Advertisement
E-Paper

শ্রমিক নিখোঁজ হলে তবেই হুঁশ?

ফোনে ধরতে না পেরে আত্মীয়েরা ছুটলেন প্রথমে পঞ্চায়েত সদস্য, বিডিও, মহকুমাশাসকের কাছে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন শ্রমিকের সচিত্র পরিচয়পত্র।

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:০০
ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

বন্যায় ডুবল কেরল। আশঙ্কায় রাত জাগল পশ্চিমবঙ্গ। ঘরের লোকটা ঠিক আছে তো? সুস্থ আছে? নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, মালদহ, সর্বত্রই ছবিটা ছিল এই রকম। এ রাজ্যের প্রায় কুড়ি লক্ষ শ্রমিক ভিনরাজ্যে কাজ করতে যান। এঁদের একটা বড় অংশ কাজ করেন কেরলে। সেখানে রোজগার বেশি। কিন্তু খোঁজ না মিললে বাড়ে উদ্বেগ। ফোনে ধরতে না পেরে আত্মীয়েরা ছুটলেন প্রথমে পঞ্চায়েত সদস্য, বিডিও, মহকুমাশাসকের কাছে। সঙ্গে নিয়ে গেলেন শ্রমিকের সচিত্র পরিচয়পত্র। জেলা প্রশাসন খোঁজ নিতে শুরু করল, কোন গ্রাম থেকে কত শ্রমিক কেরলে গিয়েছে। বিডিওদের নিয়ে তৈরি হল কমিটি। দ্রুত তালিকা করে পাঠানো হল নবান্নে। তিন থেকে চার দিনের মধ্যে শুধু মুর্শিদাবাদেই সাত হাজার শ্রমিকের তালিকা তৈরি হল।

জেলা প্রশাসনের এক কর্তা অবশ্য জানাচ্ছেন, কেরলে কাজে-যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যাটা অন্তত ত্রিশ হাজার। অসম্পূর্ণ হলেও, এই প্রথম মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসন একটা তালিকা তৈরি করল, যেখানে রয়েছে শ্রমিকের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, কেরলের কোথায়, কী কাজে তিনি গিয়েছিলেন। এত দিন সে তথ্য কোথাও ছিল না। মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক পি উলাগানাথন জানিয়েছেন, বিশেষজ্ঞ সংস্থাকে দিয়ে সমীক্ষা করানো হবে। ভিনরাজ্যে কর্মরত শ্রমিকরা কোথায়, কী কাজে যাচ্ছেন, কার সঙ্গে যাচ্ছেন, সেখানে যোগাযোগ কী, সব তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

কেন এত দিনে তালিকা তৈরি হয়নি? চোর পালালে যেমন বুদ্ধি বাড়ে গৃহস্থের, তেমনই শ্রমিক বিপাকে পড়লে তবেই হুঁশ হয় প্রশাসনের। ইরাকে কাজে গিয়ে দীর্ঘ দিন নিখোঁজ ছিলেন দুই শ্রমিক। মাস কয়েক আগে কফিনবন্দি দেহাবশেষ ফিরেছে। তাঁরা কাদের সঙ্গে, কেন, কী কাজে গিয়েছিলেন— এ সব জানতে প্রশাসনকে বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। কখন? অবশ্যই নিখোঁজ হওয়ার পরে।

বন্যার্ত কেরল থেকে ভগ্নস্বাস্থ্য নিঃস্ব শ্রমিকেরা কেউ কেউ ফিরেছেন। কিন্তু সবাই কি ফিরেছেন? বলা কঠিন। পুরুষ নির্মাণকর্মীদের মতো অনেক মহিলাও গৃহস্থালির কাজ করতে যান কেরলে। তাঁদের খোঁজ কে করছে? মোবাইল ফোন যোগাযোগের সুবিধে বাড়িয়েছে, অসুবিধাও করেছে। ডোমকল, জলঙ্গি, করিমপুরে বহু পরিবার বলছে, চিঠির পাট উঠে গিয়েছে, তাই বাড়ির মানুষটির ঠিকানা জানেন না। মোবাইল বন্ধ মানেই সব অন্ধকার।

কিন্তু প্রশাসনও কেন অন্ধকারে? শ্রম দফতরের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ভিনরাজ্যে যে ঠিকাদারেরা শ্রমিক নিয়ে যান তাঁদের এ রাজ্যের শ্রম দফতরের কাছে অনুমতি নেওয়ার কথা। ঠিকাদাররা তা এড়িয়ে যান। কেন? কেউ বলছেন, অনেক হ্যাপা। কারও সাফাই, ‘‘কেরলে শ্রমিকদের নিয়ে গেলে সেখানকার পঞ্চায়েত, থানা, বাড়ির মালিকের কাছে আধার কার্ড, ভোটার কার্ডের কপি জমা দিতে হয়। কিন্তু এখানে কিছু করতে হয় বলে তো শুনিনি।’’

কারণটা হয়তো অন্য। শ্রম দফতরের লাইসেন্স পেতে হলে শ্রমিকদের মাথাপিছু টাকা আগাম জমা রাখতে হয়। মজুরি, চিকিৎসা, ঘরভাড়া প্রভৃতি বিষয়ে মজুরের সঙ্গে যা চুক্তি, ঠিকাদার তা লঙ্ঘন করলে ওই টাকা শ্রমিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তাতে স্বভাবতই অনাগ্রহী ঠিকাদার। তাই লাইসেন্সহীন ঠিকাদারি চলছে। শ্রম দফতর দেখেও দেখে না। শ্রমিক সংগঠনও উদাসীন। বিভুঁইয়ে শ্রমিক অসুস্থ হলে, দুর্ঘটনায় আহত হলে, কোনও মামলায় পুলিশ গ্রেফতার করলে, মজুরির টাকা না পেলে, শ্রমিক বা তার পরিবার অসহায়।

নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সীমান্ত-ঘেঁষা কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, বছর দশেক আগে ভিনরাজ্যে বিপাকে পড়েছিলেন কয়েক জন মহিলা। তার পর নিয়ম হয়, কাজে বাইরে গেলে পঞ্চায়েতকে জানিয়ে যেতে হবে। কিছু দিন পরে আবার যে কে সেই। বিদেশে কাজে যাবেন বলে অগ্রিম টাকা নিয়ে প্রতারিত হন নদিয়ার বেশ কিছু লোক জন। তাঁদের কয়েক জন এখন একটা সংগঠন তৈরি করে এ ব্যাপারে প্রচার করছেন। তা যে যথেষ্ট নয়, তাঁরাও জানেন।

এ রাজ্যে যথেষ্ট কাজ আছে, আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রমিক তাতে ভরসা পেয়েছেন কি? একটি বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষা অনুসারে, কেরলে ভিনরাজ্যের শ্রমিকের সংখ্যা অন্তত পঁচিশ লক্ষ। তার মধ্যে পাঁচ লক্ষ পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিক। সেই সংখ্যা বে়ড়েই চলেছে। বন্যা থেকে বেঁচে, ত্রাণশিবিরে থাকার পর যাঁরা ঘরে ফিরেছেন, তাঁরাও খোঁজ নিচ্ছেন, কেরলে জল নামছে কি না। কবে ফের কাজ শুরু হবে। সিতাবুল ইসলাম, মইনুদ্দিন মণ্ডল, মহম্মদ পিয়ার বলছেন, ‘‘এখানে রাজমিস্ত্রির মজুরি সাড়ে চারশো টাকা। কেরলে মজুরি সাড়ে আটশো। ওভারটাইম করলে আরও বেশি। কোথাও কোথাও কাজের সঙ্গে থাকা খাওয়া ফ্রি। এখানে কে দেবে?’’ কাজ যদি না-ও দিতে পারে, কাজে-যাওয়া মানুষের সুলুকসন্ধান কি রাখতে পারে না রাজ্য?

Kerala Flood Flood Calamities কেরল Labour Rules
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy