আবার নূতন করিয়া ‘এক দেশ এক ভোট’ চাহিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চাহিবার যুক্তিটি ইতিমধ্যে বহুশ্রুত, এত বড় দেশে এত খরচ করিয়া বার বার ভোট কেন দরকার, তাহাতে আসলে মানুষের ক্ষতি হয়, ইত্যাদি। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ তাঁহার সংসদীয় ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে স্বীকৃতির ছাপ দিলেন, প্রত্যাশিত ভাবেই। এবং বিরোধী দলগুলি তাহাতে প্রতিবাদে সরব হইল, স্বাভাবিক ভাবেই। গত বৎসর হইতে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি একাধিক বার উত্থাপন করিয়াছেন, বহু ধরনের সমালোচনা ও প্রতিবাদ সত্ত্বেও তাহার পুনরুচ্চারণ করিয়া চলিয়াছেন। বিরোধীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ আগাইয়া আসিয়া দাবি করিয়াছেন যে, ইহা বিজেপি সরকারের ভাবনা নহে, ইহা আসলে ভারতীয় রাষ্ট্রের দাবি, রাষ্ট্রের প্রয়োজন। ‘এক দেশ এক ভোট’ আসলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমাইবে, রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে সাহায্য করিবে। রামনাথ কোবিন্দ, নরেন্দ্র মোদী কিংবা রাজনাথ সিংহ কেহই যে কথাটা পুরা বলিতেছেন না, তাহা হইল: এই সংস্কার সাধিত হইলে যে রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমিবে, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন সম্ভব হইবে— এমন কথা বিজেপি বলিতেছে, আর কেহ নহে। অর্থাৎ, দাবিটি নূতন না হইলেও উন্নয়নের যুক্তিটি মোদী সরকারের পছন্দের। তাই রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বলিয়া যে ভাবে বিষয়টিকে পেশ করা হইতেছে, তাহাতে কিছু অতিরঞ্জন আছে।
কোনও সন্দেহ নাই যে, ভারতের মতো একটি বড় দেশে নির্বাচন একটি ব্যয়সাপেক্ষ ঘটনা। প্রশ্ন হইল, এই ব্যয়ের উদ্দেশ্য কী, এবং তাহা কতটা গুরুতর। এই প্রশ্নটিই কংগ্রেস বা বাম দলগুলি উঠাইয়াছে, সঙ্গত ভাবেই। তাহারা যথার্থই বলিয়াছে, গণতন্ত্র নামক বস্তুটি রক্ষা করিতে হইলে এই ব্যয় স্বীকার করা ভিন্ন কোনও পথ খোলা নাই। অর্থাৎ ইহা জরুরি, আবশ্যিক ‘ব্যয়’। ল কমিশন যখন আশির দশকে এই বিষয়টি উঠাইয়াছিল, তাহার প্রেক্ষাপটটি ছিল ভিন্ন। উনিশশো ষাট ও সত্তরের দশকে একাধিক রাজ্যে দ্রুত কিছু সরকার পতনের ফলে বার বার ভোট করাইবার চাপ অনুভূত হওয়াই সেই প্রেক্ষাপট। পরিস্থিতি পাল্টাইয়াছে গত কয়েক দশকে। এখন রাজ্য ও জাতীয় নির্বাচন এক সময়ে একসঙ্গে করিবার তেমন কোনও প্রত্যক্ষ কারণ নাই।
পরবর্তী প্রশ্ন, গণতন্ত্রের স্বার্থে কি জাতীয় নির্বাচন ও রাজ্য স্তরের নির্বাচন আলাদা করা জরুরি? সব নির্বাচন একসঙ্গে করিলে কি গণতন্ত্রের মূল আদর্শটির ক্ষতি হইতে পারে? উত্তর: পারে। ভারত একটি বৃহৎ দেশ বলিয়াই তাহার বিবিধ অংশের বিবিধ বাস্তবের মধ্যে বৈচিত্র ও বৈষম্য অনেক, দেশ জুড়িয়া একটিমাত্র নির্বাচনের সুর বাজিলে সেই বিচিত্রতার সমূহ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। তামিলনাড়ু বা নাগাল্যান্ড বা হরিয়ানা যে ভাবে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, একই সময়ে একই প্রচারের পরিপ্রেক্ষিতে যদি তাহাদের নিজেদের বিধানসভার কথাও ভাবিতে হয়, তাহাতে প্রাদেশিক বাস্তবের বিবেচনাগুলি গৌণ হইয়া পড়িবার আশঙ্কা বিরাট। ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় ভাবটি রাখিবার কথা সংবিধানে বলা হইয়াছে। ‘এক ভোট’ সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় আদর্শের পায়ে কুড়ালের কোপ মারিবে। দেশের প্রথম দিকের নির্বাচনে যদি ‘এক ভোট’ হইয়া থাকে, তাহাকে সদ্যোজাত দেশের প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে দেখা কর্তব্য। একবিংশ শতকের ভারতে সেই পুরাতন ভাবনায় ফিরিয়া যাইবার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই। ফিরিয়া গেলে তাহাতে কেন্দ্রীয় দলগুলির, বিশেষত কেন্দ্র স্তরে আগাইয়া থাকা দলেরই সুবিধা। গোটা দেশ একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে কয়েক পা আগাইয়া যাইবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশের বিশেষ ক্ষতি হইবে। ফলে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক বিরোধীরা যদি সেই একদলীয় অতি-কেন্দ্রীকরণের আশঙ্কা করিয়া থাকেন, তাঁহাদের দোষ দেওয়া চলে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy