অশোক কুমার লাহিড়ীর ‘কাল ও পরশুর চিন্তা’ (১-৭) শীর্ষক প্রবন্ধটি পশ্চিমবঙ্গের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পটি তৃণমূলের ভোটবাক্স ভরিয়ে লোকসভা নির্বাচনে দলের সুবিধা করে দিয়েছে, যার ফলে পশ্চিমবঙ্গে শাসক দল আসনসংখ্যা বৃদ্ধি করে ২৯-এ পৌঁছে গেছে। কিন্তু রাজ্যের অর্থনীতির কী দশা হবে, তাঁর পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, এই লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের জন্য সরকারের প্রয়োজন হবে বছরে ২৫,৪০০ কোটি টাকা, কিন্তু বাজেট বরাদ্দ রয়েছে ১৪,৩০০ কোটি টাকা মাত্র। সুতরাং বাকি ১১,১০০ কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে? তার কোনও উত্তর পেলাম না। তা হলে কি অন্য খাতের টাকা থেকে খরচ হবে? না কি আবার অন্য কোথাও ট্যাক্স বসবে?
এই আলোচনায় অশোক লাহিড়ীর দু’টি বক্তব্য উঠে এসেছে। প্রথমত, লক্ষ্মীর ভান্ডার নিয়ে তৃণমূল বিজেপির বিরুদ্ধে জনগণকে ভুল বুঝিয়ে সুফল তুলেছে। অর্থাৎ, বিজেপি ক্ষমতায় এলে লক্ষ্মীর ভান্ডার বন্ধ করে দেবে। এটা কি নির্বাচনী প্রতারণা নয়? দ্বিতীয়ত, নির্বাচনী বৈতরণি পার হতে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকে লক্ষ্মীর ভান্ডারের সুবিধা পাইয়ে দেওয়া সরকারি টাকার অপব্যয় মাত্র। ধনীদের লক্ষ্মীর ভান্ডার দেওয়া কি তেলা মাথায় তেল দেওয়া নয়? গরিব মহিলাদের হাতে টাকা দেওয়ার যুক্তি থাকলেও ধনীদের মধ্যে দেওয়া অন্যায় নয় কি? এটা তো এক রকম জনগণের করের টাকায় পোদ্দারি করে অর্থনীতির সর্বনাশ ঘটানোর চেষ্টা।
সুতরাং, সরকারি টাকায় ভোট কেনার এই সহজ পন্থা বন্ধ হওয়া আবশ্যক। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দানসত্র করা যাবে না। নয়তো আগামী দিনে অর্থনীতির ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর সমস্যা সৃষ্টি হবে। সে জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং ডোল রাজনীতি পরিহার করতে হবে। তবেই অর্থনীতি বাঁচবে।
আনন্দ মোহন দাস, ভদ্রকালী, হুগলি
সাম্যের দৃষ্টান্ত
দেশের শীর্ষ আদালত নারীর ক্ষমতায়নের জন্য একটি নতুন উদ্যোগ করেছে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করেছে যে, মুসলিম মহিলারাও ফৌজদারি আইনের (সিআরপিসি) ১২৫ ধারার অধীনে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী (সাম্যের সম্মান, ২৩-৭)। বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন এবং অগাস্টিন জর্জ মাসি নীতিটি ব্যাখ্যা করেছেন, রক্ষণাবেক্ষণ খয়রাতি নয়, সব ধর্মাবলম্বী বিবাহিত মহিলার মৌলিক অধিকার। তেলঙ্গানার মহম্মদ আবদুল সামসাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই সিদ্ধান্ত। তেলঙ্গানা হাই কোর্টও একই ধরনের রায় দিয়েছিল, যাকে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন আবদুল সামসাদ। যুক্তি ছিল, মুসলিম মহিলারা শুধুমাত্র মুসলিম মহিলা (বিবাহবিচ্ছেদের পরবর্তী অধিকার) আইন ১৯৮৬-এর অধীনে ভরণপোষণের দাবি করতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আবেদন খারিজ করে দেয়। আদালতের বিশ্বাস, ১২৫ ধারা একটি ধর্মনিরপেক্ষ বিধান, যা দেশের সমস্ত মহিলার জন্য প্রযোজ্য।
এই সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক শাহ বানো মামলার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আদালত ১২৫ ধারার অধীনে তালাকপ্রাপ্ত মুসলিম মহিলার ভরণপোষণের অধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিল। ১৯৮৬ সালের আইন এই অধিকার সীমিত করার বিধান দিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ওই রায় বজায় ছিল। তবে, আদালতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত ১২৫ ধারার স্থায়ী গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করে। নারীদের ন্যায্য অধিকার ও সুরক্ষা প্রদানের দৃষ্টিতে সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
এই রায় থেকে এই বার্তা মেলে যে, একবিংশ শতাব্দীতে নারী অধিকার নিয়ে আমাদের চিন্তাধারা প্রগতিশীল হওয়া উচিত। যে কোনও ধর্মের নারীর অধিকারকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। তাই বিবাহবিচ্ছেদের পরে ভরণপোষণের জন্য আর্থিক সহায়তা পাওয়ার অধিকার মেয়েদের রয়েছে। ভারতে বিবাহবিচ্ছিন্ন মেয়েদের নিজের কাছে রাখতে পরিবার সক্ষম হলেও তা ভাল ভাবে দেখা হয় না। তাই তাঁদের জীবন কঠিন হয়ে পড়ে। তাই সিদ্ধান্তটি স্বাগত। শীর্ষ আদালতের এই সিদ্ধান্ত শুধু সাংবিধানিক নীতিকেই সমর্থন করে না, মুসলিম মহিলাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকেও শক্তিশালী করে।
অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর
কৈশোরের সঙ্কট
‘প্রথম পাঠ’ (১১-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রবন্ধটিতে যথার্থ ভাবেই বলা হয়েছে যে, কচি মনের ছেলেমেয়েদের কাদার তালের মতো মন ও পবিত্র হৃদয় বিষিয়ে যাচ্ছে তাদের বাড়ির পরিবেশ, স্কুলের পরিবেশ আর সামাজিক কদর্য পরিবেশের প্রভাবে। এর অন্যতম কারণ হল— রাজনৈতিক দুষ্টচক্র যা গুরুজন, শিক্ষক আর পুরো সমাজের উপর দায়িত্বজ্ঞানহীন অনৈতিক কর্তৃত্ব ফলিয়ে কৈশোর ও যুবমনে সীমাহীন অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতার বাতাবরণ তৈরি করেছে। এতে অনেক ভাই-বোন প্রাণ খুলে হাসতেই ভুলে গিয়েছে। তারা যেন চতুর্দিক থেকেই একটা চাপে রয়েছে। শিক্ষকরা চাইলেও মন-প্রাণ দিয়ে মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে পারেন না, তাতে এখন অনেক ঝামেলা। গুরুজনরা অনেক সময়ই তাদের প্রতি অযথা বিরূপ হন। তা ছাড়া সমাজে মিশতে গিয়েও নানা বিপদ এসে জোটে।
দোকান-বাজার স্কুল, কলেজ, পাড়া, থানা, অফিস সর্বত্র এই পরিস্থিতিই চলছে। এমন বিভিন্ন টুকরো টুকরো ঘটনা আগেও দেখা যেত, কিন্তু বর্তমানে তা যেন মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। পিতামাতা, অন্য আত্মীয়দের সঙ্গে শিশুর কোনও বনিবনা নেই, বন্ধুবান্ধবের প্রতি অকারণ সন্দেহ, সকলের সঙ্গে মিশে কাজ করা, সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলায় তাদের আগ্রহ ক্ষীণ— মূলত বর্তমানের নেটদুনিয়ার দৌলতে। এর সবটাই যে নেতিবাচক, তা নয়। এদেরই মধ্যে যে ক’জন ভাই-বোন এ সমস্ত জটিলতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের সুকুমার বৃত্তিগুলিকে সযত্নে প্রতিপালন করতে পেরেছে, সমাজ ধন্য হয়েছে তাদের অকৃত্রিম প্রতিদানে। আমরা শিক্ষা, ক্রীড়া, বিজ্ঞান, সংস্কৃতির জগতে এর প্রতিফলন দেখে তৃপ্ত হই। এরাই প্রকৃতপক্ষে সমাজকে ধারণ করে রেখেছে।
তাই প্রথম পাঠ হিসাবে সুস্থ মস্তিষ্ক আর হৃদয়বান মানুষদের অক্লান্ত চেষ্টার দ্বারা এক দিকে সমাজের সমস্ত দুর্নীতিবাজের মধ্যে সততা, শ্রদ্ধা, সর্বোপরি প্রেম উজ্জীবিত করে, আর অন্য দিকে কচিকাঁচাদের সৎ-চরিত্রবান করে গড়ে তুলতে পারলে এই সুন্দর পৃথিবীতে সকলেই একটু শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। তখন সব ক্ষেত্রেই সর্বোত্তম উৎকর্ষের জন্য প্রতিযোগিতা থাকলেও থাকবে না শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি, সকল বৃত্তিমূলক পরীক্ষাতেই কারচুপির মতো নানা ঘৃণ্য কাজ। হয়তো থাকবে না সংবিধান-আইনের অপব্যবহার, সর্ব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং হানাহানির মতো ঘটনা।
মনে রাখতে হবে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজে সবাই সবার আপন। তখন একে-অপরকে একটু সাহায্য করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে হবে। ফলস্বরূপ কৈশোর উত্তীর্ণ যুবক-যুবতীরা একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে। তখন তারাই স্ব-উৎসাহিত হয়ে নিজেদের জীবনকে এক উচ্চ মাত্রায় নিয়ে যাবে।
সুব্রত পাল, গঙ্গাধরপুর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy