Advertisement
E-Paper

জেল ফেরত নজরুলকে প্রথম স্বাগত জানায় মেদিনীপুর

কবিতা লিখে ব্রিটিশদের রোষে পড়ে জেলে গিয়েছিলেন। মুক্তি পাওয়ার পরে তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় আদর্শ। মেদিনীপুরবাসী তাঁকে সম্বর্ধনা দেয়। তাঁর মেদিনীপুর আসার ইতিহাস লিখলেন অশোক পালসেদিনের সেই গায়ক যুবক কাজী নজরুল ইসলাম। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, মেদিনীপুর শাখার আমন্ত্রণে সম্বর্ধনা নিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি শহরে এসেছিলেন।

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৩৬
মেদিনীপুর শহরে নজরুলের মূর্তি। নিজস্ব চিত্র

মেদিনীপুর শহরে নজরুলের মূর্তি। নিজস্ব চিত্র

মেদিনীপুর কলেজে ১৯২৪ সালে একটি সভা হয়েছিল। সভার তারিখ ২৫ ফেব্রুয়ারি। সভাটি ছিল এক তরুণ কবিকে সম্ববর্ধনা জ্ঞাপনের। দুপুরবেলায় আয়োজিত সেই সভার অন্য একটি বৈশিষ্ট্যও ছিল। শহরের বিভিন্ন বয়সি মেয়েরা সেই সম্বর্ধনা সভার আয়োজক ছিলেন। তরুণ কবি সেই সভায় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। বছর পঁচিশের যুবকটি উদাত্ত কণ্ঠে শুনিয়েছিলেন স্বরচিত গান, কবিতা। শ্রোতারা বিস্ময় মুগ্ধ। তাঁদের শিরায় যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। শাসক ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে ফেটে পড়ার ইচ্ছেয় শুনে চলেছিলেন বাবরি চুল দুলিয়ে কবির ওজস্বী কণ্ঠের আহ্বান, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ওই নূতনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়’।

সেদিনের সেই গায়ক যুবক কাজী নজরুল ইসলাম। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, মেদিনীপুর শাখার আমন্ত্রণে সম্বর্ধনা নিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি শহরে এসেছিলেন। পরিষদের সভায় তরুণ কবিকে সম্বর্ধনা জানানো হয়। শহর জুড়ে কবিকে ঘিরে প্রবল উন্মাদনা। সকলেই শুনতে চান এরকমই গান কবিতা। পরিষদের একাদশ বার্ষিক অধিবেশনে তাঁকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের বিষয়টি সংস্থার কর্মকর্তা খ্যাতনামা উকিলবাবুদের মাথায় এসেছিল কেন?

এর একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। সেই সময়ে ব্রিটিশ বিরোধিতা প্রবল আকার নিয়েছে। একদিকে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জ্বালাময়ী ইংরেজ বিরোধী বক্তৃতা অন্যদিকে নজরুলের উত্তেজনাপূর্ণ গান কবিতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এর মধ্যেই গ্রেফতার হয়ে গেলেন নজরুল। গ্রেফতারের কারণ তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার ১২ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা। ব্রিটিশ বিরোধিতার অভিযোগে সংখ্যাটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। তল্লাশি চলে পত্রিকা দফতরে। ১৯২২ সালের ৮ নভেম্বর কবির নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। তিনি চলে যান কুমিল্লায়। সেখানেই গ্রেফতার। বিচারাধীন বন্দি হিসাবে কবিকে রাখা হয় প্রেসিডেন্সি জেলে। পরের বছর ১৬ জানুয়ারি বিচারক এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। ১৭ জানুয়ারি কবিকে আনা হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে।

নজরুলের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ১৯২২ সালে ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের পর ২২০০ কপি নিঃশেষ হয়ে যায় এক বছরে। যা বাংলা কবিতার জগতে অনন্য নজির। রবীন্দ্রনাথ তরুণ কবির প্রতিভাকে স্বীকৃতি জানালেন। ‘বসন্ত’ নাটিকা নজরুলকে উৎসর্গ করলেন। জেলখানায় বসে কবির নিজের হাতের লেখা-সহ ‘বসন্ত’ উপহার পেয়ে নজরুল আনন্দে আত্মহারা। ১৪ এপ্রিল নজরুলকে আনা হয় হুগলি জেলে। রাজবন্দিদের প্রতি জেল অধ্যক্ষের অমার্জিত আচরণের প্রতিবাদে যুবক কবি শুরু করলেন অনশন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ-সহ তৎকালীন সময়ের প্রায় সকল খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের অনুরোধ সত্ত্বেও কারা কর্তৃপক্ষ সমস্যা সমাধানে আগ্রহ দেখাননি। অনশনের ৪০ দিনে রবীন্দ্রনাথের হস্তক্ষেপে জেল কর্তৃপক্ষ রাজবন্দিদের দাবি মেনে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। নজরুল অনশন ভাঙেন মাতৃসমা বিরজাসুন্দরীর হাতে লেবুজল খেয়ে। ১৮ জুন কবিকে আনা হয় বহরমপুর জেলে। তিনি মুক্তি পান ১৫ ডিসেম্বর। বন্ধুবান্ধবেরা ঠিক করেছিলেন, কাজীকে সম্বর্ধনা দেবেন। কিন্তু কবি বহরমপুর গোরাবাজারে নলিনাক্ষ সান্যালের বাসায় কয়েকদিন কাটিয়ে কাউকে না জানিয়ে চলে গেলেন কুমিল্লায়। বন্ধুরা হতাশ। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নজরুলকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিল। কারাদণ্ডে তিনি আরও আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলেন। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক আসতে লাগল তাঁর। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, মেদিনীপুর শাখা তাদের একাদশতম বার্ষিক অধিবেশনে জনপ্রিয় কবিকে সম্বর্ধনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

সে বছর অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে এসেছিলেন ঐতিহাসিক ও ভারততত্ত্ববিদ নরেন্দ্রনাথ লাহা। এসেছিলেন ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নরেন্দ্র দেব ও শৈলেন্দ্রনাথ বিশী। নজরুলের প্রাণের বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ও উপস্থিত। স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রগণ্য জেলা মেদিনীপুরের আহ্বানে সাগ্রহে সাড়া দিয়েছিলেন তিনি। নজরুল এই শহরে এসেছিলেন ২৩ ফেব্রুয়ারি। ফিরে গেছেন ২৬ তারিখে। কবিবন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘মেদিনীপুরেই প্রথম কাজীকে বিপুলভাবে সম্বর্ধিত করা হয়। তারপর বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা, মহকুমা পল্লী তাঁকে অভিনন্দিত করে।’’

সাহিত্য পরিষদের অনুষ্ঠান ছাড়াও কবিকে যোগ দিতে হয় কয়েকটি সভায়। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৪টায় মেদিনীপুর কলেজে শুধুমাত্র মহিলারা কবিকে প্রকাশ্যে সম্বর্ধনা জানান। এক যুবককে প্রকাশ্যে সম্বর্ধনা জ্ঞাপনের মহিলাদের! মেদিনীপুর শহরের মহিলাদের এইরকম সভা সম্ভবত সেই প্রথম। সেদিন সন্ধ্যায় হার্ডিঞ্জ স্কুল (বর্তমান বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ) প্রাঙ্গণের সভায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দনের উত্তরে তিনি শুনিয়েছিলেন নিজের গান। চতুর্থদিন, ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫টায় শহরের নওরংপুর ডাঙার অর্ধসমাপ্ত ইদগায় সম্বর্ধনা দেওয়া হয় কবিকে। বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী, বাসিন্দাদের আমন্ত্রণে তাঁদের বাড়িতেও যেতে হয়েছে কাজীকে। মাত্র ৪ দিনেই নজরুল হয়ে উঠেছিলেন মেদিনীপুরের আত্মজন।

মেদিনীপুরবাসীর ভালবাসা, তাঁদের জাতীয়তাবাদী চেতনা নজরুলের মনকে কতখানি ছুঁয়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ আছে পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙার গান’-এর উৎসর্গ পত্রে। কাব্যটি তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘মেদিনীপুরবাসীর উদ্দেশ্যে’। এই সম্মান ব্রিটিশ রাজশক্তিকে দেশ থেকে উৎখাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মেদিনীপুরের যুবক-কিশোরদের মনে জন্ম দেয় স্বতন্ত্র অনুভূতি। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে আসে নতুন মাত্রা। ব্রিটিশ সরকার ‘ভাঙার গান’ বাজেয়াপ্ত করে।

১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন নজরুল। কবি পরিবার পড়েন আর্থিক অনটনে। আবার পাশে দাঁড়ায় মেদিনীপুর। মেদিনীপুর কলেজের ছাত্র সংসদের অধীন ‘রবীন্দ্র শরৎ বঙ্কিম পরিষদ’-এর উদ্যোগে ২৪ অগস্ট ১৯৪৮ সালে ডায়মন্ড গ্রাউন্ডে (এখন অরবিন্দ স্টেডিয়াম) প্রদর্শনী ফুটবল খেলার আয়োজন করা হয়। খেলায় অংশ নিয়েছিল মেদিনীপুর কলেজ একাদশ বনাম কাঁথি কলেজ একাদশ। চ্যারিটি ম্যাচের টিকিট বিক্রি ও ডোনেশান কার্ড থেকে পাওয়া ৩২৮.৬২ টাকা আজহারউদ্দীন খান ও আর একজন ছাত্র কবিপত্নীর হাতে দিয়ে আসেন ২৮ অগস্ট। সেদিনের সেই ছাত্র আজহারউদ্দীন খানই পরে লেখেন ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’ নামে এক প্রামাণ্য গ্রন্থ।

এর পরেও আরেকবার মেদিনীপুর শহরে এসেছিলেন নজরুল। ১৯২৯ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি। মেদিনীপুর শহরে শিল্প প্রদর্শনী হচ্ছিল। দেবেন্দ্রলাল খানের উদ্যোগে তাঁর কাছারি বাড়িতে হয় প্রদর্শনী। কবি সন্ধ্যায় কাছারি বাড়ির ছাদে কয়েকটি গজল শুনিয়েছিলেন।

কিন্তু প্রথম মেদিনীপুর সফরের সঙ্গে একটি দুঃখজনক ঘটনার যোগ রয়েছে। মেয়েরা যে সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলেন তার শেষে এক শিক্ষক কন্যা তরুণী কমলা দাস গান শুনে নিজের গলার হারটি পরিয়ে দেন কবিকণ্ঠে। একান্তই ভক্তি এবং আবেগ থেকে কাজটি করেছিলেন কমলা। কিন্তু সামাজিক গঞ্জনা থেকে বাঁচতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত কমলা আত্মহত্যা করেন।

লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

Kazi Nazrul Islam Midnapore Jail
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy