Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
employee

সম্পাদক সমীপেষু: ঝুঁকির কাজ

তৃতীয় বিশ্বের শিথিল সুরক্ষাবিধি ও পরিবেশবিধি সম্পর্কে অসতর্কতার সুযোগ নিতে বড় সংস্থাগুলি এখানে কারখানা স্থাপন করে।

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৫:২৭
Share: Save:

‘অরক্ষিত’ (৭-২) সম্পাদকীয় অতি করুণ এক চিত্র তুলে ধরেছেন। যে কোনও আধুনিক নির্মাণ কারখানা শ্রমিক সুরক্ষাবিধি মেনে চলতে দায়বদ্ধ। সাধারণ ভাবে সুরক্ষা পদ্ধতি হল গুণমান রক্ষাবিধির অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সুরক্ষা পদ্ধতির মূল আধার হল প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ, নির্মাণ পদ্ধতি এতটাই সুরক্ষিত যে, কাজ করার সময় শ্রমিক ভুলবশত কোনও বিপদের সম্মুখীন হবেন না। বলা বাহুল্য, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং প্রতিটি নির্মাণ ধাপের চুলচেরা ও আন্তরিক বিচার করে এই সুরক্ষাবিধি গড়ে ওঠে। আর এই গড়ে-ওঠা বিধি ক্রম বিবর্তনশীল, সব সময়েই তাতে উন্নতির অবকাশ থাকে, যেটাকে উৎসাহ দেওয়া কর্তৃপক্ষের অবশ্য কর্তব্য। এর সঙ্গে প্রত্যেক নির্মাতাকে তাঁদের সুরক্ষা তথ্য (অপঘাতের সংখ্যা ইত্যাদি) নিয়মিত প্রকাশ করতে হয়, আর পরবর্তী সময়ে এই সংখ্যা কমানোর পরিকল্পনা দাখিল করতে হয়। এই হল নিয়ম। স্বাভাবিক ভাবেই এই সুরক্ষাবিধি সার্থক ভাবে মেনে চলতে প্রয়োজন আর্থিক বিনিয়োগ। আবার বিধি মেনে-চলা যন্ত্রে কার্য সংক্ষেপ (উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে) সম্ভব হয় না।

তৃতীয় বিশ্বের শিথিল সুরক্ষাবিধি ও পরিবেশবিধি সম্পর্কে অসতর্কতার সুযোগ নিতে বড় সংস্থাগুলি এখানে কারখানা স্থাপন করে। কিন্তু সম্ভাব্য অর্থনৈতিক লাভের গুড় খেয়ে যায় দুর্নীতির পিঁপড়ে। অনেক সময় পাততাড়ি গুটিয়ে ফিরে যায় তারা, যেমন গিয়েছিল প্রখ্যাত গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি, ফোর্ড। দেশীয় সংস্থার এই নিষ্ঠুর আচরণ (প্রতি বছর ৫০০ শ্রমিকের অপঘাত) কোনও ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়, তাদের ব্যালান্স শিটে এ সবের উল্লেখ থাকাটা এবং তার পরিণতিতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হওয়া একান্ত জরুরি।

কৌশিক দাস

বেঙ্গালুরু

মৃত্যুর হিসাব

‘অরক্ষিত’ সম্পাদকীয়ের সূত্রে মনে করাতে চাই, গত বছর সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তথ্য অনুসারে ২০১৪-২০১৮ সালের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কেবল কারখানায় কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁদের মৃত্যুর কারণের মধ্যে রয়েছে আগুন, বিস্ফোরণ, মেশিনের গন্ডগোল, কারখানা চত্বরে গাড়ি চাপা পড়া ইত্যাদি। তা ছাড়া খনি, বন্দর, নির্মাণক্ষেত্রে আরও শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। সুরক্ষাবিধি ভঙ্গের জন্য শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে কারখানা কর্তৃপক্ষের শাস্তি হয় যৎসামান্য, এটাও শ্রমিকের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

আনন্দরূপ নাইয়া

কলকাতা-৯৯

ক্ষুধার অভিশাপ

‘প্রকল্পের ফাঁদ’ (১-২) সম্পাদকীয়তে শীর্ষ আদালতের পরামর্শে দেশ জুড়ে ‘গণরসুই’ কার্যসূচি চালু করার বিষয়টি নিয়ে খুবই প্রাসঙ্গিক ভাবে পর্যালোচনা করে লেখা হয়েছে, “ভারতে অপুষ্টি দীর্ঘ দিনের সমস্যা, খাদ্যাভাব তাহার একমাত্র কারণ নহে। খাদ্যাভ্যাস, শৌচাগার ব্যবহারের অভ্যাস, নানাবিধ অসুখ প্রভৃতি অনেক কারণের জন্য অপুষ্টি ঘটিয়া থাকে, তাই তাহার প্রতিকারের ব্যবস্থাও নিবিড় ও দীর্ঘমেয়াদি হইবে, ইহাই প্রত্যাশিত।”

ক্ষুধার নিবৃত্তি যে ‘প্রত্যাশিত’ তাতে কোনও দ্বিমত নেই। দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতাপ্রাপ্তির ৭৫ বছর পরেও সরকারি ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা, গাফিলতি ও ব্যর্থতার কারণে সুরাহা হল না। রাষ্ট্রীয় নীতি ও কার্যাবলির মাধ্যমে দারিদ্র ও অপুষ্টি দূরীকরণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও ক্ষুধার হাহাকার অব্যাহত। রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট (২০১৯) অনুসারে, এ দেশের ২০ কোটিরও বেশি মানুষ প্রতি রাতে খালি পেটে ঘুমোতে যেতে বাধ্য হন। কেন এই অবস্থা? একটা কল্যাণকামী রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থার অন্তর্নিহিত কদাকার, বিষম চেহারাটি চিরকাল এ ভাবে থেকে যেতে পারে না। কেন সর্বস্তরে সঠিক ও সুপরিকল্পিত ভাবে এর প্রতিকারের কার্যকর পন্থা গড়ে তোলা গেল না? ক্ষমতাসীন সরকারের জবাবদিহি ও আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন নেই?

দেশের সর্বোচ্চ আদালত কিন্তু বার বার এই গুরুতর বিষয়টি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করেছে, এবং মনে করিয়েছে যে, ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করা প্রতিটি রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। আসলে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কমিউনিটি কিচেন বা গণ-রান্নাঘর প্রকল্পের দ্রুত নীতি প্রণয়নের বিষয়টির অন্যতম সার্থকতার দিকটি হল, এর দ্বারা ক্রমাগত দারিদ্রের চক্রকে ভাঙতে সাহায্য করা, সেই সঙ্গে বিশেষ করে নারী ও সমাজের অন্যান্য দুর্বল অংশের জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা। এই ধারণাটি প্রতিবন্ধী ও বয়স্ক লোকদের খাদ্য-নিরাপত্তার একটি উপযুক্ত পরিমাপ হিসাবেও কাজ করে। এ দিকে অতিমারি সৃষ্ট সঙ্কটে দেশে ক্ষুধার্তের সংখ্যা বেশি মাত্রায় বেড়েছে।

ক্ষুধা সমস্যার নিরসনে ভারতে একাধিক সরকারি প্রকল্প ও গণব‌ণ্টন ব্যবস্থা চালু থাকলেও সমস্ত জায়গায় প্রকৃত রক্ষণাবেক্ষণ ও অর্থের যথোপযুক্ত জোগানের অভাবে চরম দুর্দশায় ভুগছেন অসংখ্য মানুষ। শিশুদের বিদ্যালয় বন্ধ ছিল বলে তারা মিড-ডে মিল থেকে কার্যত বঞ্চিত হয়েছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি পরিচালিত গ্রামীণ বা প্রত্যন্ত এলাকায় সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের (আইসিডিএস) মাধ্যমে সম্পূরক খাদ্যের কাজও বহুলাংশে ব্যাহত হয়েছে। এর মধ্যে লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন কমপক্ষে ২০ কোটি মানুষ। ফলে অনাহার-অর্ধাহারের সংখ্যা আরও প্রচণ্ড হারে বেড়েছে। ‘কোভিড-ইন্ডিয়া-ইন’ ওয়েবসাইটে ৩ মে, ২০২০ পোস্ট করা তথ্য থেকে উঠে আসে, অতিমারি কালে গৃহহীনদের মধ্যে মাত্র ১৮ শতাংশের রেশনের ব্যবস্থা হয়। অনেক জায়গায় খিচুড়ি বিতরণ করা হলেও, তা ছিল অস্বাস্থ্যকর ও নিম্নমানের। এমন দুঃসময়ে প্রয়োজন ছিল এক দেশব্যাপী জাতীয় খাদ্য-গ্রিড প্রকল্প, যাতে সুষম রান্না করা খাবার দেশের প্রতি কোণে সর্বপ্রকার ক্ষুধার্তের কাছে পৌঁছে যায়। এ দেশে কেন তা সর্বস্তরে পরিলক্ষিত হল না? মনে রাখা দরকার, ২০২১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদনে এমন আশঙ্কাও উঠে এসেছে, ভারত ‘জ়িরো হাঙ্গার ২০৩০’ বা ২০৩০-এর মধ্যে শূন্য ক্ষুধার লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না।

এখানে উল্লেখ্য যে, অভুক্ত ও দুঃস্থ লোকের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দিতে এর আগে তামিলনাড়ুতে ‘আম্মাউনাভাগম’, অন্ধ্রপ্রদেশে ‘আন্না ক্যান্টিন’, রাজস্থানে ‘অন্নপূর্ণা রসোই স্কিম’ এ রকম বিভিন্ন পরিষেবা চালু হয়েছিল। ওড়িশাতেও ২০১৫ এপ্রিল থেকে গরিবকে খাবার পরিবেশনের এমন কিছু ব্যবস্থা করা হয়। অতিমারিকালে দিল্লি, কেরল-সহ অনেক রাজ্যে এই বিষয়টি নিয়ে নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক বিশেষ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠে। পশ্চিমবঙ্গেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে এমন পরিষেবা, যেমন— ‘মা ক্যান্টিন’, ‘অন্নপূর্ণা ক্যান্টিন’, ‘শ্রমজীবী ক্যান্টিন’— এ রকম নামে দেখা যায়। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে সেগুলির অধিকাংশই পরে বন্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হওয়ার মুখে, বা বিচ্ছিন্ন ভাবে বিশেষ কোনও অঞ্চলে চালু আছে।

এমন জটিল পরিস্থিতিতে মহামান্য শীর্ষ আদালতের প্রস্তাবটি এক যথোচিত বার্তা। অর্থাৎ, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল-সহ সমস্ত রাজ্যকে নিয়ে পাকাপাকি ভাবে ‘মডেল গণ-রান্নাঘর কার্যসূচি’ গঠন করা, যাতে দ্রুত দেশ জুড়ে সর্বস্তরের দারিদ্রপীড়িত মানুষের সুষম রান্না করা খাদ্যের ব্যবস্থা করা যায়। ক্ষুধার অভিশাপ থেকে মুক্তি আজও মেলেনি। তাই শীর্ষ আদালতের পরামর্শ অনুযায়ী, অবিলম্বে এই নৈতিক কার্যক্রমকে যথোপযুক্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা দরকার। ক্ষুধার সুরাহা না করা হলে, একটা কল্যাণ রাষ্ট্রের কাছে তার চেয়ে লজ্জার বিষয় আর কী হতে পারে!

পৃথ্বীশ মজুমদার

কোন্নগর, হুগলি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

employee Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE