শ্যামল চক্রবর্তীর ‘চরক কে, হীরক রাজ্য জানে কি’ (১৭-২) প্রসঙ্গে এই চিঠি। ‘আয়ুষ’ চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদ জুড়ে দেওয়া এখন একটি ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ ডাক্তারি পড়ার পর কর্মজীবনে প্রবেশের আগে নিতে হয়, কিন্তু আয়ুর্বেদ পড়া শুরু করার আগে শিষ্যের উপনয়ন বা কর্তব্যের শপথ নেওয়ার ধারণা আয়ুর্বেদেই আছে (সুশ্রুত সূত্র, অধ্যায় ২)। শিক্ষার শুরুতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া ভাল, না শিক্ষার শেষে— সেটা পাঠককুলের সুবুদ্ধির উপর রাখলাম।
‘বায়ো এথিক্স’ নিয়ে আজকাল প্রচুর কথা হয়। প্রাণীদের প্রতি এবং মানুষের প্রতি নৈতিক আচরণের কথা সেখানে বলা হয়েছে। কিন্তু উদ্ভিদের ব্যবহারে ‘এথিক্স’ বা নৈতিকতার কথা আয়ুর্বেদেই বলা হয়েছে সেই প্রাচীন কাল থেকেই (সুশ্রুত সূত্র, ১২ অধ্যায়)। চরক, সুশ্রুত কোনও ব্যক্তি বিশেষ নন, এটা ঠিক কথা। সনাতন ভারতীয়রা চিকিৎসা বিদ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কোনও কিছু পাওয়ার জন্য নয়। ব্যক্তি নামের লোভেও নয়। নির্ভেজাল সেবার উদ্দেশ্য নিয়ে। এখন তো দেখি পদোন্নতির জন্য রিসার্চ পেপার পাবলিশিং-এর ছড়াছড়ি, তা-ও আবার অনেক সময়েই টুকে, কিংবা সংখ্যার ধাপ্পাবাজি দিয়ে।
যে কোনও আধুনিক বিদ্যা প্রাচীন বিদ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। জোঁক যে রক্ততঞ্চনের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, তা প্রাচীনেরা আধুনিক যন্ত্র ছাড়াই বলেছেন, আর বর্তমান বিজ্ঞান জোঁকে ‘হিরুডিন’ (হেপারিন-এর দোসর) খুঁজে পেয়ে সেই সত্য নতুন ভাবে উপলব্ধি করেছে।
সুভাষ চন্দ্র দত্ত
জে বি রায় স্টেট আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল
নজর ঘোরাতে
‘চরক শপথ’ ধরে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের চরক শপথ পাঠ করানো একটি অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক উস্কে দেওয়ার প্রচেষ্টা। প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের এখনও নিজেদের স্বাধীন, গোষ্ঠীবদ্ধ মতামত প্রকাশের অবস্থা তৈরি হয়নি। ডাক্তারদের শপথবাক্যের প্রয়োজনীয়তা, আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে হিপোক্রেটিস বা চরকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা কাম্য ও স্বাগত। কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রের এই দু’জন বিরোধহীন, প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের মধ্যে কল্পিত বিতর্ক সৃষ্টির প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। ভয়াবহ অতিমারিতে সরকারের হাসপাতালের শয্যা, ওষুধ, অক্সিজেনের অভাব, কোভিড-শহিদ স্বাস্থ্যকর্মীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অক্ষমতা, এ সব বিষয় থেকে মুখ ঘোরাতেই এই রাজনৈতিক বিতর্কের অবতারণা হচ্ছে। হাতুড়ে চিকিৎসা, নানা ধারার চিকিৎসার সংমিশ্রণ বা ‘মিক্সোপ্যাথি’, স্বাস্থ্যে ও মেডিক্যাল শিক্ষাতে অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারিকরণ, এগুলো আজকের দিনে অনেক বেশি চিন্তার বিষয়। অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টির এই প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।
অর্জুন দাশগুপ্ত
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম
চাই সমন্বয়
শ্যামল চক্রবর্তীর প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে এই চিঠি। ইতিহাস বলে, ভারতীয়, চৈনিক, গ্রিক, মিশরীয় ও আরবীয় চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি সুপ্রাচীন হওয়ার দাবিদার, কিন্তু খুব সম্ভবত ভারতীয় পদ্ধতিই প্রাচীনতম। কারণ, খ্রিস্টের জন্মের দশ হাজার বছর আগেকার ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে, পরবর্তী অন্যান্য বেদে, বিশেষত অথর্ববেদেও রোগ চিকিৎসার বহু বিবরণ দেখতে পাওয়া যায়। আর পরবর্তী কালের ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে আয়ুর্বেদকে অথর্ববেদেরই একটি উপাঙ্গ বলা হয়। পৌরাণিক ঋষিদের মধ্যে ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের পুরোধা রূপে ধন্বন্তরী, ভরদ্বাজ, আত্রেয়, প্রভৃতি নাম আমাদের জানা, এবং এঁদের নির্দেশিত বিভিন্ন চিকিৎসা পদ্ধতি আমরা পুরাণের বিভিন্ন শ্লোক ও সংহিতায় পাই। এ ছাড়াও অগ্নিবেশ, চরক, সুশ্রুত, বাণভট্ট প্রমুখ চিকিৎসাবিদদের মূল্যবান উপদেশ ও তাঁদের পারদর্শিতার কথা আমরা বিভিন্ন সংহিতা ও পুরাণ থেকে জানতে পারি। যদিও চরক-সংহিতা-র মূল লেখক কে, এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কারও কারও মতে চরক সংহিতা আদিতে অগ্নিবেশ দ্বারাই লিখিত; চরক নাকি পরে তার পরিমার্জনা ও পরিবর্ধন করে পুনরায় প্রকাশ করেন মাত্র।
পৌরাণিক যুগে সর্বত্রই মনীষীরা একাধারে দার্শনিক, ধর্মোপদেষ্টা, বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক ছিলেন, এবং তাঁদের লিখিত গ্রন্থাদিতে ওই সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের একত্র সমন্বয় ছিল। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকেরা শুধুমাত্র পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপর ভিত্তি করে নিজ নিজ অভিজ্ঞতার দ্বারা উদ্ভিজ, খনিজ ও প্রাণীজ, ভেষজ সম্বন্ধে ধারণার দ্বারা রোগের যথাবিহিত চিকিৎসা করতেন। আয়ুর্বেদে উল্লিখিত খাদ্যাখাদ্য বিচার, খাদ্যের পরিপাক, হজমের পরবর্তী খাদ্যাংশের বিপাক ও অসার এবং অপ্রয়োজনীয় অংশের রেচন প্রভৃতির কথা যা বলা আছে, সকল ধারণা বিজ্ঞানসম্মত। কিন্তু স্নায়ুতন্ত্র, শ্বসনতন্ত্র প্রভৃতি সম্বন্ধে সে কালে সুস্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না। সে যুগে পরজীবী জীবাণু বা ভাইরাস-ঘটিত রোগ সম্বন্ধে ধারণা না থাকায়, আয়ুর্বেদীয় ত্রিদোষের ধারায় এই ধরনের রোগকে সঠিক যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করা যেত না।
বর্তমানে বহু রোগের কারণ ও প্রকৃতিকে আয়ুর্বেদিক ত্রিদোষের পর্যায়ে কেন্দ্রীভূত করে যুক্তি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীসুলভ দৃষ্টি নিয়ে ভারতের প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্র ও আয়ুর্বেদের অনেকগুলি তত্ত্ব ও তথ্যের যুক্তিসম্মত বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, এমন বহু অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্র আছে, যেখানে সম্যক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে পুরাতন আয়ুর্বেদ ও বর্তমান বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতিকে একে অন্যের অতি কাছে নিয়ে এসে, কিংবা একে অন্যের পরিপূরক রূপে মানুষের প্রভূত উপকার করা যেতে পারে। পুরাকালের আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে বর্তমানের চিকিৎসার সমন্বয় সাধন আজ অবশ্যই দরকার।
আলোক রায়
কলকাতা-১১০
বিনা প্রতিবাদে
দেশময় দারিদ্র, বেকারত্ব, অতিমারি এসে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং শিল্পকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। তার উপর শুরু হয়ে গিয়েছে ধর্মের নামে নানা সঙ্কটের উদ্ভাবন, পরিবর্তন, পরিশোধনের কর্মযজ্ঞ। ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিল্প, কোনও বিষয় বাদ নেই যেন। সম্প্রতি ‘হিপোক্রেটিক ওথ’ বাতিলের প্রস্তাব উঠেছে। শ্যামল চক্রবর্তীর প্রবন্ধটির মধ্যে যে আশঙ্কাগুলি ফুটে উঠেছে, সেগুলি ঝেড়ে ফেলার নয়। প্রশ্ন জাগে, ইদানীং বিনা বিচারে যে কোনও মত মেনে নেওয়ার এই প্রবণতা কেন? বিগত লকডাউনে এমন দৃশ্য দেখতে হয়েছে, যা প্রাচীন কুসংস্কারকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার মধ্যে এক ধরনের দমননীতি, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি থাকে। কিছু মানুষ ভয়ে, কিংবা কিছু পাওয়ার আশায় সব মেনে নেন। কিছু শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষ এগিয়ে আসেন বটে, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ ভয়ে পিছিয়ে যান। আমরা ধরে নিই, প্রতিবাদ যতই সুচিন্তিত, ইতিবাচক হোক না কেন, বিরুদ্ধাচরণ করলে শূলে চড়তে হবে। তাই দুর্ভোগ পোহাতে হয় সকলকে! জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়।
বাবুলাল দাস
ইছাপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
ভাগ্যের ফের
এক জনপ্রিয় রাজ্য লটারি সামান্য টাকার টিকিটে কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন বিক্রি করছে সর্বত্র। আর এই দিবাস্বপ্নে বুঁদ হয়ে মানুষ রক্ত জল করা পরিশ্রমের টাকায় ভাগ্য পরীক্ষা করছেন। মোহের আগুনে ঘি ঢালতে গিয়ে সংসারের বাকি প্রয়োজন লাটে উঠছে। কত টাকা পেয়ে কত টাকা হারালেন, সে হিসাব কেউ রাখেন না। রাখলে বুঝতে পারবেন, কোটিপতি হওয়া অনিশ্চিত, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে দেউলিয়া হওয়া নিশ্চিত।
রাজিবুর রহমান
সাগরদিঘি, মুর্শিদাবাদ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy