শহুরে সভ্যতার তথাকথিত আধুনিকতা, দূষণ আর ভোটসর্বস্ব রাজনীতি কি ভেঙে দিচ্ছে উত্তরবঙ্গের চিরাচরিত গ্রামীণ সংস্কৃতি আর সহজ-সরল জীবনবোধ? ‘চারিদিকে আলো জ্বলে অন্ধকার ঘোচে না তথাপি’! সংস্কৃতি জীবনের উজ্জ্বল আলো আবার সংগ্রামের শাণিত হাতিয়ার। সাংস্কৃতিক সম্প্রসারণ ও পরিবহণের দ্রুত উন্নয়ন যেমন ঘটছে, তেমনই এই মসৃণ পথ ধরেই কলুষিত করছে গ্রামীণ জনমানস। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো রাজনীতির আদর্শহীনতা কুঠারাঘাত করছে আদি অকৃত্রিম জীবনধারায়। সম্বৎসরের সরল জীবনযাপনের কাঠামো দুর্বল হচ্ছে ভোট-রাজনীতির দৌরাত্ম্যে।
এক দিকে যন্ত্রসংস্কৃতির আক্রমণে কার্যত হাঁসফাঁস করছে গ্রামীণ জীবন। অন্য দিকে রাজনৈতিক আদর্শহীনতা মেরুদণ্ডহীন করে দিচ্ছে সমাজের একাংশকে। সহজে কিছু পাওয়ার নেশা মত্ততা জাগাচ্ছে। শহুরে সভ্যতার এই দূষণ বহুচর্চিতই। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির তৎকাল-সুযোগ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত অনেকেই। আর মুল্যবোধের অন্তর্জলি যাত্রা ঘটিয়ে এক ধরনের মেকি আনুগত্যের জন্ম হচ্ছে সর্বত্র। প্রয়োজন ফুরলেই তা উবে যাচ্ছে। এ এক মারাত্মক প্রবণতা। ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী। ব্রিটিশ শাসনের লাগামহীন শোষণের বিরুদ্ধে জনপ্রাণ দিয়ে লড়াই করেছেন দেশবাসী। তখনও এমন মানুষ যে ছিল না, তা নয়। স্তাবকতা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু যদি ভালবাসা, শ্রদ্ধা, ভক্তি না থাকে, তা হলে মুশকিলই! তা মহামারীর আকার ধারণ করলে বিপদ!
গণতন্ত্রের সংজ্ঞা রোজ বদলে দিচ্ছেন কিছু গণনেতা! উত্তরবঙ্গের সচেতনতার ঐতিহ্য রয়েছে। কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনের সুমহান ইতিহাস রয়েছে। তেভাগা আন্দোলন কিংবা চা-বাগানের আন্দোলন। দাঁতে দাঁতে চেপে লড়াই করেছেন পাহাড়-সমতলের মানুষ। বিভেদকামী শক্তি সক্রিয় ছিল কম-বেশি। কিন্তু তা গ্রাস করতে পারেনি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে। ডুয়ার্স-তরাই ও বারেন্দ্রভূমি জুড়ে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে তুখোড় রাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্ম দিয়েছে উত্তরবঙ্গ। চা-বাগান আন্দোলনে দেখেছি লালশুঁক রাওকে। কী ভাবে লোকগানে তৎকালীন সমাজব্যবস্থাকে তুলে শ্রমিক মহল্লায় সচেতনতা গড়ে তুলেছেন! মালদহের গম্ভীরা কিংবা উত্তর দিনাজপুরের খন লোকগান, সত্যপিরের গান ও মুখোশনৃত্য-সহ এমন বহু লোকসংস্কৃতির ধারকবাহক এই উত্তরবঙ্গ। সে সব লোকগান ও পালায় সত্য ও বাস্তবকে তুলে ধরা হত। বর্তমানে তা অনেকটাই ক্ষীণ।
সংসদীয় গণতন্ত্রে দল পরিবর্তন অন্যায় নয়, যদি তা কোন আদর্শকে সামনে রেখে হয়। একজনের কাছে যা ভাল, অন্যজনের কাছে তা খারাপ হতেই পারে। কিন্তু আমরা দেখি, সরকার পরিবর্তনে প্যান্ডেলের কাপড় আর চেয়ারের রঙও বদলে যায়। তখনই দুঃখ হয়! এ দোষ সাধারণ মানুষের নয়। সমাজবদলের স্বপ্ন দেখানো নেতাও পতাকা বদল করেন সহজে! এ ভাবেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির জন্ম হচ্ছে। অবশ্যই সেই ব্যক্তি প্রভাবশালী। অর্থ আর পেশিশক্তি তাঁর মূলধন। দুর্নীতির হাতেখড়ি শুরু পঞ্চায়েত স্তর থেকে। যে পঞ্চায়েত পরিচালনার ভার গ্রামের মানুষের হাতে, তা আজ ভোটসর্বস্ব হয়ে উঠেছে। কখনও-বা প্রতিহিংসাপরায়ণও। পঞ্চায়েত যদি দুর্নীতির আঁতুড় হয়ে যায়, গ্রামীণ জীবনবোধের মৃত্যু ঘটতে বাধ্য। আগামী প্রজন্ম এ সব দেখেই বড় হচ্ছে। শিশুর অবচেতন মনে এ সব আদর্শহীনতা গেঁথে যাচ্ছে। সর্বত্র দুর্নীতি, আলুটা-মুলোটার লোভনীয় টোপ! যা পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রমিত হচ্ছে।
সেটাই চিন্তার বিষয়! এমন ধরনের পাইয়ে দেওয়ার সংস্কৃতিরই আমদানি হয়েছে গ্রামে গ্রামে। কাজেই, নির্ভেজাল গ্রামীণ সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রে নির্বাচন আসে-যায়। এটাও একটা উৎসবের মতো। কিন্তু নির্বাচনে তো মানুষ ভোটাধিকার থেকেও বঞ্চিত হন। যে দল যেখানে পেশিশক্তিতে এগিয়ে, তারা তাদের রাজ্যপাট যেন-তেন-প্রকারেণ ধরে রাখতে মরিয়া। পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে যে বন্ধন, তা ভেঙে পড়ছে। অন্নপ্রাশন থেকে চাকরি— সর্বত্র রাজনীতির রং লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে! এতে গ্রামীণ সংস্কৃতি বাঁচে না!
গোটা রাজ্যের মতো উত্তরবঙ্গেও বেকার সমস্যা এক ভয়ঙ্কর বিষয়। সীমান্ত অঞ্চলের যন্ত্রণা তো আছেই। সঙ্গে রয়েছে অন্য নানা সমস্যাও। গ্রামের খুব কাছাকাছি শহর ও মফস্সলের অবস্থান হওয়ায় শিক্ষিত ও আর্থিক দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা শ্রেণির মানুষ গ্রাম ছাড়ছেন। তাঁদের বিশ্বাস, শহরই স্বর্গরাজ্য। সাধারণ বিদ্যালয়গুলি ধুঁকছে। ঝোঁক বাড়ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রতি। শিক্ষকদের অধিকাংশই গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করেন না। অভিভাবকহীন হয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চল। স্কুলছুট বাড়ছে। গরিব, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির বেকার ছুটছেন ভিন রাজ্যে কাজের খোঁজে। আর এই অর্থনৈতিক দুরবস্থার সুযোগকে কাজে লাগাছে পাচারকারীরা। তাতে সংকীর্ণ রাজনীতির দায়ও কম নয়।
সব মিলিয়ে এক অবর্ণনীয় দমবন্ধ অবস্থায় ছটফট করছে অকৃত্রিম গ্রামসমাজ!
(লেখক ফাঁসিদেওয়ার নজরুল শতবার্ষিকী বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy