Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বেঁচে থাকুক যুদ্ধ যুদ্ধ আর ভাব ভাব খেলা

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাব ও ঝগড়ার সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল লাহৌর প্রেস ক্লাব। সেখানে দেখা হল উর্দু সংবাদপত্র ‘মুসলিম’-এর সম্পাদকের সঙ্গে। আজকের কথা নয়। ১৯৯০ সাল। বেনজির ভুট্টো তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন কভার করতে গিয়েছি। সে বার বেনজিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন এই মিয়াঁ নওয়াজ শরিফ।

এই ফ্রেমের কি বদল হবে না?

এই ফ্রেমের কি বদল হবে না?

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৬ ০০:০২
Share: Save:

লাহৌর প্রেস ক্লাব। সেখানে দেখা হল উর্দু সংবাদপত্র ‘মুসলিম’-এর সম্পাদকের সঙ্গে। আজকের কথা নয়। ১৯৯০ সাল। বেনজির ভুট্টো তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন কভার করতে গিয়েছি। সে বার বেনজিরকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় এসেছিলেন এই মিয়াঁ নওয়াজ শরিফ।

তা সেই মুসলিম কাগজের সম্পাদক আমাকে তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আমার নামটা কিন্তু তোমার দেশের মানুষের কাছে এক ঘৃণিত নাম।’’ তারপর হাসতে হাসতে রোগাসোগা সেই নিরীহ চেহারার মানুষটি বলেছিলেন, ‘‘আমার নাম ঔরঙ্গজেব।’’

সেটাই ছিল আমার প্রথম পাকিস্তান সফর। লাহৌরের আকাশে ঘুড়ি উড়ছে। কারণ আর কিছু দিনের মধ্যেই পাকিস্তানের ঘুড়ির উৎসব। যাকে ওরা বলে বসন্ত উৎসব বা পতঙ্গ উৎসব, তার আসার সময় হয়ে এসেছে। খাওয়াদাওয়া, আনারকলি মার্কেটের কেনাকাটা, সব কিছুই আমাদেরই মতো মনে হয়েছিল। এক সদ্য হওয়া পাকিস্তানি বন্ধু তাঁর গাড়িতে প্রথম শুনিয়েছিলেন ইকবাল বানোর গজল, হম দেখেঙ্গে। আমার সঙ্গে সে দিন ছিল টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সঙ্কর্ষণ ঠাকুর। লাহৌরের আর্ট মিউজিয়ামে বিনোদবিহারী থেকে যামিনী রায়ের ছবি রাখা ছিল সযত্নে। তবু সে দিন কিন্তু ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের পারস্পরিক বৈরিতাও ছিল একই রকম। ঔরঙ্গজেব যে কত ভাল সম্রাট ছিলেন, তা সে দিনও পড়ানো হত, আজও পড়ানো হয় পাকিস্তানের ইতিহাস বইতে। পাকিস্তানের ঐতিহাসিকরা বলেন, তিনি সৎ, ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। দিনে অনেক বার নমাজ পড়তেন। টুপি সেলাই করতেন। কোরাণ নকল করতেন। আর আমাদের ভারত আবার হল আকবরের দেশ। আমরা মনে করি, আকবর মহামতি। দিন-ই-ইলাহির প্রবক্তা। তিনি না কি প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ পুরুষ। ঔরঙ্গজেব সে দিন আমায় বলেছিলেন, কুকুর আর শুয়োর ইসলাম ধর্মে ঘৃণ্য পশু বলে চিহ্নিত। তোমাদের আকবর কিন্তু তাঁর সময়ে কুকুর আর শুয়োরকে আল্লাহর কুদরত (মহিমা) প্রকাশক ও পবিত্র বলে ঘোষণা করেছিলেন। বড় অদ্ভূত ঠেকেছিল ব্যাপারটা। আমাদের আকবর, তোমাদের ঔরঙ্গজেব।

এর পর তো পাকিস্তানে আমি সব মিলিয়ে পাঁচ বার গিয়েছি। কখনও বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে, কখনও উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে, আবার ঐতিহাসিক লাহৌর বাসযাত্রায় অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে। লাহৌর বাসযাত্রার পর কার্গিলের যুদ্ধ হয়েছে। কার্গিলের যুদ্ধ থেকে পঠানকোট এক সুদীর্ঘ পথ চলা। আবার সে দিন নওয়াজ শরিফের প্রথম বারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রাক্কালে কাশ্মীরের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ফারুক আবদুল্লা। সেই নির্বাচন কভার করতে গিয়েছিলাম শ্রীনগর। সেখানে দেখেছিলাম, কী ভাবে সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে কাশ্মীরে নির্বাচন হয়। তখন মনে হয়েছিল এই নির্বাচনে ফারুক আবদুল্লা হেরে গেলে জাতীয়তাবাদের উপর বিরাট আঘাত আসবে। জাতীয়তাবাদের স্বার্থে কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর রিগিংকেও ভারতীয় মিডিয়ার একটা বড় অংশ তুলে ধরেনি। গণতন্ত্র আর জাতীয়তাবাদের সেই বিবাদ আজও প্রাসঙ্গিক।

নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তাঁর পাকিস্তান নীতিটা যে কী, সেটাই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সার্ক রাষ্ট্রভুক্ত সব রাষ্ট্রপ্রধানকে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালেন তিনি। সমবেত ভাবে সাধু, সাধু রব উঠল। শুধু রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানানোই নয়, অপ্রত্যাশিত ভাবে নওয়াজ শরিফের সঙ্গে একটা দ্বিপাক্ষিক বৈঠকও করে ফেললেন। মধুচন্দ্রিমা পর্ব। তাতেও সবাই ধন্য ধন্য করল। এ দিকে পাকিস্তানে যত দিন যাচ্ছে, ততই সেনাবাহিনী ও মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে নওয়াজ শরিফের খটাখটি ক্রমশ বাড়তে লাগল। তার মধ্যে রয়েছে আমেরিকা। এ দিকে কাশ্মীর সীমান্তে মে মাসের বরফ গলল। প্রথামাফিক জঙ্গি অনুপ্রবেশ শুরু হয়ে গেল। দেশের ভিতর নাশকতামূলক কার্যকলাপ বাড়তে লাগল। এর মধ্যে আইএস ঘোষণা করল, ছায়াযুদ্ধ চলছে, চলবে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে পাকিস্তান হাইকমিশনারের দিল্লিতে হুরিয়তদের সঙ্গে বৈঠককে কেন্দ্র করে ভারত আবার যুদ্ধঘোষণা করল। বেশ কিছু দিন সেই বাগযুদ্ধ চলল। বিদেশসচিব পর্যায়ে বৈঠক বাতিল হল। তার পর আবার কিছু দিনের মধ্যেই মার্কিন চাপে এবং কূটনীতিকদের দৌত্যে আবার বৈঠক হল মোদী-নওয়াজের। নওয়াজের কানে ফিসফিস করে কথা বললেন মোদী। সবাই বলে উঠল, আর যুদ্ধ নয়। এ বার ভাব। সেই ভাব ও ঝগড়ার ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সার্ক দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে এ বার যাচ্ছেন রাজনাথ সিংহ। তিনি জানিয়েছেন, খাচ্ছি, কিন্তু গিলব না। কোনও দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হবে না।

নেহরু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ফারুক আবদুল্লার বাবা শেখ আবদুল্লাকে পাঠিয়েছিলেন পাকিস্তানে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধানে আলোচনা করার জন্য। তার পরেও কচ্ছকে কেন্দ্র করে ’৬৫ সালের সংঘাত। তারপর তাসখন্দ চুক্তি। তারপর আবার ’৭১ সালের যুদ্ধ। ’৭২ সালে ইন্দিরা-ভুট্টো চুক্তি। গুজরাল-নওয়াজ শরিফও অনেকটা এগিয়েছিল। কিন্তু এখন দু’টি দেশই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। আর যা-ই হোক, সাবেক স্টাইলে যুদ্ধ করার ঝুঁকি কেউই নিতে চায় না। তা হলে এখন নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তান নিয়ে করবেনটা কী? উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে আকবর ও ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় মেরুকরণ বাড়ানোটাই কি তা হলে অগ্রাধিকার? না কি চুলোয় যাক রাজ্যের নির্বাচন? প্রকৃত রাষ্ট্রনেতার মতো ভারত-পাকিস্তান মৈত্রীকে আর এক বারের জন্য পূর্ণ মর্যাদায় এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই হবে নরেন্দ্র মোদীর লক্ষ্য? এ প্রশ্নের উত্তরে বেশির ভাগ মানুষই জানি বলবেন, বেঁচে থাক দেশের নির্বাচনী রাজনীতি। কূটনীতির বৃহৎ দর্শন এখন বিজ্ঞাপনে মুখ ঢাকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India-Pakistan conflict
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE