু বিশিষ্ট জনের ধর্মান্তরণ ঘটেছিল। ১৯৩৪ সালে ২২ জুলাই এই গির্জায় রথীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ১৯৩৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর বিথীশ কবিরাজ এবং ১৯৩৪ সালের ২২ জুলাই সুষমাবালা মণ্ডল ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ধর্ম প্রচার বা ধর্মান্তরণ করার পাশাপাশি, শিক্ষা বিস্তার, হাসপাতাল তৈরির মতো নানা সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে এই গির্জার পাদ্রিরা জড়িয়ে ছিলেন।

মিশনারিদের উদ্যোগে সে কালে গির্জার পাশে একটি হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছিল। ‘চার্চ অব স্কটল্যান্ড’ কর্তৃপক্ষ এই হাসপাতালটি তৈরি করেন। এক সময় কালনার মানুষের চিকিৎসার অন্যতম কেন্দ্র ছিল এই হাসপাতাল। বর্তমানে এটি ‘পুরনো হাসপাতাল’ নামে পরিচিত।

শোনা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য এক যক্ষ্মা রোগীকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন। এই হাসপাতালে ১৯৩৪-৩৫ সালে কাজ করেছেন সে কালের অন্যতম বিখ্যাত চিকিৎসক মুর সাহেব। পরবর্তীকালে এই হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত হন চিকিৎসক অ্যান্ডারসন ও অ্যাম্বার্ট সাহেব। হাসপাতালের একটি নথি থেকে জানা যায়, ১৯১৮-১৯১৯ সালের মধ্যে এই হাসপাতালে কালাজ্বর, সান্নিপাতিকে আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা হয়েছে। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে বর্ধমান অঞ্চলে ম্যালেরিয়া কালাজ্বরের মতো বেশ কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল। তখন এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ‘অ্যাম্বার্ট সাহেবের হাসপাতাল’ বলেও ডাকা হত। বর্তমানে এই হাসপাতালটিও জীর্ণদশাপ্রাপ্ত।

ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের দিকেও নজর দিয়েছিলেন সে কালের মিশনারিরা। কালনার গির্জা কর্তৃপক্ষ এবং মিশনারি সমাজের উদ্যোগে কালনার চার্চ লাগোয়া এলাকায় চারটি বালক এবং তিনটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছিল। বিদ্যালয়গুলি পরিচালনা করতেন রেভারেন্ড কুরি ও রেভারেন্ড তিয়ার। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ এবং আদিবাসী জনজাতির মানুষের একাংশ ছিলেন এই গির্জাকেন্দ্রিক ইংরেজ মিশনারি শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান গ্রহীতা।

স্বাধীনতা লাভের আগে কালনায় হিন্দুদের সঙ্গে খ্রিস্টানদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অবশ্য এখানকার অধিকাংশ খ্রিস্টান পরিবার কালনা ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। বর্তমানে গির্জা লাগোয়া অঞ্চলে একটি খ্রিস্টান পরিবার বসবাস করে। ওই পরিবারের সদস্য জেকব বিশ্বাস আমৃত্যু এই গির্জার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। জেকবের পরিবার ছিলেন কালনার জাপটপাড়ার একমাত্র খ্রিস্টান পরিবার। জেকব বিশ্বাসের নাতি সমরেন্দ্রকুমার মণ্ডল কালনা গির্জার পরিচালন সমিতির সভাপতিও ছিলেন। জেকব বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যেরা এখনও কালনা গির্জার সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে বড়দিন থেকে শুরু করে ইংরেজি নববর্ষ পর্যন্ত সময়ে বহু উৎসবপ্রিয় মানুষের গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে বর্ধমান জেলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম এই গির্জা।

লেখক কালনার সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kalna Christian Church Kalna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE