Advertisement
E-Paper

অস্ত্রের এই একটানা উৎসব আর কোন রাজ্যে দেখি

সম্প্রতি দিনের পর দিন রাজ্যের সর্বত্র দলে-দলে মারমুখী মানুষ জড়ো হয়েছে, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে। অশেষ হিংসা হানাহানি হয়েছে। বহু লোকে দাবি করছেন তাঁদের আইনসঙ্গত কার্যকলাপে বাধা দেওয়া হয়েছে।

সুকান্ত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৮ ০০:০৮

এই লেখা লজ্জা ও গ্লানির প্রকাশ। আমার মতো পশ্চিমবঙ্গবাসী সব ক্ষমতাহীন মানুষের লজ্জা, আমাদেরই আত্মগ্লানি। এমন মানুষরা ক্ষমতাবানদের ভয় পায়, আমিও পাই সমান মাত্রায়। ক্ষমতাবানদের রুষ্ট করা আমার উদ্দেশ্য নয়।

সম্প্রতি দিনের পর দিন রাজ্যের সর্বত্র দলে-দলে মারমুখী মানুষ জড়ো হয়েছে, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে। অশেষ হিংসা হানাহানি হয়েছে। বহু লোকে দাবি করছেন তাঁদের আইনসঙ্গত কার্যকলাপে বাধা দেওয়া হয়েছে। মহিলারা অপমান ও শারীরিক নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। এ সবই আমরা টিভির পর্দায়, সংবাদপত্রের ছবিতে দেখেছি। ভুললে চলবে না, এর ঠিক আগে অন্য উপলক্ষে, বহুলাংশে অন্য লোকের দ্বারা বিদ্বেষ হিংসা অস্ত্রসজ্জা আইনভঙ্গের আর এক দফা উৎসবও পালিত হয়েছে।

কোনও সীমিত এলাকা নয়, একটা আস্ত রাজ্য জুড়ে এত দিন একটানা এতটা হিংসাত্মক উত্তেজনা, অস্ত্র ও পেশিশক্তির এত খোলাখুলি আস্ফালন ভারতের আর কোন রাজ্যে শেষ কবে দেখা গিয়েছে, চট করে মনে পড়ে না। নজির টানতে যেতে হবে দক্ষিণ সুদান, কঙ্গো গণরাজ্য বা লাতিন আমেরিকার কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলে। এই অবস্থা আমরা গ্রহণ করেছি, হয়তো অনেকের চোখে গ্রহণ করতে তেমন অসুবিধা নেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের ধ্যানধারণার আরও কিছু পরিবর্তন, যা অজ্ঞাতে আমরা বহু দিন মেনে আসছি, স্পষ্ট ও সম্পূর্ণ ভাবে সাধিত করলে আমাদেরই স্বস্তি।

প্রথম কথা: অনেকে হয়তো ভাবছেন, এই অশান্তি যে হেতু রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নির্বাচনের বিষয়টিকে ঘিরে, আমরা নির্বিবাদ অরাজনৈতিক মানুষ তাতে নাক গলাই কেন? নাক গলাবার প্রশ্নই নেই। দু’এক জন হতভাগ্য পথচারী লক্ষ্যভ্রষ্ট গোলাগুলিতে প্রাণ হারান, সংখ্যার হিসাবে তাঁরা ধর্তব্য নন। তবে ভাবা দরকার, এত অস্ত্র, এত লাঠিবাঁশ, এত উদ্যোগ-উত্তেজনা কি এর পর আগামী নির্বাচন পর্যন্ত উধাও হয়ে যাবে? যতই সাবধানে চলি না কেন, কখনও কোনও সূত্রে সে সব আমাদের উপর নেমে আসবে না তো? যে ক্ষমতা বা যে সুযোগসুবিধা লাভের জন্য এত হানাহানি, আগামিকাল তা আমাদের কোনও ভাবে বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে না তো? তেমন সম্ভাবনা বাস্তব, হয়তো অবশ্যম্ভাবী ধরে নিতে যদি এখনও আমাদের দ্বিধা থাকে, তা যেন আমরা দূর করি।

সেই সঙ্গে যেন ত্যাগ করি বহু দিনের এক গর্ব। আমরা বলতে ভালবাসি বাঙালিরা রাজনৈতিক ভাবে সচেতন জাতি। অন্যান্য রাজ্যের অজ্ঞ গ্রাম্য জনতা মোড়ল-মুখিয়ার হুকুম মতো ভোট দেয় বা দেয় না, পশ্চিমবঙ্গে নাকি তা হওয়ার জো নেই। যখন এমন কথা আমরা গলা ফাটিয়ে বলতাম, সেই সময় থেকেই কিন্তু আমাদের নাগরিক সত্তার স্বাধীন প্রকাশ খর্ব হয়ে চলেছে। আজ তা নিয়ে বড়াই করলে আমরা হাস্যাস্পদ হব। বরং স্বীকার করি, যে রাজ্যগুলির অধিবাসীদের রাজনৈতিক মূঢ়তার কথা আমরা বলতাম, তার অনেকগুলিতে আজ সাধারণ মানুষরা প্রবল শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে, কিছু জিতছে কিছু হারছে। আর আমরা ঠিক করেছি, ঢের হয়েছে, আমাদের রাজনৈতিক অধিকার ক্ষমতাবানের হাতে সঁপে দিয়ে আমরা দায়মুক্ত হব।

আর এক বিষয়েও আমাদের শিখে-বুঝে নিতে হবে। আমরা জেনে এসেছি, দেশে একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা আছে যার নানা কাজের মধ্যে একটা হল আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, আরও মৌলিক স্তরে নাগরিক স্বস্তি ও সুব্যবস্থার কতকগুলি নীতি বা শর্ত রক্ষা করা। এই লক্ষ্য পুরোপুরি পালন হওয়া দূরের কথা, তার উদ্যোগ যে চরম ত্রুটিপূর্ণ ও নীতিভ্রষ্ট হবে, তা আমরা মেনে এসেছি। তবু একটা ছক, একটা বাস্তব প্রত্যাশা আমাদের ছিল, না মিললেও খামতিটা কোথায় ধরতে পারতাম।

রাজ্য জুড়ে গত কিছু দিনের ঘটনা সেই চিত্রের এতটাই বিপরীত যে মেলাবার উপায় নেই। অনেক জায়গায় দুর্বৃত্তরা সরকারি দফতরগুলি বিশেষ ভাবে তাদের লীলাক্ষেত্র হিসাবে বেছে নিয়েছে। যে হেতু সব ঘটনা নির্বাচন ঘিরে— রাজনীতির লোকদের আলোচনার বাইরে রাখা উচিত, এমনকী যে রাজনীতিকরা প্রশাসনের অঙ্গ বা শীর্ষস্থানীয়। এমন সময়ে যাতে তাঁদের অভিমত চূড়ান্ত না হয়, বিশেষ করে সে জন্যই স্থায়ী পুলিশ-প্রশাসনকে কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়। সর্বত্রের মতো এ রাজ্যেও দক্ষ, বিচক্ষণ, অভিজ্ঞ প্রশাসকের অভাব নেই। স্পষ্টতই তাঁরা অন্য কোনও লক্ষ্য বা আদর্শের দ্বারা চালিত হচ্ছেন, যা আমরা বুঝতে পারছি না।

তাঁরা বুঝিয়ে বলবেন মনে হয় না, আমাদেরই বুঝে নিতে হবে। সেটাও সহজ নয়, কারণ দৈনন্দিন প্রশাসন তেমন পাল্টায়নি, পাল্টাবেও না। ট্রাফিক আইন ভাঙলে জরিমানা দিয়ে যেতে হবে, পকেটমার বা ছিঁচকে চোর হাজতে যাবে পূর্ববৎ। পরিষেবা-পরিকাঠামোর উন্নয়ন অব্যাহত থাকতে পারে, বাড়তে পারে পর্যন্ত। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার বৃহত্তর গতিবিধি-উদ্দেশ্য কোথায় যেন আমূল পাল্টে যাবে বা গিয়েছে। সেটা নতুন করে জানতে হবে, বুঝতে হবে আমাদের দৈনিক সুখদুঃখ নিরাপত্তা আত্মসম্ভ্রমের উপর তার প্রভাব।

মনের অভ্যস্ত খোরাক হারিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবীর তবে নতুন একটা কাজ জুটল। আরও একটা হোমটাস্ক দিয়ে শেষ করি। ধর্মকে হিংসা-বিদ্বেষে নিমজ্জিত করে কী চরম অধর্মে পর্যবসিত করা যায়, তা আমরা দেখে চলেছি। এ বার হয়তো আর একটা বড় আদরের, বড় পবিত্র ভূমির উপর আমাদের দুর্বল স্বত্ব হারাতে চলেছি, সেটা গণতন্ত্র। তাই নতুন একটা গালভরা আদর্শ চাই যা নিয়ে কিছু দিন মাতামাতি করা যাবে। আসুন আমরা সেই চিন্তায় মশগুল হয়ে বুদ্ধির নিরুপদ্রব চর্চা করি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এমেরিটাস অধ্যাপক

administrative work Law and Order Violence Election Weapon
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy