Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪

মহাত্মাহীনতা

সে দিন গিয়াছে। সর্বজনের নিমিত্ত এক সমাজের কথা দিগন্তে মিলাইয়াছে। লক্ষণীয়, গাঁধীজি নিজেকে যতখানি ভারতীয় ভাবিতেন, ততখানি বিশ্বনাগরিকও ভাবিতেন।

মহাত্মা গাঁধী

মহাত্মা গাঁধী

শেষ আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

চল্লিশ বৎসরের সংগ্রামে কেবল ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা করেন নাই মহাত্মা গাঁধী, নূতন দেশ গড়িবার সঙ্কল্পও লইয়াছিলেন। ভারত বহু কালই সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় ও ভাষাগত কুসংস্কারে আচ্ছন্ন এক দেশ। উহাকে ব্রিটিশ শাসনের করাল গ্রাস হইতে মুক্তি দিবার সহিত এই দেওয়ালগুলিকেও ভাঙা জরুরি, মনে করিতেন গাঁধীজি। মূলগত ভাবে সংঘাতপূর্ণ এক দেশে শান্তির ললিত বাণী শুনাইতে বিপুল সাহসের প্রয়োজন— কিন্তু গাঁধীজি বলিতে পারিয়াছিলেন যে ভারতবাসীর একসঙ্গে বাস করা সামান্য সমন্বয়ের ব্যাপার নহে, একে অপরের প্রতি সমমর্মী ও প্রীতিপূর্ণ হইবার অভিলাষ। না, গাঁধীজির ভারত-ভাবনা ভারতের রাজনীতি গ্রহণ করিতে পারে নাই। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ ও তৎপরবর্তী রাজনীতি উহার সাক্ষাৎ প্রমাণ। তবে রাজনীতির বাহিরে কিছু কিছু সামাজিক পরিসরে গাঁধীজি পরিকল্পিত সমাজতন্ত্র এ দেশে বাস করিত। অনাড়ম্বর জীবনবোধ, সমাজের হিতাকাঙ্ক্ষাকে মূল্য দিবার ইচ্ছাটুকু কিছু কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যাইত।

সে দিন গিয়াছে। সর্বজনের নিমিত্ত এক সমাজের কথা দিগন্তে মিলাইয়াছে। লক্ষণীয়, গাঁধীজি নিজেকে যতখানি ভারতীয় ভাবিতেন, ততখানি বিশ্বনাগরিকও ভাবিতেন। বৈদেশিক শাসন হইতে স্বদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও ব্রিটিশ জাতির প্রতি ঘৃণা পোষণ করিতেন না তিনি। তাঁহার সংগ্রাম ছিল মানবসভ্যতার জন্য। মানুষের উপর মানুষের শোষণ এবং অত্যাচার থামাইবার উদ্দেশ্যেই সেই লড়াই। তিনি মনে করিতেন, কেবল বিদেশি শাসনের কবল হইতে মুক্তি নহে, সামাজিক শোষণ হইতে মুক্তি না ঘটিলে দাসত্ব শৃঙ্খল ঘুচিতে পারে না। আর আজ? মধ্যপ্রদেশে দলিত শিশুর গণপ্রহারে নিধন কিংবা উত্তরপ্রদেশের আলিগড় রেল স্টেশনে গণপ্রহারের শিকার মুসলমান পরিবারের কথা শুনিয়া ভাবিতে ইচ্ছা করে: এই তীব্র ও প্রাণঘাতী ঘৃণার শৃঙ্খল দেখিবার পর স্বরাজ ও স্বাধীনতার কী মূল্য থাকিত গাঁধীর নিকট। নিজের আজীবনলালিত আদর্শ কী ভাবে অপ্রাসঙ্গিক করিয়া দিয়াছে তাঁহার দেশ, দেখিলে তিনি কী বলিতেন।

ভারতবাসী গাঁধীজিকে ব্যর্থ করিয়াছে। তাঁহার মূর্তির সংখ্যা যত বাড়িয়াছে, তাহার বহুগুণ বেশি ধুলা জমিয়াছে তাঁহার শিক্ষায়, সত্য-সন্ধানে, মূল্যবোধে। এমন নহে যে তাঁহার নীতি ও বক্তব্য আজ অপ্রাসঙ্গিক। আজও ভারতের বাহিরে যদি কোনও আধুনিক ভারতীয়ের রাজনীতিদর্শন ও সমাজচিন্তা লইয়া জানিবার আগ্রহ থাকে, শিখিবার উদ্যম থাকে, তাহা মহাত্মা গাঁধীর পন্থা বিষয়ে। তিনি ত্যক্ত হন নাই। ভারত তাঁহাকে ত্যাগ করিয়াছে। তাঁহার জন্মসার্ধশতবর্ষ অবধি আসিয়া ভারত এই মনোবল সঞ্চয় করিতে পারিয়াছে, যাহাতে গাঁধীকে আর পূজাও না করিতে হয়। এত দিনের পূজার বিগ্রহটিও পাল্টাইয়া ফেলিতে অবশ্যই মনের জোর লাগে। ২০১৯ সালের ভারত সেই জোর কব্জা করিতে পারিয়াছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের কাল হইতে জনগণের হৃদয়ে তিনি ‘জাতির পিতা’ হিসাবে স্থান পাইয়াছিলেন। কিছু দিন পূর্বে তাঁহার সেই স্থানও গিয়াছে বলিয়া শোনা গেল। সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। এই ভারতকে মহাত্মার সন্তান বলা মহাত্মার প্রতিই অবমাননা। মহাত্মার ভারত মানুষে মানুষে ভালবাসার কথা বলিত। এই ভারতে ভালবাসা নাই, সত্য নাই। তাই মহাত্মাও নাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mahatma Gandhi Father Of Nation
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE