E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: নবান্নের অপেক্ষা

সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল গ্রামীণ এবং শহুরে শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত যাত্রাপালা, খোলা মাঠে। সারা বছর উন্মুখ হয়ে থাকতাম দুর্গাপুজোর রাতগুলির জন্য। এখন তো সারা রাত ধরে লোকের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়, কলকাতা হোক কিংবা মফস্‌সল শহর, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে।

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৪২

শুরুতে শরৎ, শেষে শীতের আগমনী বার্তা, মাঝে হেমন্ত পরিক্রমা— তৃষ্ণা বসাকের ‘হেমন্তের ঘ্রাণ’ (রবিবাসরীয়, ১৯-১০) ফিরিয়ে দিল সেই ছেলেবেলার দিনগুলিকে। মনে করিয়ে দিল, চোখে জড়িয়ে আসা ঘুমের রেশ কাটিয়ে ফুলের সাজি হাতে আঁধার জড়ানো অস্পষ্ট ভোরে শিশির ভেজা শিউলি বিছানো উঠোনে ছুটে যাওয়ার কথা, টিনের কৌটোতে লুকিয়ে রাখা ঠাকুমার হাতে বানানো মুড়ির মোয়া-নারকেলের নাড়ু চুরি করার কথা, বাড়ির পিছনে দিগন্তব্যাপী ধানখেতে লুকোচুরি খেলার কথা। এক ছুটে চলে যাওয়া মন্দিরে, এখনও যে বাকি আসল রং, তেল পালিশ— দেখতে হবে সব, মন্দিরের মেঝেতে থেবড়ে বসে। আজও ইচ্ছে করে দু’চোখ বুজে জড়িয়ে ধরি সেই ফেলে আসা ছেলেবেলাকে।

সেই সময় সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল গ্রামীণ এবং শহুরে শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত যাত্রাপালা, খোলা মাঠে। সারা বছর উন্মুখ হয়ে থাকতাম দুর্গাপুজোর রাতগুলির জন্য। এখন তো সারা রাত ধরে লোকের ঊর্ধ্বশ্বাস দৌড়, কলকাতা হোক কিংবা মফস্‌সল শহর, এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে। সময় কোথায় এক জায়গায় জমিয়ে বসে যাত্রাপালা কিংবা গানের জলসা দেখার? শুনতে পাই কি শান্তি গোপাল, স্বপন কুমার, রুমা দাশগুপ্ত, পুতুল রানি, বীণা দাশগুপ্ত বা উৎপল দত্তের সেই গমগম কণ্ঠের আর্তি, যা নাড়া দিত সেই সময় প্রতিটি মানুষের বিবেককে? আর ছিল পুজোর মণ্ডপে সেই প্রাণখুলে সকাল-সন্ধে আড্ডা, দু’বেলা পাত পেড়ে খাওয়া, সন্ধেয় ধুনুচি নাচ, গানের আসর। আজও বজায় আছে সেই ঘরোয়া আমেজ বাহাত্তর বছরে পদার্পণ করা আমাদের বাড়ির পুজোমণ্ডপে।

তার পরেই একে একে লক্ষ্মীপুজো, নলসংক্রান্তি, কার্তিক পুজো। বসতবাড়ির পিছনে যে বিরাট ধানখেত, সোনালি ধানে ভরা, দু’চোখ ভরে দেখতাম সেই সময়। এখন কংক্রিটের জঙ্গল, সারি সারি ফ্ল্যাটবাড়ি সেখানে। হেমন্তের দুপুরের হালকা তপ্ত আরামদায়ক রোদ পিঠে লাগিয়ে বারান্দায় বসে দাদুর সঙ্গে চোদ্দো শাক আহার, সন্ধেয় ঘরের প্রতি কোণে প্রদীপের আলো। কালীপুজো, ভাইফোঁটা আর তার পর এসে যেত ‘নবান্ন’ উৎসবের প্রস্তুতি। সবাই ব্যস্ত মাঠে, খামারে। বাড়ির সামনের আঙিনায় ধানের স্তূপ। আমরা লুকোচুরি খেলতাম পাশে রাখা খড়ের স্তূপে। ঠাকুমাকে দেখতাম নতুন ধানের চাল দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করে নবান্নের দিন পরিবেশন করতেন কলার পাতায়, সঙ্গে থাকত নতুন চালের পায়েস। ‘নবান্ন’-এর ঐতিহ্যের পিছনে অবশ্য ছিল যথাযোগ্য আর্থসামাজিক, ঐতিহাসিক কারণও। স্বল্প ফলনের আমন ধান তখন ‘সোনার দানা’। গ্রামের সব কৃষিজীবী মানুষ অপেক্ষা করতেন নতুন ধানের জন্য, ‘নবান্ন’র জন্য।

এর পরেই পৌষ সংক্রান্তি। ঠাকুমা ব্যস্ত হয়ে পড়তেন চালের গুঁড়ো দিয়ে পাটিসাপটা বানাতে, সঙ্গে দুধ পিঠে, পায়েস ইত্যাদি।

সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত

চিঠির ডাক

‘কাজ কমেছে, তবুও জেল্লাদার ডাকবাক্স’ (১৯-১০) প্রতিবেদন প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ছেলেবেলার কথা। বাড়িতে পোস্টম্যান আসা মানেই একটা বাড়তি আনন্দ ও উত্তেজনা। উত্তেজনা— কী আছে ওই ঝোলাব্যাগে! পুজোর আগে মামার বাড়ি থেকে মানি অর্ডার আসবে— তার আনন্দ। একটু বড় হয়ে দিদি অপেক্ষায় থাকত আকাশবাণীতে তার অডিশন পাশের চিঠির জন্য, আর আমি কোনও পত্রিকায় লেখা মনোনয়নের বার্তার অপেক্ষায়। এমনকি বাড়ির লেটার বক্সে দিনে দু’-তিন বার হাতড়াতাম অপ্রত্যাশিত কোনও খবরের আশায়। এই ভাবেই এক দিন এসেছিল আমার সরকারি চাকরি প্রাপ্তির চিঠি। ইমেল সংস্কৃতি অনেক আগে শুরু হলেও তা পাকাপাকি ভাবে আমাদের জড়িয়ে ধরে কোভিডের ঠিক পরবর্তী সময়েই। পোস্ট অফিসগুলোতে চিঠিপত্র কই? শুধু স্বল্প সঞ্চয় আর পার্সেল। পাড়ার মোড়ের ডাকবাক্স উধাও। তাদের পাকাপাকি স্থান এখন ডাকঘরের সামনের রাস্তায়। সেখানেও জিনিসপত্র কম। সাধারণ চিঠিপত্র কেউ লেখেই না। বিশেষ প্রয়োজনের খয়েরি খামের চিঠি হয় রেজিস্ট্রি, না হলে স্পিড পোস্ট। ডাকবাক্সগুলোর পেট তো খালি থাকবেই। খবর সবই পাচ্ছি। বরং আরও অনেক বেশি দ্রুত। কিন্তু চিঠির সেই মন ছুঁয়ে যাওয়া আনন্দ-আবরণটা এখন আর নেই।

নীলাঞ্জন চৌধুরী, কলকাতা-৫৪

শিক্ষার দাবি

‘বৈষম্যের শিক্ষা’ (সম্পাদক সমীপেষু, ২২-১০) শীর্ষক পার্থ পালের চিঠির শেষে একটি অতিবাস্তব সত্য উঠে এসেছে। পত্রলেখক বলেছেন— গৃহশিক্ষকনির্ভর ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়কে ব্যবহার করে কেবল সরকারি সুবিধা পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে। এই নিদারুণ মহাব্যাধিটি রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে সযত্নে প্রবেশ করিয়ে গিয়েছে বাম সরকার। ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু পরিকল্পনা করেন— রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনের পরিচালন সমিতিতে যাঁরা আসবেন, তাঁদের মনোনয়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলির সরাসরি প্রতিনিধিত্ব গ্রাহ্য হবে না। এ ছাড়া আরও কিছু মৌলিক পরিবর্তনের দিকে ভাবনাচিন্তা করার পরই ব্রাত্যবাবুকে সরিয়ে দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চেয়ারে যাঁকে বসানো হয়, তিনি দীর্ঘ তিন বছরের বেশি কারাবাসের পর সদ্য জামিনে মুক্ত হয়েছেন।

বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিবেশ রীতিমতো ঘোলাটে হয়ে উঠেছে, যা আমাদের সকলেরই উদ্বেগের কারণ। বাম আমলে সরকারপোষিত স্কুল-কলেজগুলোয় শিক্ষকদের বেতন বাড়িয়ে ধন্যবাদার্হ হয়ে উঠেছিল তৎকালীন বাম সরকার। কিন্তু এ প্রশ্নও উঠেছিল— বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি স্কুলশিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতার প্রবণতা চিরতরে বন্ধ করার পাকাপোক্ত ব্যবস্থা না-করে ভোট রাজনীতির কাছে কার্যত আত্মসমর্পণ করেছে সরকার। ফলস্বরূপ, পুরনো ব্যবস্থার নেতিবাচক সুযোগগুলোই নিয়ে চলেছে বর্তমান সরকার। ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশ। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশ স্কুলে আসছেন, যাচ্ছেন, স্কুলে না পড়িয়ে গৃহশিক্ষকতার পসরা সাজিয়ে পরোক্ষ ভাবে প্রলোভন দেখিয়ে চলেছেন পড়ুয়াদের। পড়ুয়ার সংখ্যাও কমছে বহু স্কুলে, বেশ কিছু স্কুল হয় উঠে গিয়েছে বা উঠে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলোয় রাশি রাশি অর্থব্যয়ই হয়ে চলেছে।

তাই আমাদের মতো সাধারণ মানুষের বেশ কিছু দাবি রয়েছে। প্রথমত, শিক্ষাঙ্গন থেকে দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষকদের খুঁজে বার করে শিক্ষার হাল ফেরাতে তৎপর হোক সরকার। দ্বিতীয়ত, শিক্ষাঙ্গনগুলিতে অবিলম্বে অপ্রয়োজনীয় ছুটির সংখ্যা কমানো হোক। তৃতীয়ত, সরকারি ও সরকারপোষিত বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা পুরোপুরি বন্ধ করা হোক। চতুর্থত, শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত পরিকাঠামো উপহার দিয়ে ‘শিক্ষা’ নামক বিষয়টির প্রতি আলোকপাত করা হোক আন্তরিক ভাবে। সর্বোপরি, শিক্ষাঙ্গনে কোনও ভাবে যাতে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অনুপ্রবেশ না-ঘটে, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা হোক যত শীঘ্র সম্ভব।

শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া

অন্য পড়া

বিশ্বজিৎ করের ‘বই হারে না’ (সম্পাদক সমীপেষু, ১৯-১০) চিঠি প্রসঙ্গে বলতে চাই, মোবাইলেও কিন্তু এখন বই পড়া যায়। ই-বুক বা পিডিএফ বই অনেকেই পড়েন আজকাল। কিন্ডল-এর মাধ্যমেও অনেকে বই পড়েন। হ্যাঁ, বইয়ের পাতার গন্ধ হয়তো তাতে পাওয়া যায় না। তবে সাহিত্য রসের আস্বাদ পেতে কোনও অসুবিধা হয় না। অফিস টাইমে ট্রেনের প্রচণ্ড ভিড়ে অনেক ক্ষেত্রে বই খুলে পড়তে অসুবিধা হয়, কিন্তু মোবাইলের আকার অনেক ছোট হওয়ায় এর মাধ্যমে বই পড়তে সমস্যা হয় না। রাতের ট্রেন বা বাস সফরে আলোর অসুবিধাও অনেক ক্ষেত্রে বই পড়তে সমস্যা সৃষ্টি করে, মোবাইলে পড়লে এই সমস্যা নেই। হয়তো এই ধরনের পাঠকের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম, তবে আস্তে আস্তে সেই সংখ্যা বাড়ছে। বই পড়লেই হল। এ ছাড়া এখন অনেক ইউটিউব চ্যানেল দেশ-বিদেশের নামকরা সাহিত্যিকদের গল্প উপন্যাস পাঠ করে শোনাচ্ছে, এ ভাবেও অনেকের মধ্যে বই পড়ার ইচ্ছা তৈরি হচ্ছে। এটা ভাল ইঙ্গিত।

অভিজিৎ ঘোষ, পানিপারুল, পূর্ব মেদিনীপুর

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

childhood Dewy Season

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy