সমুদ্র রায়ের ‘দেশপ্রেম মানে অসৌজন্য নয়’ (৩০-১০) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে লেখকের সঙ্গে সহমত হয়ে বলি, পাসপোর্ট দেখতে চাওয়া এক জন লাইব্রেরিয়ানের কাজ নয়, যদি না তাঁর নিয়োগকর্তা সে কাজ করতে বাধ্য করেন। এশিয়া কাপে ভারতীয় ক্রিকেটারদের অবস্থাও অনুরূপ বলেই অনুমান।
প্রায় দু’হাজার বছর আগে অলিম্পিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়েছিল— ‘খেলাধুলার থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখুন।’ কিন্তু এই আপ্তবাক্যটি লঙ্ঘিত হওয়ার একাধিক নজির রয়েছে বিশ্বের ময়দানে। ভারত-পাকিস্তান যুযুধান দুই দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বার বার ক্রীড়াক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে এই সংঘাতের তীব্রতা অনেক বেশি। গণমাধ্যমগুলি এই ক্ষেত্রে ধুয়ো দেওয়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে রান না পাওয়া আজহারউদ্দিনকে সহজেই উগ্র সমর্থকদের কাছে খলনায়ক হয়ে যেতে দেখেছি।
প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল খেলা শুরু ও শেষে করমর্দন করে সৌজন্য প্রকাশ করে, এ হল ক্রীড়াঙ্গনের এক প্রচলিত রীতি। বোর্ড ও বকলমে প্রশাসনিক সমর্থন ছাড়া ভারতীয় দলের অধিনায়কের পক্ষে এই প্রচলিত রীতি লঙ্ঘন করা অসম্ভব ছিল। পহেলগামে জঙ্গি হামলা ও অপারেশন সিঁদুর একটি দগদগে ক্ষত, নিঃসন্দেহে। তার পর ভারতীয় দল পাকিস্তানের মুখোমুখি হতে হবে জেনেই এই এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করেছিল। সম্ভবত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের বিষয়টিও সে সময়ই স্থির হয়ে যায়। অলিম্পিকে জ্যাভলিন থ্রো-এ নীরজ চোপড়া পাকিস্তানের খেলোয়াড়ের কাছে হেরে রৌপ্য পদক পেয়েছিলেন। সে সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নীরজের মা, নাদিমকে শত্রু দেশের প্রতিযোগী না ভেবে নিজের অন্য এক ছেলের সোনা জয়ে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। অভিনন্দন জানাতে নীরজকে ফোন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, তিনিও নীরজের মায়ের এই মনোভাবের প্রশংসা করেছিলেন।
আসলে ক্রিকেট মাঠে ভারত-পাক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ন্যায় অন্য কোনও খেলা রাজনৈতিক ভাবে তেমন লাভজনক নয়। অধিনায়ক ও তাঁর দল খেলার মাঠের বাইরের খেলায় দাবার বোড়ে মাত্র।
সরিৎশেখর দাস, কলকাতা-১২২
বিভেদনীতি
সমুদ্র রায়ের প্রবন্ধ ‘দেশপ্রেম মানে অসৌজন্য নয়’ নিঃসন্দেহে প্রাসঙ্গিক ও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে বর্তমান কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলটির নেতৃবৃন্দ যে ভাবে প্রতিনিয়ত তাঁদের হিন্দুত্ববাদী ভাবনায় দেশবাসীকে জারিত করতে চাইছেন, তার পরিপ্রেক্ষিতেই তথাকথিত উগ্র দেশপ্রেমে ‘স্পোর্টসম্যান স্পিরিট’-কে ভুলিয়ে দেওয়া অসম্ভব নয়।
এক কালের বিশ্বত্রাস হিটলারের অনুগামী এ দেশের বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ হিন্দুত্ববাদের মাহাত্ম্য বর্ণনায় সদা ব্যস্ত। কারণ তাঁরা ভোটযুদ্ধে জয়ী হতে চাইছেন। ভাবতে অবাক লাগে, খেলার মাঠে হিন্দু-মুসলমান অথবা অপারেশন সিঁদুর প্রসঙ্গ আসে কার মন থেকে? অবাক লাগে, শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত অগণিত মানুষ এই জাতীয় ভাবনার সহজ শিকার হচ্ছেন কী করে? ভেবে দেখার অবকাশ পাচ্ছেন না যে, তথাকথিত হিন্দুত্ববাদের নামে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে অবস্থানকারী দলিতদেরও প্রবল ভাবে পীড়ন করা হচ্ছে। তাঁরা তো মুসলমান নন। তা হলে কেন এমনটা হচ্ছে? এর উৎস সন্ধান করা আজ জরুরি।
বাস্তবে ব্রিটিশ ভারতে লর্ড কার্জ়নের পদচিহ্ন অনুসরণ করে জনজীবনের মৌলিক সমস্যাগুলি থেকে দৃষ্টি ফেরানোর পথটি আঁকড়ে ধরা হয়েছে। তা ছাড়াও বৃহৎ পুঁজিপতিদের সেবা করার লক্ষ্যে এ জাতীয় দেশপ্রেমের প্রচার ও প্রসার আজ নেতৃবৃন্দের ভোটযুদ্ধের হাতিয়ার। তা দরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। এর মধ্যে দেশপ্রেম খুঁজতে যাওয়া বৃথা। কারণ এমন দেশপ্রেম মনকে সঙ্কীর্ণ করে।
তপন কুমার সামন্ত, কলকাতা-৯
ব্যথিত
সমুদ্র রায়ের ‘দেশপ্রেম মানে অসৌজন্য নয়’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। জেদ, রাগ, প্রতিশোধ— এগুলো সমাধানের রাস্তা নয়। জবাব দেওয়ারও একটা সংস্কৃতিমনা রাস্তা আছে। এই রাস্তা আমাদের ভারতের মনীষীরা দেখিয়ে গিয়েছেন।
এশিয়া কাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারতের জয়ে আমি আনন্দ পেয়েছি। সকল ভারতবাসীই আনন্দ পেয়েছেন— এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই খেলাকে কেন্দ্র করে খেলার মাঠে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা অনেক খেলাপ্রেমী মানুষই মেনে নিতে পারেননি। আমরা ভাল কিছুকেই অনুকরণ করি। খারাপ বস্তু, দৃষ্টান্তকে পরিহার করি। কারও মধ্যে কিছু খারাপ দেখলে তাকে শোধরানোর চেষ্টা করি। বোঝানোর চেষ্টা করি, যাতে সে আবার কিছু খারাপ করার আগে দশ বার ভাবে।
পাকিস্তানের খেলোয়াড়ের অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গির পাল্টা হিসাবে ভারতের ভূমিপুত্রকে অঙ্গভঙ্গি করতে দেখলে তাই বড় খারাপ লাগে। এ তো আমাদের দেশের শিক্ষা নয়। তাই আশা রাখব, আগামী দিনে আন্তর্জাতিক খেলা যেন আর এমন দিন না দেখে। খেলা যেন আগের মতোই বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার অন্যতম মাধ্যম হয়।
নিখিল কবিরাজ, শ্যামপুর, হাওড়া
বিদ্বেষের বিষ
হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির রাখঢাকহীন বিদ্বেষের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ‘হাতে ও ভাতে’ (২৮-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, এই বিদ্বেষমূলক আচরণের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে যে সমস্ত প্রতিবাদ আমরা দেখতে পাই, তা এই অমানবিক আচরণ থেকে নিবৃত্তি পাওয়ার জন্য যেমন যথেষ্ট নয়, তেমনই এই ক্ষত সারানোর প্রকৃত ওষুধের সন্ধান এখনও অধরা। হিন্দুত্বের নামে প্রকৃত উদ্দেশ্য যে উত্তর ভারতীয় ধর্মাচরণ সমগ্র দেশের জনসাধারণের উপর চাপিয়ে দেওয়া, তা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির আচরণে প্রকট হয়ে উঠছে দিনের পর দিন।
হিন্দিভাষী ছাড়া অন্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরও রেহাই নেই এই প্রবল বিদ্বেষের হাত থেকে। সে জন্যই রামনবমী থেকে আরম্ভ করে ছটপুজো অবধি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে নিদান দেওয়া হচ্ছে দেশের সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ও নিরামিষ খাবার খাওয়া উচিত। এমনকি দুর্গাপুজোতেও দিল্লি-সমেত অনেক রাজ্যে বিভিন্ন ভাবে প্রচেষ্টা চলছে আমিষ থেকে বাঙালিদের দূরে রাখার জন্য, যা খুবই উদ্বেগের। এ ছাড়াও ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচনা করার জন্য নিজের এজলাসেই বিচারপতির আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার জন্য কোনও সমালোচনাই যথেষ্ট নয়।
রামমন্দিরে মূর্তি প্রতিষ্ঠার সময় প্রশাসনের ভূমিকাও দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী এবং হিন্দুত্ব নিয়ে গোঁড়ামির এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মনে হয় যেন প্রধান উদ্দেশ্য দেশের সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে একই ছাতার তলায় নিয়ে আসা। তার পর সেই উদ্দেশ্য সফল হলে, সমগ্র দেশেই উত্তর ভারতীয় ধর্মাচরণ ও সংস্কৃতি জোর করে চালু করা, যা এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং মূল লক্ষ্য, ‘এক দেশ, এক ধর্ম’। আশার কথা, বিভিন্ন বিরোধী দল তো বটেই, আদালতও পাশে দাঁড়িয়েছে এই সমস্ত ঘটনার বিরুদ্ধে। তবে বিরোধীদেরও উচিত, ধর্মের মোকাবিলার ক্ষেত্রে ধর্ম নয়, বরং ধর্মের ছোঁয়া থেকে নিজেদের যত দূর সম্ভব এড়িয়ে প্রতিটি আক্রান্ত মানুষের হাত ধরে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। সাধারণ মানুষও যাতে এই তথাকথিত হিন্দুত্ববাদের ফাঁদে পা না দিয়ে গর্জে ওঠেন সমস্ত ধর্মীয় বিভেদের বিরুদ্ধে, তার জন্য প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)