E-Paper

নামভূমিকায়: অতিশী মারলেনা

দিল্লির সরকারি স্কুলের হাল ফিরিয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক সমীকরণের ঠিক দিকে থাকতে সিদ্ধহস্ত। এখন ‘ভরতের মতো’ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর পদ সামলাচ্ছেন অতিশী।

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৪:২৯
অতিশী মারলেনা।

অতিশী মারলেনা।

রোজ সাফ হচ্ছে স্কুলের শৌচাগার? ফিনাইল, ঝাঁটা থাকছে তো? না কি শৌচাগারের গন্ধ গোটা স্কুল জুড়ে পাওয়া যাচ্ছে? ২০১৫ সালে দিল্লির শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসৌদিয়ার উপদেষ্টা হিসাবে কাজে যোগ দেওয়ার পরেই অতিশী প্রথম এ বিষয়ে নজর দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, স্কুলের শৌচাগার নোংরা থাকলে ছাত্রীরা নিয়মিত স্কুলে আসতে চায় না। তাই প্রতি সপ্তাহে স্কুলের ইনস্পেক্টরদের শৌচাগারে নজরদারি করতে হবে।

ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে আসা শুরু করল। কিন্তু অতিশী সমীক্ষা চালিয়ে দেখলেন, সরকারি স্কুলের ছেলেমেয়েরা ঠিকমতো লেখাপড়া শিখছে না। তাই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে পাশের হার কম। শুরু হল ‘মিশন চুনৌতি’, ‘মিশন বনিয়াদ’। তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানের দিকে নজর দেওয়ার কাজ শুরু হল। ফল মিলল হাতেনাতে। দিল্লির সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা বোর্ডের পরীক্ষায় তাক লাগিয়ে দিল। অতিশীর হাত ধরেই দিল্লির সরকারি স্কুলের ভোলবদলের সূচনা হল।

দিল্লির নতুন মুখ্যমন্ত্রী অতিশীর রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া মণীশ সিসৌদিয়ার সূত্রেই। ২০১০ সালে অতিশীর সঙ্গে সিসৌদিয়ার আলাপ। সিসৌদিয়া তখন বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের সঙ্গে অসরকারি সংস্থায় কাজ করছেন। আর অতিশী ও তাঁর হবু স্বামী— আইআইটি-দিল্লি ও আইআইএম-আমদাবাদের প্রাক্তনী প্রবীণ সিংহ— নানা রকম সামাজিক কাজ করে বেড়াচ্ছেন। সিসৌদিয়াই অতিশীকে অণ্ণা হজারে, অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে নিয়ে আসেন।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক বিজয় কুমার সিংহ ও তৃপ্তি ওয়াহির কন্যা অতিশী স্প্রিংডেলস স্কুলে পড়াশোনার পরে সেন্ট স্টিফেন’স কলেজে গিয়ে যে ইতিহাস নিয়েই পড়াশোনা করবেন, তার পরে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ডে যাবেন, তাতে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। বাড়তি যেটা ছিল, তা হল, অতিশী অক্সফোর্ড থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করার পরে ফের শিক্ষাসংক্রান্ত গবেষণা নিয়ে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন— সেটাও রোডস স্কলারশিপ নিয়ে। ইতিহাস নয়, সেই পড়াশোনাই অতিশীকে ভবিষ্যতে এগিয়ে দিয়েছে।

বিজয় ও তৃপ্তি দুই মেয়ের নাম রেখেছিলেন রোজ়া বাসন্তী ও অতিশী মারলেনা। রোজ়া লুক্সেমবার্গের অনুপ্রেরণায় বড় মেয়ের নাম রোজ়া রাখা হয়েছিল। মার্ক্স-লেনিনের অনুপ্রেরণায় অতিশীর সঙ্গে জুড়েছিল মারলেনা। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি যখন পূর্ব দিল্লি থেকে অধুনা ভারতীয় ক্রিকেট দলের কোচ গৌতম গম্ভীরের বিরুদ্ধে অতিশীকে প্রার্থী করল, তার আগেই বিজেপির প্রশ্নের মুখে নিজের নাম থেকে মারলেনা ছেঁটে ফেলেছিলেন অতিশী। তিনি কমিউনিস্ট বা খ্রিস্টান, এমন কোনও অপপ্রচারের সুযোগ অতিশী বিজেপিকে দিতে চাননি। বলেছিলেন, মারলেনা মোটেই তাঁর পদবি নয়। ওটা বাবা-মায়ের দেওয়া দ্বিতীয় নাম। তাঁর আসল নাম অতিশী সিংহ। তবে এখন শুধু অতিশী হিসাবেই পরিচিত হতে চান। দক্ষিণ দিল্লির কালকাজি এলাকায় অবশ্য সরকারি বোর্ডে স্থানীয় বিধায়কের নাম অতিশী সিংহ হিসাবেই লেখা।

রাজনীতির স্বার্থে অনেক কিছুই ছেঁটে ফেলতে হয়— বদলাতে হয় সখ্য, আনুগত্য। আম আদমি পার্টির আদিপর্বে প্রশান্ত ভূষণ, যোগেন্দ্র যাদবদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন অতিশী। তাঁদের সঙ্গে কেজরীওয়ালের বিরোধ বাধায় দু’জনকেই দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। প্রশ্ন উঠেছিল, অতিশী এ বার কোন দিকে যাবেন? অতিশী কেজরীওয়ালের শিবিরে নাম লেখাতে দেরি করেননি। প্রশান্ত ভূষণ, যোগেন্দ্র যাদবদের প্রকাশ্যে চিঠি লিখে সমালোচনা করেছিলেন।

মাত্র চার বছর আগে অতিশী প্রথম বার বিধায়ক হয়েছিলেন। গত বছর প্রথম মন্ত্রী হন। মণীশ সিসৌদিয়া, সত্যেন্দ্র জৈনদের গ্রেফতারির জেরে অতিশী একাই চোদ্দোটি দফতর সামলেছেন। অরবিন্দ কেজরীওয়াল ভোটের আগে ইস্তফা দিলে তাঁকে যে মুখ্যমন্ত্রী করা হতে পারে, তার ইঙ্গিত মিলেছিল স্বাধীনতা দিবসের আগে। কেজরীওয়াল তিহাড় জেলে বসে অতিশীকে ১৫ অগস্টের দিল্লি সরকারের অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য মনোনীত করেছিলেন।

মার্ক্স-লেনিনের ভক্ত, আফজ়ল গুরুর ফাঁসির বিরুদ্ধে আবেদন জানানো অধ্যাপক বিজয়-তৃপ্তির মেয়েকে শাহিন বাগে সিএএ-এনআরসি’বিরোধী মহিলাদের আন্দোলনের পাশে দেখা যায়নি। সেই সিএএ-বিরোধী আন্দোলন থেকে তৈরি উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসার সময়ও তিনি কেজরীওয়াল-সিসৌদিয়ার মতোই হাত গুটিয়ে ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই অতিশী কনট প্লেসের প্রাচীন হনুমান মন্দিরে গিয়ে হনুমান চালিশা পাঠ করেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার সময় পাশে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের জন্য ফাঁকা গদি রেখে বলেন, তিনি রামায়ণের ভরতের মতো সিংহাসনে রামের খড়ম রেখে রাজ্য শাসন করবেন। কেজরীওয়ালের জেলে আটক থাকার সময়কে ‘রামের বনবাস’-এর সঙ্গে তুলনা করেন। দিল্লিতে ‘রাম রাজ্য’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। কেজরীওয়ালের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে চার মাস পরে দিল্লির নির্বাচনে জিতে ফের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার চ্যালেঞ্জকে অতিশী ‘সীতার অগ্নিপরীক্ষা’ তকমা দেন।

নতুন বছরের গোড়ায় দিল্লির ভোটে অতিশীকে সামনে রেখে আপ দিল্লির মধ্যবিত্ত, মহিলা, শিক্ষিত ভোটব্যাঙ্ককে পাখির চোখ করছে। কেজরীওয়ালকে গদিতে ফিরিয়ে আনতে সেই ভূমিকায় সফল হওয়াটাই এখন অতিশীর অগ্নিপরীক্ষা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Atishi Marlena Delhi CM Aam Admi Party

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy