Advertisement
০৪ মে ২০২৪

নতুন করে ভাবতে হবে

আজ বহু সংস্থায় ছাঁটাই চলছে, চার দিকে একটা দিশাহীনতা। তেলেঙ্গানা সরকার বলছে চাকরি বাঁচাতে উদ্যোগ নেবে, ইউনিয়ন তৈরি করা যায় কি না, শ্রম আইন লাগু করা যায় কি না, এ সব চিন্তা চলছে।

বিপন্ন: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প দ্রুত এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছচ্ছে, কর্মীদেরও ক্রমশ গ্রাস করছে এই আশঙ্কা, সেক্টর ফাইভ, সল্ট লেক। শৌভিক দে

বিপন্ন: দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প দ্রুত এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছচ্ছে, কর্মীদেরও ক্রমশ গ্রাস করছে এই আশঙ্কা, সেক্টর ফাইভ, সল্ট লেক। শৌভিক দে

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৭ ১৩:০০
Share: Save:

এ বার পালে বাঘ পড়েছে। এত দিন ধরে একটা মধ্য-মেধা নির্ভর ব্যবসার মডেলে অভ্যস্ত আর সুখী হয়ে যাওয়া দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প এ বার বোধহয় একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশ জুড়ে চল্লিশ লাখের মত কর্মী, দেড়শো বিলিয়ন ডলারের বেশি আয়, অথচ কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে কোনও নতুন উদ্ভাবন দুরবিন দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। অন্যের কাজ সস্তায় করে দিলেই যেখানে এত সমৃদ্ধি, সেখানে নতুন কিছুর জন্য মাথা ঘামানো কেন? মনে পরে কাজী সব্যসাচীর গলায় সেই এক ছত্র, ‘দরকার-ই বা কি, তরকারি বেচে, সরকারি ষাঁড়ের মতন নাদুসনুদুস।’ এত ভুবনজোড়া নাম আমাদের সব সংস্থার, কিন্তু তরুণ ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে দলে দলে ‘সাইবার-কুলি’ বানানো ছাড়া সত্যি কি কিছু হল?

আজ বহু সংস্থায় ছাঁটাই চলছে, চার দিকে একটা দিশাহীনতা। তেলেঙ্গানা সরকার বলছে চাকরি বাঁচাতে উদ্যোগ নেবে, ইউনিয়ন তৈরি করা যায় কি না, শ্রম আইন লাগু করা যায় কি না, এ সব চিন্তা চলছে। বোঝা যায়, এ দেশের মানসিকতার মধ্যেও ‘সাইবার’ কম, ‘কুলি’ অংশটাই বেশি |

এত লাখ লাখ কর্মী যেখানে, সেখানে স্বাভাবিক নিয়মেই কিছু অদক্ষ লোক সরাতে হয় প্রতি বছর। কিন্তু এ বারের ঘটনাটা ঠিক তা নয়, যতই ন্যাসকম সেরকম একটা যুক্তি খাড়া করে শেয়ার-এর পতন আটকাবার চেষ্টা করুক। আসলে তথ্যপ্রযুক্তি একটা নতুন প্রজন্মে ঢুকে পড়েছে, যেখানে দিস্তে দিস্তে ‘কোড’ লেখা-নির্ভর কাজ ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে। প্রোগ্রাম লেখা এখন অনেকটাই স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি। তথ্য এবং তার বিশ্লেষণ-নির্ভর প্রযুক্তি আজ সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। মেঘমাখানো আকাশ থেকে গিটকিরি গান, সব কিছুই। একে বলা হচ্ছে শিল্পের চতুর্থ যুগ, বা ‘ইন্ডাাস্ট্রি ৪.০’। শিল্পে রোবটনির্ভরতা, বিগ ডেটা অ্যানালিটিকস, কম্পিউটার-এর ক্ষমতাবৃদ্ধি আর নিজে থেকে শিখে ফেলা (মেশিন লার্নিং), কৃত্রিম মেধা (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স), ইন্টারনেট ক্লাউড-এর সহজলভ্যতা, যন্ত্রপাতির নেট-যুক্তিকরণ (ইন্টারনেট অব থিংস), এ সব শুনতে একটু শিশিবোতলের মত লাগলেও এই দিকেই আজ তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের অমোঘ চলন। সব মিলিয়ে কাজকর্মের ধরন আর দক্ষতার চাহিদা, সব কিছুতেই ওলটপালট করা পরিবর্তন আসতে চলেছে, প্রায় এসেই গিয়েছে। বিশ্লেষকদের আভাস অনুযায়ী, আজকে যে ধরনের কাজ বেশি, তার প্রায় ৪০ শতাংশ আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে উধাও হয়ে যাবে। তারই শুরুটা আমরা দেখতে পাচ্ছি আজকে |

তার সঙ্গে বিষফোঁড়ার মত, যে দেশগুলোর কাজ করে ডলার কমানো যাচ্ছিল, সে দেশগুলোতে আর্থিক মন্দা, আর একটা রক্ষণশীল মানসিকতার বিশ্বায়ন। বিদেশিদের আমেরিকাতে গিয়ে কাজ করার যে এইচ-১ বি ভিসা, তাতে রাশ টানছে ট্রাম্প শাসন। কিন্তু সে তো খানিক জানাই ছিল, নয় কি? পড়ে পড়ে চাকরি হারানো একটা দেশের মানুষ কত দিন চুপচাপ এই পরিস্থিতি মেনে নেবে?

তার ফলে, টিঁকে থাকতে গেলে নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তি-তে দীক্ষা নিতে হবে, নতুন ভাবে সাজাতে হবে ব্যবসার ধরন। তার জন্য কতটা তৈরি ভারত? সে কাজ করবেই বা কে? অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন রিপোর্ট বলছে, দেশে প্রতি বছর যে ইঞ্জিনিয়াররা পড়াশোনা করে বেরোচ্ছে, তার ৮০ শতাংশেরও বেশি চাকরি পাওয়ার অযোগ্য। আর যারা ইতিমধ্যে চাকরি করছে, সেই কর্মীদের ৬৫ শতাংশের নতুন কোনও দক্ষতা অর্জনের ক্ষমতাই নেই। এই অপ্রিয় সত্যিটা মুখ ফসকে বলেই ফেলেছেন কগনিজ্যান্ট-এর শীর্ষকর্তা।

আমাদের রাজ্য ও অন্যান্য রাজ্যে ছবিটা কিন্তু একই। বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হতে পারলেই চাকরি পাওয়াকে পিতৃদত্ত অধিকার ভেবে ফেলছে ছাত্রছাত্রীরা, যেহেতু তারা পয়সা দিয়ে পড়াশোনা করছে! তাই ক্লাস করার দরকার নেই, কিছু শেখার দরকার নেই, পরীক্ষার আগে সাজেশনের বই কিনে, নম্বর কম পেলে ভাঙচুর করে, আর চাকরি না পেলে ঘেরাও করেই মোক্ষলাভ খুব সহজ। যাকে বলে তুড়ি মেরে ডিজিটাল ইন্ডিয়া। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কলেজগুলোর পড়াশোনার অবস্থা বিষয়ে যত কম বলা যায় ততই ভালো। যেমন তাদের পরিকাঠামো, তেমন তাদের শিক্ষকের মান। শিল্পে যত দিন পৌষমাস ছিল, এই নিয়েই বিশ্বজয় হয়েছে— পাশ করার এক বছর আগেই চাকরির চিঠি ইত্যাদি। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলিও মানের বা শিক্ষাপদ্ধতির উন্নয়নের ব্যাপারে নজর দেয়নি। উটপাখির মত বালিতে মাথা গুঁজে আমরা অনিবার্যকে এড়িয়ে গিয়েছি।

আবার এসে গেল জয়েন্ট দিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তির সময়। বাড়ি-জমি বন্ধক রেখে টাকা যোগাড় করতে উন্মুখ বাবা-মায়েদের কিন্তু একটু বুঝতে হবে, কোথায় তাঁদের ছেলেমেয়ে ভর্তি হচ্ছে, কী তারা শিখবে, প্রাণপাত করে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতা বাড়াতে তারা একটুও প্রস্তুত কি না। বিশেষত চার বছর পর যখন সে পাশ করে বেরিয়ে আসবে, তখন বাজার ঠিক যা চাইবে, তার সঙ্গে এই পড়াশোনার আদৌ কোনও সংযোগ আছে কি না। নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তির তালিম নেওয়ার মতো শিক্ষক কলেজগুলোতে আছেন কি না। এই সব না থাকলে ডিগ্রি যে একটা রদ্দি কাগজ ছাড়া কিছু নয়, এটা জানা জরুরি, না হলে শিক্ষার নামে সবটাই উটের পাকস্থলী হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে তা হলে সামনের ছবিটা কেমন? কালো মেঘ অনেক। মোট কর্মী-র সার্বিক চাহিদা হয়তো কমবে না। কিন্তু দক্ষতার ধরনে খোলনলচে পাল্টে যাবার সম্ভাবনাই বেশি। তাই দ্রুত বদলে ফেলতে হবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত সকলকেই: সংস্থা, তার কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কাজ শেখার ধরন। বলা সহজ। করাটা নয়। করার পথে সবচেয়ে বড় বাধা মানসিকতার স্থবিরতা। যে ধাঁচে এত দিন এ দেশে কাজ হয়ে এসেছে, তাতে দ্রুত কোনও পরিবর্তন কঠিন।

সেখানেই কিন্তু একটা সুযোগ কলকাতার সামনে! এই যে প্রযুক্তির নতুন যুগ, তাতে সম্পৃক্ত হতে পারা খুব বড় মাপের সংস্থাগুলোর পক্ষে কঠিন। এই উদ্ভাবনে পথ দেখাতে পারে নতুন প্রজন্মের সংস্থা, যাদের বলা হচ্ছে ‘স্টার্ট-আপ’। তারুণ্য, মেধা আর উদ্যমকে মূলধন করে চোখে পড়ার মত কাজ করছে অনেক স্টার্ট-আপ, তবে তার ভিড় আপাতত বেঙ্গালুরু ঘিরেই। এখানে কলকাতা একটা জায়গা করে নিতেই পারে যদি সরকার আর একটু উদ্যোগ নিয়ে বিনা পয়সায় জায়গা আর পরিকাঠামো দিতে এগিয়ে আসে। সরকার আর কিছু না করলেও চলবে, বিনিয়োগ করার ইকো-সিস্টেমটুকু তৈরি করা ফেলা শক্ত নয়। কলকাতার স্টার্ট-আপগুলির তো উপকার হবেই, অন্য রাজ্য থেকেও এই ধরনের কোম্পানিদের এখানে টেনে আনা সম্ভব হবে। আজকাল পড়াশোনার জন্য সাইকেল, ব্যাগ, জুতোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে অনেক খরচ করে। তাদের জীবিকার ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ‘জমি-ইনফোসিস-সেজ’ চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে কয়েক লক্ষ বর্গফুট স্টার্ট-আপ পার্ক করে দেওয়া কি খুব কঠিন? অনেক কিছুই তো কলকাতাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে, এ বার ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ কে সামনে রেখে কলকাতার একটা নতুন পরিচয় হোক না!

ইনকিউব ইনোভেঞ্চার্স-এর অধিকর্তা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

IT industry India juncture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE