এই যে কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর মুখে ধ্বনিত হইল অ্যান্টি-স্যাটেলাইট পরীক্ষা সংক্রান্ত সেই ‘বিরাট’ সংবাদ, তাহা কি কোনও ভাবে নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘন করিল? দুষ্ট লোকের মতে, ওই সংবাদ শুনাইবার জন্য ডিআরডিও-ই যথেষ্ট, অন্য কাহারও তরফে অমন ঘোষণা অসঙ্গত, বিশেষত নির্বাচনের ঠিক আগে। কিংবা এই যে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সভামঞ্চ হইতে মুকুল রায় কোচবিহারের পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে ‘দেখিয়া লইবার’ হুঙ্কার দিবার পরই নির্বাচন কমিশনের বিজ্ঞপ্তিতে সেই সুপার পদান্তরিত হইলেন, ইহাও কি কাকতালীয়? দুষ্ট লোকের মতে, কমিশন যে নিরপেক্ষ নয়, তাহার সাক্ষাৎপ্রমাণ এই ঘটনা। কিংবা, নির্বাচন কমিশনের স্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ও তাঁহার দল যে দেশের সেনাবাহিনীকে যদৃচ্ছ ভাবে নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহার করিতেছেন, তাহা কি বিধি-বহির্ভূত নহে? সে ক্ষেত্রে কমিশন কিছু বলিতেছে না কেন? উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তাঁহার প্রচারসভায় সেনাবাহিনীকে মোদী-সেনা বলিয়া অভিহিত করিতেছেন, আর কমিশন চুপচাপ দেখিতেছে, এ কেমন কথা? দুষ্ট লোক বলিতেছে, বিধি-বহির্ভূত হইলেও নির্বাচন কমিশন কিছু বলিতেছে না, বলিবে না— বলিতে চাহে না বলিয়াই।
এই দেশের গণতন্ত্র যে কোথায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহার প্রমাণ নির্বাচন কমিশনের এই অবস্থানে। নির্বাচনী বিধি তো কেবল বিধি হিসাবেই পালনীয় নহে, তাহার পিছনে একটি নৈতিকতার আদর্শ আছে। সেই নৈতিকতা হইতে রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীরা বিচ্যুত হইলে কমিশনের কী কর্তব্য, তাহা দেখা গিয়াছে টি এন শেষনের মতো প্রশাসকের আমলে। কমিশনের সাংবিধানিক মান্যতার মর্যাদা তাঁহার মতো প্রশাসকরা কড়া হাতে সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছিলেন। অত্যন্ত দুর্ভাগ্য ও বিপদের কথা যে সেই মান্যতা এই বার কমিশন নিজের হাতে নষ্ট করিল। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি যথার্থ প্রশ্ন তুলিলেও কমিশন সেগুলিকে পাত্তা দিল না। কংগ্রেস দলের পক্ষে তরুণ কুমার, তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষে ডেরেক ও’ব্রায়ান, কিংবা নির্বাচন বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব, সকলেই সমস্বরে কমিশনের অনৈতিকতার অভিযোগ তুলিলেও কমিশন অধিকাংশ ক্ষেত্রে কান দিল না। কেবল একটিমাত্র ক্ষেত্রে তাহাকে নড়িয়া বসিতে দেখা গেল: নরেন্দ্র মোদীর বায়োপিক, অর্থাৎ জীবনী-চলচ্চিত্র আপাতত বন্ধ করিবার বিষয়টিতে। সেই নিষেধাজ্ঞা মোদীর নামে একটি আস্ত টেলিভিশন চ্যানেল চালাইবার বিরুদ্ধেও প্রযুক্ত হইতে চলিয়াছে। দুষ্টেরা অবশ্যই বলিতেছে, ইহা অতি বিলম্বে অতি সামান্য। নির্বাচন কমিশন অনেক আগে এই পদক্ষেপ করিতে পারিত। এত দিন পরে যে সিদ্ধান্তটি ঘোষিত হইল, তাহাই বুঝাইয়া দেয় কমিশনের বিবেচনাপদ্ধতি কেমন।
আর একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলিতে হয়। এই বারের নির্বাচনের নির্ঘণ্টটিও কিন্তু যথেষ্ট ভ্রুকুঞ্চনের কারণ। যত দীর্ঘ সময়ব্যাপী নির্বাচনপর্ব চলে, নির্বাচন-সংক্রান্ত শ্রম, ব্যয় ও দুর্নীতি সকলই পাল্লা দিয়া বাড়ে। ভাবিয়া দেখিলে বোঝা যায়, কেন্দ্রীয় শাসক দলেরই ইহাতে সুবিধা হইবার কথা। দুষ্ট লোকের অভিযোগ এ ক্ষেত্রেও সত্য প্রমাণিত হইতেছে যে, ইহাতে প্রধানমন্ত্রীর গোটা দেশ পরিভ্রমণ করিয়া প্রচার করিতে সুবিধা হইবে। শাসক দলের প্রচার যে হেতু স্পষ্টতই প্রধানমন্ত্রীসর্বস্ব, তাই বিষয়টি বিজেপির নিকট অতিমাত্রায় জরুরি ছিল। সব মিলাইয়া, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে এই বিপুল পরিমাণ অভিযোগ ভোটের আগেই সামগ্রিক নির্বাচনী পদ্ধতির নিরপেক্ষতা লইয়া নাগরিক মনে সংশয় বুনিয়া দিয়া গেল। গত পাঁচ বৎসরে বিজেপি-শাসনে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির যে ক্রমাধঃপতন দেখা গিয়াছে, তাহারই চিহ্ন নির্বাচন কমিশনের এই পক্ষাবলম্বন এবং/অথবা ঔদাসীন্যে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy