অচিন চক্রবর্তী ‘কল্পনাশক্তির সন্ধানে’ (২০-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্বন্ধে লিখেছেন, “...যা আমাদের ভাবায়, বিভ্রান্ত করে, স্বস্তি দেয় না।” এই ভাবনার সূত্রে আমরা দেখি ষাটের দশকে পার্টির জন্মলগ্ন থেকে তৎকালীন বাম আন্দোলনের গতিপথের বারংবার দিকবদল, মত ও পথের অবিরাম সংঘাতের মধ্যেই বুদ্ধদেবের এগিয়ে চলা; পার্টির মতাদর্শ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বুদ্ধদেবের নানা দ্বন্দ্ব আর সংশয়। আবার কখনও পার্টির বিতর্কিত সিদ্ধান্তে নীরব আত্মসমর্পণ। প্রাথমিক স্তরে ইংরেজির পঠনপাঠন বন্ধ হল। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। নেতা-মন্ত্রীদের সন্তানেরা কিন্তু বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়ার সুবাদে প্রাথমিকে ইংরেজি শেখার সুযোগ পেল।
শিক্ষায় আড়াআড়ি ভাগ হওয়া শুরু হল এখান থেকেই। বুদ্ধদেবের বিবেক এখানে নীরব। ভুল বুঝলেন অনেক দেরিতে।
কেরলের চিত্রনির্মাতা জোশী জোসেফের তথ্যচিত্র ওয়ান ডে ফ্রম আ হ্যাংম্যান’স লাইফ (নাটা মল্লিককে নিয়ে) প্রদর্শনের কয়েক ঘণ্টা আগে বন্ধ করে দিলেন। সংস্কৃতিপ্রেমী মুখ্যমন্ত্রীর এ-হেন উদ্ধত হস্তক্ষেপ, তাঁর অনাড়ম্বর জীবনযাপনের গল্পে ঢাকা পড়বে না। নতুন স্লোগান তৈরি হল, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। বিকল্প ব্যবস্থার পরীক্ষায় পার্টির মানসিক শৈথিল্য ছিল। আবেগতাড়িত হয়ে চটজলদি উন্নয়নের ভাবনায় হাত পোড়ালেন। একই সঙ্গে ব্যক্তি বুদ্ধদেব পার্টির তৃণমূল স্তরের পরিস্থিতি বুঝতে ব্যর্থ হলেন। মেহনতি মানুষের স্বার্থে যে লড়াইয়ের অঙ্গীকার করেছিলেন, ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে তা শেষ করলেন কর্পোরেট পুঁজির হাত ধরে।
সেই পুরনো প্রশ্ন ফের ঘুরে এল; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বামপন্থা উন্নয়নের খোঁজে কমবেশি পুঁজিবাদের চেনা ছকের উপর নির্ভর করেছে। মানুষের সার্বিক কল্যাণে বামপন্থীদের বিকল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ আজও অধরা।
সোমনাথ মুখোপাধ্যায়, নিউ টাউন, কলকাতা
বিতর্কিত
অচিন চক্রবর্তী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন সৎ, নির্লোভ এবং ন্যূনতম আড়ম্বরহীন এক মানুষ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সমস্ত সুযোগসুবিধার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভোগী হয়ে ওঠেননি। স্বল্পবাক মানুষদের অনেকেই ভুল বোঝেন। তাই অনেকেই ভাবতেন, তিনি দাম্ভিক। কিন্তু সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি পরিহিত এই মানুষটি ছিলেন বিবেকবান এবং আপাদমস্তক ভদ্রলোক, সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। রবীন্দ্রনাথ যেমন ছিলেন তাঁর প্রিয় লেখক, সেই রকম মার্ক্স, এঙ্গেলস, শেক্সপিয়র, লেনিন, কাফকার বই ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। পাম অ্যাভিনিউয়ের অতি সাধারণ সরকারি আবাসনে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কাটিয়েছেন। খুপরি খুপরি দু’টি ঘর, তারও আবার বেশির ভাগটাই বইয়ে ঠাসা।
রবীন্দ্রসদন বাদ দিলে সংস্কৃতি চর্চার যে পরিকাঠামো আজ পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায়, তা গড়ে উঠেছে বামফ্রন্টের আমলেই। ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ও গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার প্রসার বামফ্রন্টের আমলেই হয়েছে। কিন্তু ভারতের মতো বহু ভাষা, বহু ধর্ম ও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত দেশে কোনও তত্ত্বই চোখ বন্ধ করে প্রয়োগ করা যায় না। নব্বইয়ের দশকে উদারীকরণের আবহাওয়ায়, বামপন্থীদের মার্ক্সীয় তত্ত্ব তাই দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ল। এক সময় যাঁরা ছিলেন গরিব, খেটেখাওয়া মানুষদের আপনজন, তাঁরাই মুক্তির উপায় হিসাবে পুঁজিবাদকে আঁকড়ে ধরে নিম্নবিত্ত মানুষদের থেকে দূরে সরে যান। তোলাবাজি ও প্রোমোটার রাজও শুরু হয় বামফ্রন্টের আমলেই। তাই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিতর্কিত নায়ক হয়ে থেকে যাবেন।
রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
লোডশেডিং
অচিন চক্রবর্তী তাঁর উত্তর-সম্পাদকীয়টির তৃতীয় অনুচ্ছেদে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বাম সরকারের দ্রুত পতনকে ত্বরান্বিত করার যে কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন, তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় আর একটি কারণ— লাগাতার লোডশেডিং। বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ম্যারাথন লোডশেডিং রাজ্যবাসীকে তিতিবিরক্ত করে তুলেছিল। ২০১১ সালে রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের আগে পর্যন্ত সরকার এই সমস্যার মোকাবিলা করতে পারেনি। স্বাভাবিক ভাবেই ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে, এবং তার আগে পঞ্চায়েত লোকসভা ও পুরসভা নির্বাচনের অন্যতম বিষয় ছিল লোডশেডিং। রাজনৈতিক পালাবদলের পর এই সমস্যা প্রায় কর্পূরের মতো উবে যায়!
শঙ্খমণি গোস্বামী, কলকাতা-১২২
ভাবের ঘরে
আর জি কর কাণ্ডে কোণঠাসা অবস্থান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তৃণমূল সুপ্রিমো ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চ বেছে নিয়েছিলেন। ধর্ষণ দমনে অপরাজিতা বিল এনেছেন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আইনের ছাত্রীও বটে! তিনি জানেন, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য এক জন নিরপরাধও যেন শাস্তি ভোগ না করে, এটা সুনিশ্চিত করা। বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড উঠে গেলেও ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় এখনও বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। তার জন্য অভিযুক্তের বিরুদ্ধে জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিল করতে হয়। অপরাধ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় বহু আসামি ছাড়া পেয়ে যায়, যার সাম্প্রতিকতম নমুনা হল কামদুনি গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের বেকসুর খালাস। তাই ‘ধর্ষকের ফাঁসি চাই’ শুনতে ভাল, কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্য পেশ করে অপরাধ প্রমাণ করার দায়িত্ব ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের হলেও, শেষ পর্যন্ত রাজ্য প্রশাসনের।
আর জি কর হাসপাতালে চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় তথ্য গোপন ও প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ উঠছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। ‘নির্যাতিতার বিচার চাই’ দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ মুখর হয়ে উঠেছেন। এর মোকাবিলায় মঞ্চ থেকে ধর্ষকের দ্রুত ফাঁসি দেওয়ার লক্ষ্যে বিল আনা কতটা আন্তরিক, স্বাভাবিক ভাবেই সে প্রশ্ন উঠছে। অনেকে আবার সরকারের এই অবস্থান ভাবের ঘরে চুরি বলতে দ্বিধা বোধ করছেন না।
মুম্বই হামলায় আজমল কাসভকে এনকাউন্টারে মেরে না-ফেলায় পাকিস্তান-যোগ প্রমাণ করা সহজ হয়েছিল। ধরা যাক, মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণামতো আর জি কর কাণ্ডে এখনও পর্যন্ত গ্রেফতার হওয়া সিভিক ভলান্টিয়ারকে তড়িঘড়ি বিচার শেষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। তা হলে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে যাবে আর জি কর হাসপাতালের অভ্যন্তরে ঘটে-চলা নৈরাজ্যের চক্র উন্মোচনের সম্ভাবনা, যার পিছনে শাসক দলের মদত থাকাও সম্ভব। যে চক্রব্যূহই হয়তো ছিনিয়ে নিয়েছে মেয়েটির প্রাণ।
এক বছর আগে আর জি করের তৎকালীন ডেপুটি সুপারের নথিপত্র-সহ দুর্নীতির অভিযোগ স্বাস্থ্য দফতর, ভিজিল্যান্স কমিশন, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে ফাইলবন্দি হয়ে পড়েছিল। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার কারণে ‘হুইসলব্লোয়ার’ ডেপুটি সুপারকে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়। সে দিন যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে চলতে পারত সরকার, শীর্ষকর্তারা যদি একটু সংবেদনশীল ও মানবিক হতেন, তা হলে নিশ্চিত ভাবে তিলোত্তমাকে অকালে চলে যেতে হত না। শ্রীরামকৃষ্ণের ‘ফোঁস করা’-র বাণী আত্মস্থ করা ভাল, কিন্তু পাশাপাশি নীতিশিক্ষার উপদেশগুলিও মনে রাখতে হবে।
রাজশেখর দাশ, কলকাতা-১২২
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy