Advertisement
১৯ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

উন্নয়নের অভাবই পরিচিতি, তার রাজনীতিই জেতার পথ

দ লিত ছেলেটার জন্য চাকরিতে সংরক্ষণের দাবিতে মিছিলে হাঁটুক ব্রাহ্মণ যুবক। কর্পোরেটের সিনিয়র ম্যানেজার প্রশ্ন করুন, সরকার কেন সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করবে না? যাঁর সন্তান শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ছে, তিনিও সরব হোন মিড ডে মিলের মান নিয়ে।

সংগ্রাম: ২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘অকুপাই’ আন্দোলন। ব্রিটেনে ‘অকুপাই লন্ডন’-এ এক প্রতিবাদী। গেটি ইমেজেস

সংগ্রাম: ২০১১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল ‘অকুপাই’ আন্দোলন। ব্রিটেনে ‘অকুপাই লন্ডন’-এ এক প্রতিবাদী। গেটি ইমেজেস

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

দ লিত ছেলেটার জন্য চাকরিতে সংরক্ষণের দাবিতে মিছিলে হাঁটুক ব্রাহ্মণ যুবক। কর্পোরেটের সিনিয়র ম্যানেজার প্রশ্ন করুন, সরকার কেন সবার জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা করবে না? যাঁর সন্তান শহরের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ছে, তিনিও সরব হোন মিড ডে মিলের মান নিয়ে।

যাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন, অধিকার আদায় করে নেওয়ার মতো সামাজিক জোর যাঁদের আছে, তাঁরা শুধু নিজের জন্য নয়, দাবি করুন পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্যও। একমাত্র তখনই উন্নয়ন পৌঁছোতে পারে সবার ঘরে, দুনিয়ার সব প্রান্তে।

প্রায় বৈপ্লবিক কথাখানা রয়েছে এ বছরের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট-এ। এ বছরের রিপোর্টের নাম ‘ডেভেলপমেন্ট ফর এভরিওয়ান’। সবার জন্য উন্নয়ন। রিপোর্ট বলছে, গত পঁচিশ বছরে গোটা দুনিয়ার সমৃদ্ধি বেড়েছে যে ভাবে, সব মানুষের কাছে তার সুফল সমান ভাবে পৌঁছোয়নি। কথাটা পরিচিত। এটাও জানা যে ফারাক শুধু এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের উন্নয়নের মাত্রায় নয়, ব্যবধান রয়েছে একই দেশের মধ্যে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও। এ বারের রিপোর্ট বলল, গোটা দুনিয়া জুড়েই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর চেহারায় মিল রয়েছে। উন্নয়নের নিরিখে পিছিয়ে রয়েছেন সংখ্যালঘুরা, মহিলারা, ঐতিহাসিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষরা, উদ্বাস্তুরা, দুর্গম অঞ্চলে থাকা মানুষরা। গোটা দুনিয়া জুড়েই রাষ্ট্রের কাছে তাঁরা উন্নয়নের সমান অধিকার পাননি।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান যে আসলে তিনটে আলাদা ঘেরাটোপে থাকা জিনিস নয়, একটার সঙ্গে অন্যগুলোর যোগ অবিচ্ছেদ্য এবং অনস্বীকার্য, একটার অধিকার কেড়ে নিলে যে অন্য অধিকারগুলোও ব্যাহত হয়, রিপোর্ট খুব জোরের সঙ্গে সে কথা বলেছে। জানিয়েছে, দুনিয়ার সর্বত্র কিছু মানুষ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকেছেন।

কী ভাবে সবার জন্য উন্নয়নের অধিকার আদায় করা যায়, এ বারের হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট তা নিয়েই। ঘুরেফিরেই এসেছে ‘এজেন্সি’-র প্রসঙ্গ। কিছু করতে পারার ক্ষমতারই নাম এজেন্সি। সেই ক্ষমতা সবার সমান নয়। উন্নয়নের সিঁড়িতে যাঁরা ওপরের ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন, এজেন্সিও স্বভাবতই তাঁদের বেশি। সেই ক্ষমতা কি পিছিয়ে পড়াদের উন্নয়নের অধিকার আদায়ের কাজে ব্যবহার করা যায়? রিপোর্ট জানিয়েছে, যায়। দাবি আদায়ের ক্ষমতা যাঁদের আছে, তাঁরা যদি শুধু নিজেরটুকু না ভেবে প্রান্তিক মানুষদের উন্নয়নের দাবি করেন, পিছিয়ে পড়া মানুষের অধিকার আদায় করতে চান, তা হলে রাষ্ট্রের ওপর অনেক বেশি চাপ তৈরি করা যায়। অনেক সহজ হয় যুদ্ধজয়।

রিপোর্টের পাতায় এই কথাগুলো কেমন অলীক ঠেকে। শুধু ভারতে বলেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই। যাঁরা ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দেন, অথবা যাঁরা হোয়াইট হাউসে অধিষ্ঠিত করেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে, এই দুনিয়া তো তাঁদেরই। অথবা, যাঁরা জাতীয় কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা যোজনাকে নিছক অপচয় মনে করেন, তাঁদের। এই দুনিয়া আপাতত তাঁদের অ-রাজনীতির। তাঁরা দাবি করবেন পিছিয়ে থাকার মানুষের উন্নয়ন? নিজের বাইরে, অথবা নিজের সংকীর্ণ শ্রেণিস্বার্থের বাইরে ভাবতে না পারা, ভাবতে না চাওয়াই এখন দুনিয়ার অভিজ্ঞান। ভারতে উচ্চবর্ণের ছাত্ররা সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন, ‘ইউথ ফর ইক্যুয়ালিটি’-র মঞ্চ তৈরি করে ফেলেন। সাম্য! কয়েক হাজার বছরের অসাম্য দূর করার জন্য যে সংরক্ষণ নীতি তৈরি হয়েছিল— মাত্র আড়াই দশকেই সেই নীতিকে দূর করে ‘সাম্য’ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারার নাম-ই অ-রাজনীতি। অথবা, এলপিজি-তে ভর্তুকির সঙ্গে খাদ্যে ভর্তুকিকে এক করে ফেলার নাম। যাঁরা পিছিয়ে আছেন, তাঁদের লড়াইয়ে নিজেকে শামিল করতে হলে বৃহত্তর ন্যায়ের কথা ভাবতে পারতে হয়। অ-রাজনীতি তারই অক্ষমতা।

রিপোর্টের আশাবাদটাকে সত্যি করে তুলতে হলে— এগিয়ে থাকা মানুষের মুখে পিছিয়ে থাকা মানুষের দাবিকে নিয়ে আসতে হলে— গোড়ায় এই অ-রাজনীতিকে হারাতে হবে। সেই কাজটা পারে রাজনীতিই— যা নিজের ছোট গণ্ডির বাইরে থাকা অন্যদের প্রতি সমমর্মী হতে শেখায়। ভারতীয় রাজনীতির রেটোরিকে বহু দিন অবধি এই দেখার কথা ছিল। তার পর খরস্রোতা উন্নয়ন এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সেই কথাগুলোকে। পড়ে থেকেছে ‘আম আদমি’, ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’, কিন্তু আক্ষরিক ভাবেই অর্থহীন সেই পড়ে থাকা। এই শূন্যতাতেই অ-রাজনীতির জন্ম। তার সঙ্গে লড়তে হলে, অতএব, ফাঁক ভরাট করতে হবে অধিকারের রাজনীতি দিয়ে। উন্নয়নের অধিকার।

মানব উন্নয়ন রিপোর্টে যাঁদের পিছিয়ে পড়ার কথা রয়েছে, সেই জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে সমান উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রথম কাজ— তাঁদের রাজনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসা। ভারতে আইডেন্টিটি পলিটিক্সের বহু সুফল ফলেছে, কিন্তু একটা মস্ত ক্ষতিও হয়েছে— বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিচিতির রাজনীতি থেকে যে দাবিগুলো উঠেছে, তা থেকে গিয়েছে সেই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব দাবি হিসেবেই। সেই দাবিগুলো যে সর্বজনীন উন্নয়নেরই দাবি, এই কথাটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এবং, তার থেকেই তৈরি হয়েছে পরিসরের, স্বার্থের সংঘাত। দলিতদের জন্য সংরক্ষণের দাবিতে উচ্চবর্ণের চাকরির সুযোগ খানিক কমলেও সেই দাবি যে আসলে প্রকৃত উন্নয়নেরই দাবি, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতির নয়, এই কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি। এই ফাঁক গলেই অ-রাজনীতি ক্রমে বৈধতা পেয়েছে। কাজেই, তার সঙ্গে লড়তে হলে বলতে হবে, দলিতদের বা মুসলমানদের বা কাশ্মীরিদের বা মেয়েদের দাবি শুধু তাঁদেরই নয়, সেই দাবি উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত প্রতিটি মানুষের। এই কথাটা ক্লান্তিহীন ভাবে বলে চললে রাজনীতির মূল মঞ্চ কথাটাকে স্বীকার করতে বাধ্য। অ-রাজনীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের সেটা প্রথম ধাপ।

তার জন্য নিজের নিজের খোপের বাইরে এসে ভাবতে হবে। সংখ্যালঘু, দলিত বা কাশ্মীরি মানুষের রাজনীতি যে আসলে উন্নয়নের দাবিতে রাজনীতি, এই কথাটা প্রতিটি পরিচিতির রাজনীতিকে স্বীকার করতে হবে। তাদের প্রত্যেকের আসল পরিচিতি যে উন্নয়নের অভাব, এই কথাটা স্পষ্ট করে বলতে হবে। তাদের লড়াইগুলো আসলে আলাদা নয়, পরস্পরের বিরোধীও নয়। উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত করে রাখার বিরুদ্ধে লড়াই কখনও স্বতন্ত্র হয় না। রাজনীতির মূলস্রোতে উন্নয়নের এই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে পারাই এখন কাজ।

রাজনীতি ছাড়া কি উন্নয়ন হয়?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Development Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE