অমিতাভ গুপ্তের ‘বিপ্লবের ভোলবদল’ (২১-১০) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা না করে, দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক পরিবর্তনের যে উদ্যোগ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কিছু দেশে সংগঠিত হয়েছে, তা অবশ্যই অভিনব। আগে থেকে কোনও সংগঠন তৈরি না করে শুধু সমাজমাধ্যমে বার্তা বিনিময়ের মাধ্যমে যোগাযোগ গড়ে তুলে নবীন জেন-জ়ি প্রজন্মই এই বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ ভাবে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি যে ‘গোটা দুনিয়ার স্বৈরশাসকদের মনে কাঁপুনি’ ধরাবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে এই ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে স্বৈরশাসকের পরিবর্তন হলেও দুর্নীতির শিকড়গুলি সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে সমূলে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কি না, এই প্রশ্ন থেকেই যায়। পরিস্থিতির চাপে হয়তো কিছু দিনের জন্য দুর্নীতির কারবারিরা নিজেদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা নিছকই সুযোগের অপেক্ষায় আত্মগোপন করে থাকা। অর্থাৎ, যে উদ্দেশ্য নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য উদ্যোগ করা হল, তা শেষ পর্যন্ত আশানুরূপ ফল দিতে নাও পারে। ‘দিনবদল’-এর ভাবনা এখানে অনুপস্থিত থাকায় এই প্রজন্মের কাছে যে রাজনৈতিক প্রশ্নগুলি গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোও ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। নতুন সমাজ বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখা এই প্রজন্মের কাছে অলীক কল্পনামাত্র। শাসকেরা সব সময় চাইবে বিক্ষোভ যাতে দানা বাঁধতে না পারে। আয়তনে অপেক্ষাকৃত ছোট ও রাষ্ট্রবিরোধী বিক্ষোভ সামাল দিতে ততটা দক্ষ নয়, তেমন কোনও রাষ্ট্রে সমাজমাধ্যমের সাহায্যে সাফল্য লাভ সম্ভব হলেও, বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রে তা সম্ভব নয়। পঞ্জাবের কৃষকদের দীর্ঘ দিন ধরে চলা আন্দোলন বা আর জি করের রাত দখল আন্দোলনের পরিণতি কি আমাদের সেই শিক্ষা দেয়নি? সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতির প্রকৃত কারিগরেরা কিছু দিনের জন্য চুপ করলেও সুযোগ বুঝে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। তা ছাড়া যে বিপ্লবে ‘প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে একেবারেই গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার তাগিদও নেই’ সেখানে ক্ষমতা হস্তান্তর করেই বা শেষ পর্যন্ত কতটা লাভ হয়?
আসলে তথ্য ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে যাওয়ায়, সব বয়সের মানুষ এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের এক সেতু সহজেই নির্মাণ করে নিতে পারছেন, যাকে আমরা সমাজমাধ্যম বলছি। মাধ্যমটি যে অসীম শক্তিধর, সে কথাও বারে বারে প্রমাণিত। কিছু মানুষ এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে কিছু আয়ের সংস্থান করতে পারছেন ঠিকই, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ যে এটিকে নিতান্ত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করেন, সে কথাও অস্বীকারের উপায় নেই। তাই সমাজমাধ্যমে যোগাযোগের সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নেপালের ওলি সরকারের বিরুদ্ধে যুবসমাজের ক্ষোভ হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটিয়েও থেমে যেতে সময় নেয় না। যেন সরকার পরিবর্তন হলেই যুবসমাজের যাবতীয় সমস্যা মুহূর্তে সমাধান হয়ে যাবে। ভোগবাদের দুনিয়ায় শুধুমাত্র নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এমন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ইতিপূর্বে ইতিহাস পর্যবেক্ষণের সুযোগ পায়নি বলেই জেন-জ়ি’র বিদ্রোহ গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
তবে অতীতের যে সব বিপ্লবের সঙ্গে মানুষ পরিচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাদের সব ক’টিকেই ‘মহিমান্বিত’ না করেও বলা যায় অধিকাংশ বিপ্লবেই অংশগ্রহণকারীরা কখনও নিজেদের ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাধিকার দেননি। আত্মত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে নিপীড়িত জনগণের শোষণমুক্তির পথ খুঁজে বার করার জন্য মতাদর্শগত লড়াই চালিয়েছে। সে লড়াই হয়তো সব ক্ষেত্রে সফল হয়নি, কিন্তু তা যুব সমাজের মনে এমন স্বপ্নের জাল বুনে দিতে সমর্থ হয়, যে স্বপ্নের মৃত্যু সহজে হয় না, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে উজ্জীবিত করার শক্তি ধরে।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
বিশৃঙ্খলা নয়
‘বিপ্লবের ভোলবদল’ প্রসঙ্গে কিছু কথা। আসলে নেপালে সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে অস্থির পর্যায়ের ঘটনা ছিল সে দেশের রাজনৈতিক ভোলবদল। সমাজমাধ্যমের উপর নিষেধাজ্ঞা তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে— যারা দুর্নীতি ও বেকারত্বে ক্লান্ত। যদিও তরুণদের হতাশা কোনও একটি সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে নয়। এটি দীর্ঘস্থায়ী অসন্তোষকে প্রতিফলিত করে, যা দীর্ঘ সংযমের পরে দেখা গিয়েছে। এই পরিস্থিতি মনে করিয়ে দেয়, রাজনৈতিক অসন্তোষ কত দ্রুত বিশৃঙ্খলায় রূপান্তরিত হতে পারে। নেপালে জেন-জ়ি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এটি আবেগপ্রবণ ক্রোধ নয়, বরং পদ্ধতিগত অন্যায়ের প্রতি প্রতিক্রিয়া। এ বছরের এপ্রিলে রাজতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য দেশব্যাপী আহ্বান জানিয়ে একই রকম একটি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল। সেই সময়কালেও জনগণ তাদের হতাশা প্রকাশ করেছিল দুর্নীতির উপর।
নেপালের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি দীর্ঘ সময় ধরে অনিশ্চিত। ২০০৮ সালে, এই বিষয়গুলির মোকাবিলা করে একটি উল্লেখযোগ্য গণআন্দোলন শুরু হয়েছিল, যার ফলে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি এবং একটি প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু দু’দশকেরও কম সময়ে জনগণ সেই ব্যবস্থার প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছেন। নেতাদের প্রতি ভোটারদের হতাশার মাত্রা কতখানি বুঝতে শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যানই যথেষ্ট— গত ১৭ বছরে ১৪টি সরকার গঠিত হয়েছে। তদুপরি, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা থেকে শুরু করে বাবুরাম ভট্টরাই, প্রচণ্ড এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি পর্যন্ত রাজনীতিবিদ সকলেই দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে পড়েছেন।
তবে চলমান অস্থিরতা ভারতের জন্য গুরুতর উদ্বেগের কারণ, বিশেষত বাংলাদেশে গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের পর, যা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকে দেশ থেকে উৎখাত করে। ভারত ও চিনের মধ্যবর্তী একটি রাষ্ট্র হিসেবে নেপালের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেশি। ভারতের জন্য, এই সঙ্কটকে বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা যায় না। ভারতের জন্য বার্তাটি স্পষ্ট: আমাদের প্রতিবেশী অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা অনিবার্য ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে। নেপালে স্থিতিশীলতা কেবল কূটনৈতিক প্রয়োজনীয়তা নয়, আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যও প্রয়োজন।
অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর
সমাজের জন্যই
অমিতাভ গুপ্তর ‘বিপ্লবের ভোলবদল’ প্রবন্ধটি এক কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাল। জেন-জ়ি’দের বিপ্লব কিংবা সামাজিক আন্দোলন কি ব্যক্তিকেন্দ্রিক? সমষ্টিগত সার্বিক উন্নয়নের জন্য নয়? যেমন দেখা গিয়েছিল তেভাগা আন্দোলনে, পরবর্তী সময়ের জনজাতি আন্দোলন, নারী অধিকার আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলন, অণ্ণা হজারের নেতৃত্বে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে? আর জি কর আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে এল, অনেকেই বুঝতে চাইলেন না, ধর্ষকের শাস্তির চেয়ে হাসপাতাল চত্বরের আমূল সংস্কার অর্থাৎ পরিবেশগত সুরক্ষার দাবি কেন বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে! জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি ছিল, শুধু শাস্তি নয়, চাই সংস্কার, আইনের শাসন। হয়তো এখানে সাধারণ মানুষ ভুল বুঝলেন, ভাবলেন এ সবের সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ক কী? কিন্তু ধর্ষণ তো শূন্যে হয় না, এটা কেউ তাঁদের বোঝাল না। যাঁরা বোঝানোর ক্ষমতায় ছিলেন, তাঁরাও না। ফলে অনেকের মনে সন্দেহ জাগল, জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিগুলি ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’; এবং আন্দোলনের মাধ্যমে আখের গুছিয়ে নেওয়ার প্রবণতা। প্রবন্ধকার লিখেছেন— শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ কিংবা নেপালে কোথাও জেন-জ়ি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেনি, শাসনব্যবস্থাকে তারা পাল্টে দেবে এমন দাবিও করেনি; শুধু আশা করেছে দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা, বেকারত্ব দূরীকরণ, আর্থিক উপার্জনের সুযোগ বৃদ্ধি, ইত্যাদি। এই দাবিগুলি কি বৃহত্তর পরিসরে ব্যাপ্ত নয়?
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)