Advertisement
E-Paper

পুরস্কার কি খুঁটির জোরে?

পঞ্চমীর দুপুরে প্রথম দশ থেকে সেরা পুজো বাছার প্রক্রিয়া শুরু। ফের হাজির ওই দুই কর্তা। উদ্যোক্তারা ফের বিচারকদের বললেন, ‘ওই মন্ত্রীর পুজোকে সেরার পুরস্কার দিতেই হবে। বিচারের নিরপেক্ষতা থাকছে না জেনেও, নিরুপায় হয়েই বলছি।’ বিচারকদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন।

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
সমাদর: পুজো দেখতে উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু ভিড়ের ভাল লাগলেই হল না, পুরস্কার পেতে চাই সুপারিশের জোর

সমাদর: পুজো দেখতে উপচে পড়া ভিড়। কিন্তু ভিড়ের ভাল লাগলেই হল না, পুরস্কার পেতে চাই সুপারিশের জোর

চতুর্থীর সকাল। চূড়ান্ত পর্বের বিচার চলছে। বিচারকেরা মণ্ডপ, প্রতিমা, আলোকসজ্জা ধরে ধরে প্রতিটি পুজোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। হঠাৎ এক বাণিজ্যিক সংস্থার দুই বড়কর্তা দরজা ঠেলে ঢুকলেন। ওই সংস্থাই পুরস্কারটির মূল স্পনসর। উদ্যোক্তাদের আড়ালে ডেকে নিলেন ওই দু’জন।

মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এলেন উদ্যোক্তারা। বিচারকদের উদ্দেশে তাঁদের কাতর আবেদন, ‘একটা পুজোকে প্রথম দশের মধ্যে রাখতেই হবে। উপর থেকে চাপ আসছে।’ সেটি রাজ্যের এক মন্ত্রীর পুজো। মন্ত্রীর নাম করে তাঁর এক ঘনিষ্ঠ জন শাসিয়ে গিয়েছেন, পুরস্কারের তালিকায় নাম না থাকলে কপালে বিপদ আছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ থমকে গেল। মন্ত্রীর পুজো ঢুকে পড়ল প্রথম দশের তালিকায়। সঙ্গে অন্য দুই মন্ত্রীর পুজোও।

পঞ্চমীর দুপুরে প্রথম দশ থেকে সেরা পুজো বাছার প্রক্রিয়া শুরু। ফের হাজির ওই দুই কর্তা। উদ্যোক্তারা ফের বিচারকদের বললেন, ‘ওই মন্ত্রীর পুজোকে সেরার পুরস্কার দিতেই হবে। বিচারের নিরপেক্ষতা থাকছে না জেনেও, নিরুপায় হয়েই বলছি।’ বিচারকদের কেউ কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানতেই হল।

একটা সময় ছিল যখন কালীপুজো পুরোটাই ছিল দাদাদের পুজো। ক্লাবের নাম সেখানে গৌণ। কোনওটা সোমেন মিত্রের পুজো, কোনটা ফাটাকেষ্টর। সেই সব দাদাদের কেউ প্রয়াত হয়েছেন। কারও ক্ষমতা কমেছে। এখন শাসক দল তৃণমূলের দাদারা নেমে পড়েছেন দুর্গাপুজোয়। দাদাদের ক্ষমতা যাঁর যত, তাঁর পুজোর জৌলুসও তত। কোনওটা পার্থদার (মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়) পুজো, কোনওটা ববিদার (মন্ত্রী ববি হাকিম), কোনওটা অরূপদা (মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস) বা সুজিতদার (বিধায়ক সুজিত বসু)। কলকাতার বাসিন্দা, রাজ্যের আরও পাঁচ মন্ত্রী: সাধন পাণ্ডে, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, শশী পাঁজা এবং ইন্দ্রনীল সেনও কোনও না কোনও পুজোর সঙ্গে অাষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। তবে সেগুলি এখনও সাধনদা, শোভনদা, চন্দ্রিমাদি শশীদি কিংবা ইন্দ্রদার পুজো বলে ব্র্যান্ডিং পায়নি।

আর দুই দাদাও কলকাতার পুজোয় স্বমহিমায় বিরাজমান। তাঁরা দু’জনই পুরস্কার-টুরস্কারের ধার ধারেন না। এক জন মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। অন্য জন কংগ্রেস-তৃণমূল-কংগ্রেস-বিজেপি ঘুরে এখন দোলাচলে থাকলেও, তাঁর পুজোয় লক্ষ লোকের সমাগম হয়। তিনি সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার (লেবুতলা পার্ক)-এর প্রদীপ ঘোষ।

পুজোর দাদাগিরিতে কাউন্সিলররাও কিছু কম যান না। মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষের হাতে রয়েছে উত্তর কলকাতার বেশ কয়েকটি পুজো। মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার হলেন ত্রিধারার পুজোর হর্তাকর্তা। মেয়র পারিষদ রতন দে ৯৫ পল্লির পুজোর মূল উদ্যোক্তা। প্রাক্তন মেয়র পারিষদ সুশান্ত ঘোষ দক্ষিণের একটি পুজোর মূল পৃষ্ঠপোষক। মেয়র পারিষদ দেবব্রত মজুমদারও একটি বড় পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সেই পুজো কোনও প্রতিযোগিতায় নাম দেয় না। পুজোর বাজারের খবর: বেহালার বড়িশা ক্লাবের পুজোও এখন এক তৃণমূল কাউন্সিলরের করতলগত।

তৃণমূলের বড়, ছোট, মাঝারি নেতাদের প্রায় সবারই কলকাতা জুড়ে ছোট-বড় পুজো রয়েছে। এখন মুখ্যমন্ত্রীর দুই ভাইয়ের কালীঘাট মিলন সংঘও কলকাতার বড় পুজোর মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে।

দাদাদের পুজোর দাদাগিরিতে অন্য পুজোগুলির দফারফা। কোনওটা ঘুরপথে দাদা ধরে, কিংবা নবান্ন অথবা হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের কাছাকাছি গিয়ে নিজেদের পুজো টিকিয়ে রাখতে চাইছে। স্পনসর টানতে, বিজ্ঞাপনদাতাদের ধরে রাখতে কেউ আবার পুজো কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মন্ত্রী, বিধায়ক, কাউন্সিলরদের রেখে শেষরক্ষা করতে চাইছে।

একটা সময় ছিল যখন একটি রং কোম্পানি প্রতিমাশিল্পী, মণ্ডপশিল্পী এবং অালোকশিল্পীদের স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পুরস্কার দিত। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা নবীন শিল্পীরা সেই সময় থেকে নিজেদের যুক্ত করলেন পুজোর ভাবনা তৈরির সঙ্গে। কলকাতার সর্বজনীন পুজোয় চালু হল ‘থিম’। প্রতিমা, মণ্ডপ, আলোকসজ্জা মিলে একটা প্যাকেজ। তার পর পুজোগুলিকে উৎসাহ দিতে (এবং নিজেরা প্রচার পেতে) এসে গেল আরও কিছু সংস্থার বেশ কয়েকটি পুরস্কার।

বছর দশেক আগে পুজো পুরস্কারের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করল কলকাতা পুরসভা। শুরু হল ‘কলকাতাশ্রী পুরস্কার’। উদ্দেশ্যটা ছিল খুবই সাধু। বড় বড় পুজো কমিটির নীচে যে সব ছোট ছোট পুজো চাপা পড়ে গিয়েছে, তাদের তুলে আনতেই কলকাতা পুরসভা এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেন বিচারকেরা। আর্থিক সাহায্য পেয়ে ওই পুজোগুলি যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারে, সেটাই ছিল লক্ষ্য।

আর তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চালু করলেন ‘বিশ্ববাংলা পুরস্কার’। সেটাও কলকাতা পুরসভার অন্তর্গত পুজোগুলির জন্য। উদ্দেশ্য: বাংলার লোকশিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। কলকাতাশ্রীর মতো, এই পুরস্কারেরও লক্ষ্য ছিল বড় পুজোর আড়ালে চাপা পড়ে যাওয়া ভাল ভাল শিল্পকর্মগুলিকে বের করে এনে, স্বীকৃতি দেওয়া।

কিন্তু ফল দাঁড়াল উলটো। কলকাতাশ্রী এবং বিশ্ববাংলা পুরস্কারপ্রাপকদের গত কয়েক বছরের রেকর্ড ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের তিন মন্ত্রী— পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ববি হাকিম এবং অরূপ বিশ্বাসের নাকতলা উদয়ন সংঘ, চেতলা অগ্রণী এবং সুরুচি সংঘকে সেরা পুজোর তালিকা থেকে কেউ সরাতে পারেনি। শুধু এই তিনটে পুজোই নয়, এই দুই পুরস্কারের তালিকায় ঝলমল করছে তৃণমূলের মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, মেয়র পারিষদ এবং কাউন্সিলরদের সুপারিশের পুজো। যাঁর সুপারিশের জোর যত বেশি, তাঁর এলাকা থেকে তত বেশি পুজো কমিটি ঠাঁই পাচ্ছে এখানে। এটাও লক্ষণীয়, যে সব পুজো মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন, সেগুলোর ক্ষেত্রে পুরস্কার একেবারে বাঁধা।

আর তার ফলে কী হচ্ছে? যে সব পুজো কমিটি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্পনসর জোগাড় করে কোনও রকমে ভাল পুজো দাঁড় করিয়েছে, তাদের খুঁটির জোর না থাকায় জুটছে না কোনও পুরস্কার। নবীন কোনও শিল্পীর ভাল কাজ পাচ্ছে না বিশ্ববাংলা কিংবা কলকাতাশ্রীর স্বীকৃতি। আর যে সব পুজো কমিটির পিছনে শাসক দলের কোনও নেতা রয়েছেন, কাজের মানে চোখ না টানলেও, পুজো দেখতে দর্শক তেমন না এলেও, স্রেফ সুপারিশেই বাজিমাত করছে তারা।

বিশ্ববাংলা এবং কলকাতাশ্রী পুরস্কারপ্রাপকদের বাড়তি পাওনা: রেড রোডের কার্নিভালে সুযোগ পাওয়া। এ বার তাই ওই দুই পুরস্কার নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা হয়েছে তৃণমূলের নেতা, কাউন্সিলর, বিধায়কদের মধ্যে। তাতেই বাদ পড়ে গিয়েছে এ বার কলকাতায় বহুচর্চিত কয়েকটি পুজো। মন্ত্রী, বিধায়কদের চাপ উপেক্ষা করেই কয়েকটি বাণিজ্যিক সংস্থা কিছু পুরস্কার দিয়ে থাকে। তাদের বিচারকদের বিচারে, ওই ক’টি পুজোর নাম জয়ীদের তালিকার উপরের দিকেই ছিল। বিশ্ববাংলা এবং কলকাতাশ্রী পুরস্কারের উদ্যোক্তারা অবশ্য এই অভিযোগ মানতে চান না।

কথিত আছে, তৃণমূল নেত্রী কোনও বিরোধিতা, কোনও প্রতিযোগিতা পছন্দ করেন না। দিদির ঘনিষ্ঠদের মধ্যেও এই রোগ কিন্তু ছড়িয়েছে। তাই বিশ্ববাংলা, কলকাতাশ্রীর মতো দুটি বড় মাপের (আর্থিক দিক থেকেও বড় মাপের) পুরস্কার জিতেও তাঁদের আশ মিটছে না। এক মন্ত্রী নাকি তাই ঠিক করেছেন, চাপ দিয়েই সব বাণিজ্যিক সংস্থার পুরস্কার জিতে নেবেন। সব ক্ষেত্রে সফল না হলেও, যেখানে-যেখানে বড় অঙ্কের পুরস্কার রয়েছে, সেই সব পুজোয় তালিকার প্রথমেই ওই মন্ত্রীর পুজোটি।

এখন বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি প্রমাদ গুনছে। একটি বাণিজ্যিক সংস্থার এক কর্তার মন্তব্য, ‘সব মন্ত্রী, নেতারা এ বার আমাদের চাপ দিতে শুরু করলে, অন্য কোনও ক্লাবই প্রতিযোগিতায় নাম দিতে চাইবে না। আমাদের গোটা উদ্যোগটাই তো মাঠে মারা যাবে।’

Durga Puja Award Prize Ruling Party
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy