Advertisement
E-Paper

এই কি গরিবের বাজেট?

চাষিদের রোজগার দ্বিগুণ হবে বলে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন যিনি, তাঁর ইনিংস শেষ হচ্ছে গরিব চাষিদের ঘরে মাসে পাঁচশো টাকা পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাসে

শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০

চাষিদের রোজগার দ্বিগুণ হবে বলে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন যিনি, তাঁর ইনিংস শেষ হচ্ছে গরিব চাষিদের ঘরে মাসে পাঁচশো টাকা পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাসে। এতেই নাকি খেলার মোড় ঘুরে যাবে। তা-ই কি? না কি

ভোট-শেষে শূন্য হাতে ঘরে ফিরবেন গ্রামের গরিব?

এ দেশে চাষি কারা? ১) যাঁদের চাষের জমি আছে, ২) যাঁরা ভূমিহীন খেতমজুর ৩) যাঁরা অন্যের জমি ভাগে বা ঠিকা নিয়ে চাষ করেন। এই তৃতীয় বর্গের লোকেদের নিজের জমি থাকতে পারে, নাও পারে। যাঁদের পাঁচ একরের কম জমি আছে, সরকারি হিসেবে তাঁদের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি বলা হয়। ২০১১ সালের হিসাব অনুযায়ী, আঠারো কোটি গ্রামীণ গৃহস্থালির মধ্যে দশ কোটি চাষের জমির মালিক। এঁদের মধ্যে নয় কোটির জমির পরিমাণ পাঁচ একরের কম, তাই মাসিক পাঁচশো টাকা অনুদানের আওতায় আসতে পারেন। সরকার অবশ্য নয় কোটি বলছে না, বলছে বারো কোটি। সেটা কৃষি সেন্সাসের হিসেব, কিন্তু লক্ষণীয়, সেন্সাস জমির মালিকানা দেখায় না।

ভূমিহীন খেতমজুর প্রায় দু’কোটি। তাঁরা আরও গরিব হলেও এই বরাদ্দের আওতায় আসবেন না। ঠিকা চাষির হিসাব পাওয়া কঠিন, কারণ পঁচিশটা রাজ্যে ‘লিজ়’ বা ঠিকা প্রথা বেআইনি। তবে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা বলছে, ভারতে চোদ্দো শতাংশ, অর্থাৎ আড়াই কোটি গৃহস্থালি ঠিকা চাষের উপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ক’জনের নিজের জমি আছে, বলা কঠিন। ফলে কত ঠিকা চাষি মাসিক পাঁচশো টাকা বরাদ্দের আওতায় আসবেন, জানা নেই।

২০১৪ সালের জাতীয় সমীক্ষার হিসাব অনুযায়ী, গরিব চাষিদের গড়পড়তা আয় মাসিক সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা, আর ব্যয় সাড়ে ছ’হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসিক পাঁচশো টাকা ঘরে এলে উপকারই হবে। কিন্তু আসবে কী করে? এই ন’কোটি চাষিকে চিহ্নিত করতে হবে। তার উপায় চাষের জমির রেকর্ড। তেলঙ্গানায় আটান্ন লক্ষ জমির নথিপত্র নবীকরণ করে তাদের চিহ্নিত করতে সময় লেগেছিল এক বছর। ২০০৮ সাল থেকে দেশ জুড়ে জমির রেকর্ড নবীকরণ করার কাজ চলছে। দশ বছর পরেও ষাট শতাংশ কাজ বাকি। কাজেই জমির রেকর্ড ঠিক করে, ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট আর আধার কার্ডের সঙ্গে নাম মিলিয়ে, চাষিকে মাসে পাঁচশো টাকা পৌঁছে দেওয়া বহু দূরের স্বপ্ন।

গরিব চাষি, ঠিকা চাষি, ভূমিহীন খেতমজুর, এঁদের সকলেরই আরও কাজ, আরও রোজগার দরকার। পরিকল্পনা হয়েছিল একশো দিনের কাজের প্রকল্পের। এই প্রকল্পে গত বছর একষট্টি হাজার কোটি টাকা দরকার হয়েছিল। এ বছর ষাট হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কাজেই ভরসা মেলে না। তা ছাড়া একশো দিনের কাজ চালু হওয়ার এক যুগ পরেও গড়পড়তা পঁয়তাল্লিশ দিন কাজ পাচ্ছে গ্রামের গরিব মানুষ। কিন্তু মজুরি পেতে দুই মাস থেকে আড়াই মাস দেরি হচ্ছে। মজুরির অঙ্কও দেশের ন্যূনতম কৃষি মজুরির সমান নয়, তার অর্ধেক। সরকারি ন্যূনতম কৃষি মজুরি দিনে তিনশো টাকা হলে, একশো দিন কাজ পেলে, গরিবের ঘরে আসত ত্রিশ হাজার টাকা। গ্রামে কিছু সম্পদও তৈরি হত। সেখানে দশ কোটি গরিবের জন্য বরাদ্দ— বছরে ছ’হাজার টাকা।

চাষি ও খেতমজুর ছাড়াও আছেন প্রায় বিয়াল্লিশ কোটি শ্রমিক, যাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। ২০১৫ সালে তাঁদের জন্য এসেছিল অটল পেনশন যোজনা। বলা হয়েছিল, মাসে মাসে টাকা জমালে ষাট বছর বয়স থেকে পেনশন পাবেন। সরকার শুধু পাঁচ বছর টাকা দেবে, সর্বাধিক এক হাজার টাকা। নতুন বাজেটে সেই যোজনার উল্লেখ নেই। বদলে এসেছে নতুন পেনশন যোজনা। আঠারো থেকে ত্রিশ বছর বয়সের মধ্যে এই যোজনায় নাম লেখালে ষাট বছর বয়স পর্যন্ত মাসে পঞ্চান্ন টাকা থেকে একশো টাকা দিতে হবে। সরকারও সমান হারে পাঁচ বছর টাকা জমা দেবে। ষাট বছর বয়স থেকে মাসে তিন হাজার টাকা পেনশন চালু হবে।

কিন্তু এই তিন বছরে অটল পেনশন যোজনার কী হল? বিয়াল্লিশ কোটির মধ্যে মাত্র এক কোটি শ্রমিক এই যোজনায় নাম লিখিয়েছেন, মানে আড়াই শতাংশ। কাজেই নতুন যোজনায় যদি অটল যোজনার ডবল হারেও বাকিরা নাম লেখাতে এগিয়ে আসেন, তবু দশ কোটি শ্রমিককে এই যোজনায় আনতে পনেরো বছর সময় লাগবে।

আরও আছে। এই শ্রমিকরা বছরে সব সময়ে কাজ পান না। তখন মাসে একশো টাকা দিতে পারবেন কি? ৪২ বছর ধরে টাকা জমানো মধ্যবিত্ত মানুষের পক্ষেই বেশ কঠিন, শ্রমিকদের পক্ষে তো আরও। অসংগঠিত শ্রমিক, যাঁরা অধিকাংশই দলিত-আদিবাসী, তাঁদের অনেকেই এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত যে ৪০-৪৫ বছরের পর আর কাজ করতে পারেন না। তখন তাঁরা সব টাকাটাই হারাবেন। উদ্বেগ আরও। দলিত ও আদিবাসীদের প্রত্যাশিত আয়ু গড়ে তেষট্টি এবং ষাট বছর। তার মানে পেনশন নিতে এই শ্রমিকদের অনেকেই জীবিত থাকবেন না। কিসের আশায় তবে বুক বাঁধবে গ্রামের গরিব?

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়ের শিক্ষক

Budget Economy Finance
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy