‘শিক্ষার ব্যাধি’ (১০-৯) সম্পাদকীয়তে বতর্মান দুর্দশাগ্রস্ত শিক্ষাপরিস্থিতির প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। সারা দেশেই দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা বাড়ছে। কমছে সরকারি স্কুলে। সরকার বা সরকারপোষিত স্কুলগুলিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক এবং এটি তাদের মৌলিক অধিকার। এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন সরকারি অনুদান— ব্যাগ, বই, খাতা, পোশাক, সর্বোপরি মিড-ডে মিল, যার একটিও মেলে না বেসরকারি স্কুলে। উপরন্তু তাদের বাৎসরিক ফি বেড়ে চলে লাফিয়ে লাফিয়ে। তবু কিসের টানে অভিভাবকেরা ছুটে চলেছেন সে দিকে? কারণ, সেখানে মিলছে সময়োপযোগী শিক্ষা। বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক পরিকাঠামোয়, ব্যক্তিগত নজরদারিতে, পরিশ্রমী ও দায়বদ্ধ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাঠদান পড়ুয়াদের এগিয়ে দিচ্ছে অনেকটা।
সেই জন্যই একেবারে শৈশব থেকেই ঘরের পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে বাবা-মায়েরা ছুটছেন বেসরকারি স্কুলে। ভীষণ পরিতাপের বিষয়, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগেও অনেক অঙ্গনওয়াড়ি শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই! কিছু কিছু জায়গায় স্থানীয় উদ্যোগে এ সমস্যার সমাধান হলেও তা ব্যতিক্রম। ফলে সকালের দু’-তিন ঘণ্টা পাখাহীন ঘরে, কয়লা ধোঁয়ার দূষণে থাকতে বাধ্য হয় শিশু এবং শিক্ষিকারা। শিক্ষা তো দূরের কথা, এমন ভাবে স্বাস্থ্য ঠিক থাকাটাই তো দুরাশা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা আরও সঙ্গিন। সংবাদপত্রে প্রকাশ, স্কুলবাড়ি থাকলেও শিক্ষকের অভাব তীব্র। মাত্র দু’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা বাধ্য হচ্ছেন পাঁচটি শ্রেণির পড়ুয়াদের পড়ানোর দায়িত্ব নিতে। ছুটছেন এ ক্লাস থেকে ও ক্লাসে। তার মাঝেই রয়েছে হরেক সরকারি দায়িত্ব ও মিড-ডে মিল। এ ভাবে পাঠদান সম্ভব? উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতেও বিভিন্ন ‘শ্রী’যুক্ত পরিষেবা প্রদানে বছরভর শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিযুক্ত থাকতে হয়। অনিয়মিত সরকারি অনুদান, অথচ ভর্তি ফি বেশি নেওয়ার আইন না থাকায়, আর্থিক সঙ্কটে ভোগে বেশির ভাগ স্কুল। আংশিক সময়ের শিক্ষক নিয়োগ, স্কুলের পরিচ্ছন্নতা ও পরিকাঠামো ঠিকঠাক রাখার খরচ সামলাতে জেরবার হন কর্তৃপক্ষ। তার উপর নির্বাচন ও হরেক সরকারি ক্যাম্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পঠনপাঠন। ফলে, অবৈতনিক শিক্ষা হয়ে দাঁড়ায় সোনার পাথরবাটি। গৃহশিক্ষকতা-নির্ভর ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়কে ব্যবহার করে কেবল সরকারি সুবিধা পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে।
পার্থ পাল, মৌবেশিয়া, হুগলি
পরিত্রাণ অধরা
‘শিক্ষার ব্যাধি’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে বলি, অভিভাবকরা বিলক্ষণ জানেন, সন্তানকে সমাজে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পেতে হলে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তাই তাঁরা সে বিষয়ে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখতে চান না। আর এই কারণেই ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খোঁজ প্রত্যেকে করে থাকেন। কিন্তু সরকারি উদাসীনতার কারণে এ দেশে শিক্ষাক্ষেত্রটি আজ ব্যবসাক্ষেত্রে পরিণত। যিনি যেমন খরচ করতে পারবেন, তিনি তেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেছে নিয়ে সন্তানকে শিক্ষা দিতে পারবেন। এতে সংবিধান স্বীকৃত শিক্ষার অধিকারের প্রশ্ন উপেক্ষিত। সাধারণ মানুষ অসহায়, দিশাহারা।
বেশির ভাগ দেশেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত। তবে রাষ্ট্র যখন সে দায় অস্বীকার করে বা দায়সারা ভাবে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করে, তখন সন্তানের শিক্ষার দায় মা-বাবাকেই নিতে হয়। ‘আর্থিক সমস্যা স্বীকার করেও’ সরকারি স্কুলের তুলনায় ন’গুণ বেশি ফি গুনতে তাঁরা রাজি হয়ে যান। কিন্তু, সাধ্যাতীত টাকা খরচ করার পরেও সেই সব স্কুলে শিক্ষার্থীদের সিলেবাস সব সময় সম্পূর্ণ হয় না। ঘাটতি পূরণের জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ, কয়েক দশক আগেও গৃহশিক্ষকতার বাজারের এমন রমরমা ছিল না। তখন শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাই শিক্ষার্থীদের যাবতীয় চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু এখন সে সুযোগ নেই। এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বার করা কঠিন।
শিক্ষা সভ্যতার পিলসুজ। সুপরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থাই পারে দেশকে সুনাগরিক উপহার দিতে। এই কারণেই বিশ্বের প্রতিটি উন্নত দেশে, শিক্ষকতার কাজে উচ্চশিক্ষিতদের নিয়োগ করা হয়। এই কাজে ফাঁকি থাকলে দেশ কখনও এগিয়ে যেতে পারবে না। তা ছাড়া, শিক্ষার্থীর মেধা কখনও পরিবারের আর্থিক সঙ্গতির উপর নির্ভর করে না। তাই বিদ্যালয়-শিক্ষার সুযোগটা যাতে সকলে অবৈতনিক ভাবেই পেতে পারে, তার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। আমাদের দেশেও এত দিন বিদ্যালয়-শিক্ষা ও উচ্চতর শিক্ষার অনেক সুযোগ সকলে সমান ভাবে পেতে পারত। এখন সে সুযোগ ক্রমাগত কমছে। বাড়ছে বৈষম্য। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্কুল সার্ভিস কমিশন-এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির খবর প্রকাশ্যে আসায় যোগ্যদের শিক্ষকতার কাজে নিয়োগের জন্য আদালতের বিচারকদের নির্দেশ দিতে হচ্ছে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ-পদ্ধতির ক্ষেত্রে কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড না থাকায় সেখানে কর্মরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মান নিয়ে কেউ কোনও প্রশ্ন তোলার সুযোগই পান না।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের সদিচ্ছা ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা না থাকায় শিক্ষাক্ষেত্রে যে ব্যাধিগুলি দেখা যাচ্ছে, সেইগুলি দিনের পর দিন চলতে থাকবে। তাতে আগামী প্রজন্ম অশিক্ষার গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যেতে খুব বেশি দিন সময় নেবে না।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
পাশ-ফেল
দু’টি সম্পাদকীয় ‘শিক্ষার ব্যাধি’ এবং ‘গভীর লজ্জা’-তে (১৬-৯) সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ক্রম অবনমন, তার পরিণতিতে ছাত্র ভর্তি হ্রাস, পাশাপাশি বেসরকারি স্কুলে ছাত্রবৃদ্ধির ঘটনার সম্ভাব্য কারণ অন্বেষণ করা হয়েছে। বহু জাতি অধ্যুষিত আমাদের দেশে সর্বজনীন শিক্ষা একমাত্র সরকারি ব্যবস্থাতেই সম্ভব। অন্যথায় ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দূর করা যায় না। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’তে প্রাক্ প্রাথমিক শিক্ষাকে আবশ্যিক করতে তিন বছর থেকে শিশুদের শিক্ষাদান শুরু করতে বলা হয়েছে এবং তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে। এর জন্য কেন্দ্রগুলির পরিকাঠামো তৈরি, কর্মীদের প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। অথচ পাঁচ বছরে কিছুই হল না। এ অবস্থায় অভিভাবকরা সরকারি এই বেহাল ব্যবস্থার উপর নির্ভর করবেন, না কি পাড়ায় গজিয়ে ওঠা স্কুলগুলিতে ভিড় করবেন? কয়েক বছর ধরে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ, অপরিকল্পিত এবং ইচ্ছা অনুযায়ী বদলির ফলে বহু স্কুলে বিষয়-শিক্ষক নেই। ফলে স্কুলগুলির শিক্ষণ প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে। কিন্তু দু’টি সম্পাদকীয়তেই একটা জরুরি বিষয় অনুল্লিখিত থেকে গিয়েছে— সরকারি স্কুলে দীর্ঘ সময় পাশ-ফেল না থাকা। এর ফলে ধীরে ধীরে লোকচক্ষুর আড়ালে শিক্ষার মানের অবনমন আজ এই পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে।
তপন চক্রবর্তী, কলকাতা-১
দীর্ঘ প্রশ্ন
বাংলা বোর্ডের দ্বাদশ শ্রেণির প্রথম সিমেস্টার সম্পর্কে কিছু কথা। দেখা গিয়েছে অঙ্ক, ফিজ়িক্স এবং আরও কয়েকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অসম্ভব দীর্ঘ হয়েছে। অনেকের পক্ষেই পুরোটা শেষ করা সম্ভব হয়নি। বোর্ড থেকেও দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের কথা স্বীকার করা হয়েছে। এর পর সান্ত্বনা বাক্য শোনানো হয়েছে, খাতা দেখার সময় এই অসুবিধার কথা মনে রাখা হবে। কিন্তু প্রশ্ন, পরীক্ষার উত্তরপত্র তো ওএমআর শিট। সেখানে কী ভাবে ছাত্রদের অসুবিধার কথা মনে রেখে নম্বর দেওয়া যাবে? সে ক্ষেত্রে ছাত্রদের প্রতি ন্যায্য বিচারের মাপকাঠি কী হবে?
রূপেন মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্যারাকপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)