Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Makar Sankranti

‘হ্যাপি সংক্রান্তি’ আর ছুটি, নতুন প্রজন্মের মকর যোগ

একসময় মকর পরবের আগের রাত থেকে আচার অনুষ্ঠানে ঘুম হত না। এখন সেই জৌলুস অনেকটাই কমেছে। নতুন প্রজন্মের অনেকে খুব একটা আগ্রহী নন প্রাচীন এই উৎসবে। নতুনদের পৌষপার্বণ বা মকর পরবের আমেজ বোঝার চেষ্টায় আনন্দবাজারসময়ের সঙ্গে প্রাচীন অনেক উৎসবই ঔজ্জ্বল হারায়। মকর কি ধরে রেখেছে তার গৌরব? নতুন প্রজন্মের কাছে মকরের গুরুত্ব কেমন? 

পালন: টুসু ভাসানের আগে চলছে নাচ-গান। গুড়গুড়িপালের বেদাকোলায়।  নিজস্ব চিত্র

পালন: টুসু ভাসানের আগে চলছে নাচ-গান। গুড়গুড়িপালের বেদাকোলায়। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২০ ০১:০১
Share: Save:

মকর পরবের গুরুত্ব বোঝা যায় এক প্রবাদ থেকে। সুবর্ণরৈখিক ভাষায় প্রবাদটি হল, ‘আইলা মকর কড়কড়ি, খেলা মকর ঋণ করি’। মানে মকর তাড়াতাড়ি এল। কিন্তু গেল গৃহস্থের একগাদা ধার করিয়ে। পশ্চিম সীমানা বাংলার আদিবাসী, মূলবাসীদের শ্রেষ্ঠ উৎসব হল মকর সংক্রান্তি। একসময়ে বাসিন্দারা মকরের খরচ জোগাড় করতে পূর্বাঞ্চলে নামাল খাটতে যেতেন। মকরের আগে নিয়ে আসতেন ধান, চাল, টাকা। তা দিয়েই পালন করা হত মকর পরব, চাঁউড়ি, বাঁউড়ি, মকর। ডুমো পিঠা, মাড়া পিঠা, মাস পিঠা তৈরি হত। গ্রাম দেবতার পুজো, মেলায় খরচ করা হত। নতুন জামা কাপড় কেনা হত। আস্তে ফুরিয়ে যেতে টাকাপয়সা। তার পর ধার দেনা।

সময়ের সঙ্গে প্রাচীন অনেক উৎসবই ঔজ্জ্বল হারায়। মকর কি ধরে রেখেছে তার গৌরব? নতুন প্রজন্মের কাছে মকরের গুরুত্ব কেমন?

পূর্ব মেদিনীপুরের ঋত্তমকুমার পাণ্ডা পটাশপুর চন্দনপুর হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। তার কাছে মকর সংক্রান্তি বা পৌষপার্বণ আলাদা কিছু নয়। বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের পিঠে হয়। ঘরে ধান থাকে। তাই ‘বাইর পুজো’ হয়, এইটুকুই। তবে ঋত্তম জানিয়েছে, তাদের বাড়িতে এখনও ঢেঁকিতে চাল গুঁড়ো করা হয়। কাছাকাছি এক বাড়িতে ঢেঁকি আছে। সেখানেই অনেকে চাল গুঁড়িয়ে নিয়ে আসেন। পৌষপার্বণের জন্য আগ্রহ ভরে অপেক্ষার কোনও ব্যাপার তার মধ্যে নেই। বাড়ির কাছে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে মেলা বসে। মেলার প্রস্তুতি শুরু হলে ঋত্তম বুঝতে পারে, পিঠে খাওয়ার দিন আসছে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর শহরের ইন্দার বাসিন্দা সম্প্রীতি মিশ্র। খড়্গপুর কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। সম্প্রীতির মতে, পৌষপার্বণ বা মকর পরবের জৌলুস আগের থেকে কমেছে। বাড়ির লোকের থেকে পুরনো দিনের কথা শুনে বা নিজে ছোটবেলায় যা দেখেছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর এই ধারণা। শুনেছেন, তাঁদের বাড়িতে আগে ঢেঁকি ছিল। তাতেই চাল গুঁড়ো করা হত। কিন্তু আশপাশের বাড়িতে পার্বণ পালনের সেই আগ্রহ এখন আর নেই বলেই মনে হয় তাঁর। তাঁদের বাড়িতেও ঢেঁকি আর নেই। দোকান থেকে চালের গুঁড়ি কেনা হয়। নিজেদের বাড়িতে মকর সংক্রান্তি, পিঠেপুলির রেওয়াজটা এখন ধরে রেখেছেন সম্প্রীতিরা। এর কারণ দু’টো। বাড়িতে মন্দির আছে। তাই রীতি পালন করতেই হয়। এখনও মন্দিরে মকর হয়। পাড়ার লোকেরা বিভিন্ন ধরনের আনাজ, গুড়, ইত্যাদি নিয়ে মন্দিরে আসেন। তা দিয়ে মকর তৈরি হয়। আর সম্প্রীতির ঠাকুমা তৈরি করেন চালের পিঠে, ভাপা পিঠে। তাঁদের বাড়িতে গোটা শীতকাল জুড়েই তৈরি হয় নানা পিঠে। আর তা উৎসর্গ করা হয় মন্দিরের দেবীকে।

কিন্তু আশপাশের এলাকায় কেন পিঠেপুলির রেওয়াজ কমতে শুরু করল? তার একটা ব্যাখ্যা নিজের মতো করে দেওয়ার চেষ্টা করলেন সম্প্রীতি। তাঁর মতে, ‘‘এখন কেউ এত ঝামেলা করতে চান না। চাল গুঁড়ো থেকে পিঠে তৈরি পর্যন্ত অনেকটা সময় লাগে। এতে আমার থেকেও যারা ছোট তারা কিন্তু অসাধারণ এক পারিবারিক চিত্র থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উনুনের ধারে বসে গরম গরম পিঠে খাওয়া একটা পারিবারিক বন্ধন। তা পাচ্ছে না এখনকার বাচ্চারা। গ্রাম্য স্বাদটাই এখন নেই।’’ সম্প্রীতি সকালে হোয়াটসঅ্যাপে ‘হ্যাপি মকর সংক্রান্তি বার্তা’ পেয়েছেন। কিন্তু সেই বার্তায় যে আন্তরিকতার স্পর্শ নেই, তা বেশ বুঝতে পারেন তিনি।

ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবায় বাড়ি শিলা দাসের। ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিনি তিন জায়গার মকর পরবের তুলনামূলক একটা ছবি তুলে ধরলেন। শিলাদের আদিবাড়ি লালগড়ের বেলাটিকরিতে। খুব ছোটবেলায় দেখা মকর পরবের কিছু স্মৃতি তাঁর মনে আছে। দেখেছেন, গ্রামের বাড়িতে মকর পরবের অনুষ্ঠান হত। শিলার মাসির বাড়ি ঝাড়খণ্ডের চাকুলিয়ায়। সেখানে মকর পরব এখনও উৎসবের আকার নেয়। টুসু গান হয়। কিন্তু শহরের বাড়িতে তিনি, তাঁর দিদি বা দাদা-ভাইয়েরা তেমন আচার পালন করেন না। তবে বাবা-কাকা এখনও কিছু আচার ধরে দেখেছেন। যেমন মকর সংক্রান্তির দিনে ভোরবেলা উঠে তাঁরা সাইকেল নিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে লালগড়ের বৈতায় চলে যান। কংসাবতী নদীতে স্নান করে বাড়ি ফেরেন। তার পর পিঠে খাওয়া হয়। এলাকায় মুরগি লড়াই চলে। দেখতে যান কাকা, দাদা, ভাইয়েরা। লড়াই করা মুরগির মাংস রেঁধে চালের রুটি দিয়ে খাওয়া হয়। শিলা জানালেন, তাঁরা পিঠে, মাংস খান। কিন্তু আচারের সঙ্গে তাঁদের যোগ নেই।

ঝাড়গ্রাম শহরটিকে বদল যেতে দেখেছেন শিলা। তাঁর ছোটবেলায় ফাঁকা এলাকা ছিল। শালগাছে ভরা। মোরাম রাস্তা। এক দু’টো বাড়ি। মাটির বাড়িও ছিল। এখন পাকা রাস্তা হয়েছে। বাড়ি দোতলার কমে নেই। কাছাকাছি দু’একটা বাড়িতে নানা আচার পালন করতে দেখেন। কিন্তু বেশির ভাগ বাড়িতেই কিছু হয় না। শিলাদের বাড়ির পিঠের চালের গুঁড়ি আসে মাসির বাড়ি থেকে। মাসির বাড়িতে ঢেঁকি আছে। তাঁর দাবি, ‘‘খাওয়া ছাড়া মকর পরবের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের কোনও যোগ আছে বলে মনে হয় না।’’

পশ্চিম মেদিনীপুরের গুড়গুড়িপালের স্বরূপ সেন জানালেন, তাঁদের বাড়িতে পৌষপার্বণে পিঠে হয়। সেই দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে মকর পরবে স্নান করেছিলেন। এখন সেটুকুও করেন না। কেডি কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রটি বললেন, ‘‘মকর পরব উপলক্ষে আশেপাশে মেলা হয়। টুসুর গান হয়। কনকাবতীতে সীতা মেলা। আমাদের বাড়িতে পিঠে হয়। পড়শিদের সঙ্গে পিঠের আদানপ্রদান হয়। এইটুকুই। পার্বণের সঙ্গে আমার আর তেমন যোগ নেই।’’ স্বরূপ জানালেন, তাঁর এক বন্ধু থাকেন ঝাড়গ্রামের বেলপাহাড়িতে। মঙ্গলবার রাতে ভিডিয়ো কল করেছিলেন সেই বন্ধু। সেখানে মকর পরবে দারুণ হইচই। আলো জ্বেলে টুসু গান হচ্ছে। আনন্দ করছেন এলাকার লোক।

মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা সূতশ্রী পারিয়া। বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রী। পরিষ্কার জানালেন, তাঁদের বাড়িতে পার্বণ সংক্রান্ত কোনও আচার পালন করা হয় না। মা আগে কংসাবতীতে স্নান করতে যেতেন। এখন আর যান না। পিঠে খেতেও পছন্দ করেন না সূতশ্রী। কিন্তু মা, জেঠিমারা তৈরি করেন। না খেলে কেমন লাগে। তাই খান। তবে তাঁর বোন পিঠে খেতে পছন্দ করে। পড়শিদের পিঠে হয়, আদানপ্রদান চলে। সূতশ্রীর কাছে এর বাইরে পার্বণের কোনও প্রভাব নেই।

নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ কমছে। অভিজ্ঞরা বলছেন, মকর সংক্রান্তির রমরমাও কমেছে। অথচ ঝাড়গ্রামে বুধবার কিন্তু পুরো ছুটির আমেজ। দোকানপাট বন্ধ, এমনকি পেট্রোল পাম্পও। অভিজ্ঞরা বলছেন, মকর পালন করছেন বয়স্করাই। তাঁদের জন্যই ছুটির আমেজ। নতুনেরা শুধু হোয়াটসঅ্যাপে ‘হ্যাপি মকর সংক্রান্তি’র বার্তা আদানপ্রদান করছেন। আর ছুটিতে মজা করছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Makar Sankranti
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE