Advertisement
E-Paper

ফ্যাসিবাদের দু’পিঠ

আজ রিজওয়ানুরকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে, কিন্তু এমন ঘটনা তো নতুন নয়! প্রতি দিন কত রকম অনুরোধ নিয়ে মানুষ আসেন জানেন কি?

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৮ ০০:০০

বেশ কয়েক বছর আগে কাজের সূত্রে লালবাজারের এক শীর্ষ আধিকারিকের সঙ্গে দেখা করেছিলাম। কথা প্রসঙ্গে রিজওয়ানুর মামলার কথা উঠেছিল। তিনি সখেদে বলেছিলেন, আজ রিজওয়ানুরকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে, কিন্তু এমন ঘটনা তো নতুন নয়! প্রতি দিন কত রকম অনুরোধ নিয়ে মানুষ আসেন জানেন কি? ওকে দু’ঘা লাগিয়ে দিন, অমুককে ডেকে কড়কে দিন, তমুককে দু’দিন হাজতে পুরুন... মানুষই যদি পুলিশকে এই ভূমিকায় দেখতে চান, আপনি কী বলবেন? পুলিশ তো সমাজের বাইরে নয়!

কথাগুলো পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার সুযুক্তি হতে পারে না নিশ্চয়ই, তবে সমাজের চাপটা সত্যিই থাকে। দমদম মেট্রো স্টেশনে সম্প্রতি যা ঘটে গেল, তাতে সেই আধিকারিকের কথাগুলো মনে পড়ছে। কারণ সে দিন আমার-আপনার মতো এক দল মানুষই দেখিয়ে দিয়েছেন, আমরা বেশির ভাগ লোকই আসলে মনে মনে পুলিশ। যা কিছু আমাদের চোখে খারাপ ঠেকে, আমরা তা ডান্ডা দিয়ে ঠান্ডা করার পক্ষপাতী। বিশ্বাস করি, ভাল রকম ধোলাই দিলে অর্ধেক অপরাধ কমিয়ে ফেলা সম্ভব। ক্ষমতার বিন্যাস ও সামাজিক স্থিতাবস্থার প্রতি অপার মোহে আমরা প্রেম এবং যৌনতার উদ্‌গিরণকে খুব বিপজ্জনক ভাবি, কারণ সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। পরকীয়ার সামাজিক সালিশি এবং শাস্তিবিধানের খবর তাই মাঝেমধ্যেই কাগজে বেরোয়। মর্যাদা রক্ষার নামে খুন এ রাজ্যও দেখেছে। দমদমে সে দিন যাঁরা দু’টি ছেলেমেয়ের উপরে হাতের সুখ করলেন, তাঁরা অবশ্যই তাদের আচরণকে অপরাধ বলে মনে করেছিলেন। তার পর কথা কাটাকাটিতে উত্তাপ আরও বেড়েছে। ওঁরা ঠিক করে নিলেন, উচিত শিক্ষা দিতে উত্তমমধ্যমই রাস্তা।

শারীরিক ও মানসিক পীড়নের ‘সংশোধনাত্মক’ ভূমিকা, যার উপরে আমাদের ভারী ভরসা, সেটার মূল উপাদান একটাই— ভয়। আমরা মনে করি, খুব এক চোট ভয় ঢুকিয়ে দিতে পারলে মানুষ সমঝে যাবে। বড় বড় অপরাধে আমাদের প্রিয় শাস্তি তাই ফাঁসি। আমাদের এক বারও মনে হয় না, রুলের গুঁতো মেরে সবক শেখানোর মধ্যে আসলে একটা দুর্বলতা আছে। মানুষকে ভয়ের শেকলে বেঁধে রাখার মধ্যে মনুষ্যত্বের অপমান আছে। আমি নিজে নিত্যদিন আমার চেয়ে বেশি ক্ষমতা যে ধরে, তার চোখরাঙানিতে কুঁকড়ে থাকি, আর খুঁজে বেড়াতে থাকি, আমার চেয়ে দুবলা কে আছে, আমি তাকে ভয় দেখাব। একলা না পারি তো দল জুটিয়ে নেব।

আমি তাই দু’টাকা বাঁচানোর জন্য রিকশাচালক বা আনাজবিক্রেতার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করব। শান্তিপুর কি শেওড়াফুলি লোকালে আধখানা সিট অধিকার করার জন্য চার জনকে পিষে-মাড়িয়ে চলে যাব। পকেটমার বলে কাউকে সন্দেহ হল কি হল না, মেরে শেষ করে দেব। আমার চেয়ে অর্থবলে, শিক্ষাবলে কাউকে পিছিয়ে থাকা দেখলেই অপমান করব। যদি প্রৌঢ় হই তো অনুজকে হেয় করব। যদি উঠতি বয়সের হই তো, অগ্রজকে অসম্মান করব। মেট্রোতে সে দিন যাঁরা হাতের সুখ করছিলেন আর তার পাল্টা হিসেবে যাঁরা জ্যাঠা-ঠ্যাঙাও অভিযানের ডাক দিচ্ছেন বা খবরের কাগজের ছবি দেখে ফেসবুক প্রোফাইল শনাক্ত করার চেষ্টা করছেন, তাঁরা সকলে এই একই মানসিকতার এ-পিঠ, ও-পিঠ। দু’দলই ধোলাই মন্ত্রে দীক্ষিত। একই রকম অসহিষ্ণু এবং কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত। শক্তের ভক্ত, নরমের যম।

উপরিউক্ত সব ক’টা লক্ষণই চরিত্রে ফ্যাসিস্ট। ফ্যাসিস্ট নাগরিক ছাড়া তো ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র হয় না! গত কয়েক বছর ধরে অসহিষ্ণুতা এবং সামাজিক হিংসার যে চাষ দেশ জুড়ে হয়ে চলেছে, তাতে আরও কোথায় কারা কী ধরনের কাণ্ড ঘটানোর উৎসাহ আর সাহস পাবেন, তা ঈশ্বরই জানেন! মেট্রোর ঘটনায় কোনও বিশেষ শিবিরের ইন্ধন ছিল কি না, জানা যায়নি। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে বর্বরতার যে আবহটা তৈরি হয়ে রয়েছে, তা যে এমন ঘটনার পক্ষে অত্যন্ত অনুকূল, সেটা বুঝতে অসুবিধা নেই।

অনুমান করা অসঙ্গত নয়, মেট্রোর ওই মারমুখী যাত্রীরা অনেকেই এত দিন যখন ভ্যালেন্টাইন দিবসে বা বর্ষশেষে নাইটক্লাবে বানরসেনাদের দাপাদাপির খবর পড়েছেন বা লাভ জেহাদের কথা শুনেছেন, মনে মনে বলেছেন, ‘বেশ হয়েছে। ঠিক হয়েছে।’ প্যাড সাঁটা আন্দোলনের ধুম দেখে শিহরিত হয়ে ভেবেছেন, এই সব করেই দেশটা উচ্ছন্নে গেল! নইলে কলকাতা শহরের বুকে ঘনিষ্ঠ যুগলকে দেখলে এ যাবৎ মূলত কটূক্তি আর হাহুতাশই চালু ছিল। দমদম দাওয়াইটা নতুন সংযোজন। সেই সঙ্গে যে ভাবে জনমাধ্যমে (সোশ্যাল মিডিয়া) বিষয়টি নিয়ে তৎক্ষণাৎ রণং দেহি শুরু হয়ে গেল, তাতে একটা সংগঠিত প্রয়াসের ছাপ বেশ স্পষ্ট। ঘটনাটি যদি বা আচমকা ঘটে থাকে, সেটাকে লুফে নিতে যে প্রস্তুতির অভাব নেই, সেটা ভালই বোঝা যাচ্ছে। এবং যাঁরা এর প্রতিবাদে মুখর হচ্ছেন, তাঁদের একটা বড় অংশের ভাষা আর ভঙ্গিও সমান হিংস্র।

ফ্যাসিস্ট-ধর্মী লক্ষণগুলো আকাশ থেকে পড়েনি। পেটের তাগিদে বানরসেনায় নাম লেখানো বেকার যুবকের কথা এখানে হচ্ছে না। পেশাদার প্রচারক বা দীক্ষিত মৌলবাদীর কথাও নয়। প্রশ্নটা ছাপোষা আম আদমির মনের গড়ন নিয়ে। তার চোখের সামনে গত দু’দশকে চার পাশ দ্রুত বদলেছে। বনেদি বেড়িগুলো শিমুল তুলোর মতো উড়ে গিয়েছে বলেই নতুন করে বেড়ি পরানোর তাগিদও বেড়েছে। ব্যক্তি পরিসর আর সমাজ পরিসরের সংজ্ঞা গিয়েছে গুলিয়ে। জনমাধ্যমে অচেনা মানুষকেও মতের অমিল হলেই নির্দ্বিধায় অকথ্য গালিগালাজ করা যায়, পাশে বসা মানুষটি কিছু বললে ইয়ারফোন ভেদ করে কানে পৌঁছয় না।

নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের চালচলন-পোশাকআশাক, মৌখিক ও শরীরী ভাষা, নৈশবিহার-খানাপিনা ইদানীং সমাজের একটা বড় অংশের কাছে শুধু অপছন্দের নয়, ভীতিপ্রদও। সে নিজে গুরুজন-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এত কাল। বাপ-জ্যাঠার সামনে সিগারেট লুকিয়েছে, মুখের আগল রেখেছে। আজ তার সামনে সে সব বালাই উড়িয়ে দণ্ডায়মান স্মার্টফোন-নিবিষ্ট এক স্পর্ধিত প্রজন্ম। এই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে সে প্রায়শই কোনও থই পায় না। যৌন অবদমনের যে আবহাওয়ায় সে বড় হয়েছে, তাতে পুরী গিয়ে হাঁ করে পরস্ত্রীর জলকেলি দেখা চলে, নিজের বৌয়ের হাত ধরে নিজের শহরে বৃষ্টিতে ভেজা চলে না। আজ সেই একই অবদমন সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ দৃশ্যের জন্ম দিচ্ছে অহরহ। নিজেকে প্রতি পদে বিজ্ঞাপিত করাই এখন তার ধর্ম, বাজারে সে ব্যবস্থা আর প্ররোচনাও অফুরন্ত।

তদ্‌বিপরীতে এই ছাপোষা গেরস্ত কী কর্মক্ষেত্রে, কী পরিবারে, কী সমাজে কোথাও মনের মতো দাঁও মারতে পারেনি। বঞ্চনা, হতাশা, অনিশ্চয়তা বেড়েছে। বাড়তেই থেকেছে। কাউকে এক হাত নেওয়া হয়নি। পার্টির লোক তম্বি করেছে, চুপ থেকেছে। অফিসে বস ধমকেছে, গিলে নিয়েছে। পাশের বাড়ির হারুবাবু ছেলে-বৌ নিয়ে ব্যাঙ্কক গিয়েছে, সে মরমে মরেছে। বিশ্বাস করেছে, এ পৃথিবীতে তার ভাল কেউ চায় না।

পরাজয়ের এই ‘আমি’টা মেয়েদের মধ্যেও আছে। কিন্তু যে হেতু মেয়েরা শুধুমাত্র মেয়ে বলেই এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, তাদের হারজিতের বোধটা অন্য রকম। কিন্তু পুরুষের সব রকম পরাজয়ই অন্তঃস্থলে গিয়ে কোথাও না কোথাও তার পৌরুষকে আঘাত করে বসে। তাই তার হেরে যাওয়ার ভয় এবং হারের অনুভব অনেক বেশি, বিকল্প রণক্ষেত্র খুঁজে নিয়ে জয়ের আস্বাদ গ্রহণের তাড়নাও প্রবলতর। সে দিনের মেট্রো, অনুমান করি, প্রৌঢ় পুরুষ সহযাত্রীদের একাংশের কাছে এমনই এক যুদ্ধজয়ের সুযোগ হাজির করেছিল।

মারমুখী গৃহস্থ ভালই জানে, এ এক পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। আরও বহু যুদ্ধ আছে, যা তার জেতা হবে না। আরও অনেককে চাবকে সিধে করতে সাধ যাবে, সাধ্যে কুলোবে না। তাই সে মনে মনে সমাজ আর রাষ্ট্রকে এক অতিকায় পরিবার বা ইস্কুল বলে কল্পনা করতে শুরু করে। ভাবতে থাকে, রাগী বাবা বা কড়া মাস্টারের মতো করে কোনও ৫৬ ইঞ্চি যদি হাল ধরেন, তবে খানিকটা সামলানো যাবে। তিনি এমন ধমক দেবেন, সব্বাই ভাল করে পড়বে! কঠিন কঠিন অঙ্ক দেবেন, ভাল রেজাল্ট হবে! আমি যাদের ভয়ে সিঁটিয়ে আছি, তাদের পিলে চমকে যাবে!

ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের আবাহন এই ভাবেই ফ্যাসিস্ট নাগরিকের হাতে সম্পন্ন হয়। তাতে নিত্য ঘাসজল দেওয়ার মহতী প্রস্তুতিও থাকে। প্রচারযন্ত্র বরাবরই সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের খুব বড় হাতিয়ার। সেখানে অর্ধসত্য বা মিথ্যে কথা নাগাড়ে বলে বলে সত্যির মতো শোনায়। মুশকিল হল, লোক-ঠকানো প্রযুক্তির এই ভরা কোটালে এই একই রোগ অন্য পক্ষেও ছড়াচ্ছে। বিপদটা তাতে বাড়ছে। ফ্যাসিস্ট মনের দু’একটা ইট যদি বা আলগা হওয়ার দিকে যায়, উল্টো তরফের অবিমৃশ্যকারিতায় তা যথাস্থানে ফিরে আসছে। ঠিক যেমনটি মেট্রোর বেলায়। একাধিক মানুষ, নিশ্চিত জানি, ভাবছিলেন কাজটা ঠিক হয়নি। কিন্তু প্রবীণদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার হাঁকডাক তাঁদের ফের ক্ষুব্ধ করে তুলল। ফ্যাসিস্ট মন মজবুত হল, এ-পিঠ আর ও-পিঠে।

Intolerence Social violence Religion Crime
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy