Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
US Election Results 2020

ভাঙা আয়নার দিকে

যাঁহারা গণতন্ত্র ও বিরুদ্ধ মতকে সম্মান করেন, তাঁহারা স্বৈরাচারী নহেন, অতঃপর পরাজয় বরণ করিতে দ্বিধা করেন না।

ছবি: রয়টার্স।

ছবি: রয়টার্স।

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২০ ০৩:৪২
Share: Save:

সকল কালের সকল দেশের গ্রেট ডিক্টেটরগণের মুখ্য গুণ: তাঁহারা বড় আত্মপ্রিয়। নিজেদের ছবি ও নিজেদের স্বর ব্যতীত আর কিছুই তাঁহারা দেখিতে-শুনিতে নারাজ। যত দিন ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেন, তত দিন তাঁহাদের এই অভ্যাসের কলে মোসাহেবরা ভয়ে ও স্বার্থে তৈলপ্রদান করিতে থাকেন। ফলে, স্বৈরতন্ত্রের চাকাটি মসৃণ গতিতে ঘুরিতে থাকে। স্বৈরাচারীর মুখ প্রচারচিত্র হইয়া দেশের দিকে দিকে শোভিত হয়, স্বৈরাচারীর কণ্ঠ বাণীময় হইয়া সমস্ত গণমাধ্যম হইতে গমগম করিয়া নির্গত হইতে থাকে। অপর কোনও স্বরে সে-ক্ষণে কান পাতা দায়। স্বৈরাচারী ভাবেন অপর স্বর নাই। কিন্তু, বিশ্বপ্রকৃতি যেমন বিচিত্রের পক্ষপাতী মানুষের মনও সেইরূপ। সেই মনকে শাসন করা চলে, দমন করা চলে, কিন্তু সেই মনকে মারিয়া ফেলা যায় না। সুতরাং, শাসন-দমনের কাল অতিক্রম করিয়া মন এক সময় জাগিয়া উঠে। তখন অন্যস্বর প্রবলতর হয়। আপনার আয়নায় আপনাকে দেখিতে দেখিতে ও আপনার কর্ণে আপনার বাণী শুনিতে শুনিতে প্রমত্ত স্বৈরাচারী যখন নিজেকে সর্বশক্তিমান ভাবিতেছেন, তখন এই অন্যস্বর তাঁহাকে বিচলিত করে। তিনি ক্রুদ্ধ হন। এই ভিন্নস্বরকে অন্যায় বলিয়া মনে করিয়া গর্জিয়া উঠেন। প্রতিবাদীদের বেআইনি, দেশবিরোধী বলিয়া দাগাইয়া দিতে তৎপর হন। তাঁহাদের যেমন করিয়া পারেন দমন করিতে তখন উদ্যত। আইন-আদালতের ও অপরাপর প্রশাসনিক অস্ত্রের ব্যবহারে তখন অগ্রসর। ইতিহাসের নিয়ম ও সময়ের গতি কিন্তু নির্মম। গ্রেট ডিক্টেটর ভাবিতেছিলেন এই ভূ-মণ্ডল বেলুনের ন্যায় তাঁহার খেলিবার সামগ্রী। সে বেলুন লইয়া তিনি যেমন খুশি নৃত্য করিবেন। সেই বেলুনটিকে শরীরের যে-কোনও অঙ্গ দিয়া আঘাত করিয়া আমোদ পাইবেন। অথচ, যাহা ভাবেন নাই তাহাই হয়, তাঁহার আত্মরতির অবসান— বেলুন সহসা ফাটিয়া যায়। মুখের উপরে ফাটা-বেলুনের টুকরা, বিমূঢ় ডিক্টেটর হতবাক।

যাঁহারা গণতন্ত্র ও বিরুদ্ধ মতকে সম্মান করেন, তাঁহারা স্বৈরাচারী নহেন, অতঃপর পরাজয় বরণ করিতে দ্বিধা করেন না। তাঁহাদের কার্য তাই শেষ হইবার নহে। তাঁহারা জানেন, নির্বাচিত হইয়া তিনি কাজ করিতেই আসিয়াছিলেন মাত্র, সেই কাজ সম্পন্ন করিতে পারেন নাই বলিয়াই হয়তো তাঁহার পরাভব হইল। তিনি নায়ক নন, জনপ্রতিনিধি। বিবেকানন্দ লিখিয়াছিলেন, প্রকৃত নায়ক দাসবৎ বিনীত হইবেন। পরাভূত আদর্শ গণতন্ত্রপ্রিয় শাসক তখন সংশোধন-সচেষ্ট। আপনার ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করিয়া পুনরায় কর্মে আত্মনিয়োগ করেন তিনি। স্বৈরাচারীর কিন্তু এ উপায় থাকে না। সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে অবশ্য কখনও কখনও স্বৈরাচারীর মন বদলের প্রসঙ্গ উচ্চারিত। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের রাজার মন নন্দিনীর স্পর্শে পরিবর্তিত হইয়াছিল। তিনি বুঝিয়াছিলেন, তাঁহার ক্ষমতা তাঁহাকে ঠকাইয়াছে। জাল ছিন্ন করিয়া তিনি বাহিরে আসিয়াছিলেন। নিজের দুর্গ ও ক্ষমতাতন্ত্র তখন তিনি নিজে ভাঙিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, তাঁহার হাতে হাত রাখিয়াই তাঁহার বিরুদ্ধে লড়িতে হইবে। এই বদল নাট্যে হয়, বাস্তবে হয় কি না বলা কঠিন। হইলে ভাল। রূপান্তরিত স্বৈরাচারীকে জনগণ ক্ষমা করিতেও পারে। আর, যিনি নিজেকে বদল করিতে অসমর্থ, তিনি নিজেকে ধ্বংস করেন। স্বৈরাচারীর আত্মহননের সাক্ষী ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথ স্বৈরাচারীর মন-বদলের কথা বলিয়াছিলেন। আর, সত্যজিৎ বলিয়াছিলেন মগজ-ধোলাইয়ের কথা। যে যন্তর-মন্তর ঘরে হীরক রাজা অন্যদের মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন করিবার জন্য আদেশ দিতেন, সেই ঘরেই যে তাঁহার মগজ-ধোলাই হইল, সেই যন্ত্র-মাধ্যমে পরিবর্তিত রাজা যে নিজের মূর্তি খান-খান করিতে ছুটিলেন, ইহাতে ইতিহাসের প্রতীক কাজ করিতেছে। সত্যজিতের শঙ্কু-কাহিনিতেও জার্মানির নব্য-নাৎসিদের নেতার মগজে তাঁহার বিরুদ্ধদলের ঘিলু ঢুকাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। তবে, এ সকলই সাহিত্য বা সিনেমার কথা। বাস্তবের ইতিহাস কী ভাবে লেখা হইতেছে, তাহা দেখিবার, দেশ-বিদেশে স্বৈরাচারী শাসকদের পতন কী ভাবে হয়, তাহাই দেখিবার। সম্ভবত তাঁহাদের ‘বদল’ আসিবে ব্যবস্থার বদলের মধ্য দিয়া। কোনও ব্যবস্থাই স্থায়ী নয়। তাই স্বৈরাচারও অস্থায়ী। নিজের ক্ষমতা বজায় রাখিবার জন্য জান-কবুল শাসক এক দিন না এক দিন মুছিয়া যাইবেন। ইহাই ব্যবস্থার ধর্ম। কিংবা, রবীন্দ্রনাথকে মানিলে, ইহাই মানুষের ধর্ম। এক কালের মানুষ যে ব্যবস্থাকে মাথায় করিয়া রাখেন, অপর কালের মানুষ তাহা ভাঙিয়া ফেলিতে দ্বিধা করেন না। তখন? একা ক্লান্ত স্বৈরাচারী দাঁড়াইয়া থাকেন ভাঙা আয়নার সম্মুখে।

যৎকিঞ্চিৎ

অ্যাঁ, সাংবাদিককে গ্রেফতার করা? সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে যে জিনিসটাকে বিজেপি প্রাণপণ রক্ষা করত, কংগ্রেস সেটাকে খুন করে ফেলল? কোথায় যাচ্ছে দেশটা? এর পর তো সরকারবিরোধী কথা বললেই ‘দাঙ্গাবাজ’ বলে তুলে নিয়ে যাবে পুলিশ। ছাত্রদের ‘দেশদ্রোহী’ বলবে, জাতীয় সঙ্গীত চলার সময় উঠে না দাঁড়ালে প্রতিবন্ধী যুবকের উপর চড়াও হবে। গোমাংস খেলে পিটিয়ে মারবে। একা অমিত শাহ আর কত রক্ষা করবেন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রকে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

US Election Results 2020 Democracy Autocracy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE