নোভেল করোনাভাইরাস নামক বিপদ কোথায় কত দূর প্রসারিত হইবে, কখন কী ভাবে তাহা নিয়ন্ত্রণে আসিবে, ভবিষ্যতে তাহার নূতন কোন মূর্তি দেখা যাইবে, সেই মূর্তি তুলনায় কম বিপজ্জনক হইবে না বেশি— এই সকল প্রশ্নের উত্তর আপাতত অজানা। অসার এবং অবান্তর জল্পনা সেই সদুত্তরের বিকল্প হইতে পারে না, বরং তাহা নানা দিক দিয়াই ক্ষতিকর। এই ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ এবং তাহার সহিত মানুষের তথা বৃহত্তর প্রাণিজগতের লড়াইয়ের ইতিহাস দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ। সেই ইতিহাসের ধারাতেই এ ক্ষেত্রেও সংক্রমণের প্রতিষেধক এবং ব্যাধির ঔষধ খুঁজিবার উদ্যোগ জোর কদমে চলিতেছে। তাহার সাফল্যের সম্ভাবনা কম নহে। কিন্তু ইতিহাসই বলিয়া দেয় যে, সেই সাফল্য মিলিবার পরেও নূতন বিপদের আশঙ্কা থাকিয়া যাইবে, কারণ ব্যাধির বীজ ক্রমাগত নিজের পরিবর্তন ঘটাইয়া চলে, সেই পরিবর্তনের মোকাবিলায় পুরানো ঔষধ অকেজো বা অপটু হইয়া পড়ে, নূতনতর ঔষধ আবিষ্কারের প্রয়োজন ঘটে। ইতিমধ্যে শতাধিক দেশে লক্ষাধিক মানুষের দেহে ভাইরাসের সন্ধান মিলিয়াছে, অন্তত চার হাজার প্রাণ গিয়াছে, অথচ সংক্রমণের প্রতিষেধক বা ঔষধ তৈয়ারি নাই। অর্থাৎ, আপাতত অসম লড়াই চলিতেছে। অস্ত্র বলিতে একটিই: সচেতন ও সতর্ক দায়িত্ববোধ।
দায়িত্ববোধ নিজের প্রতি এবং অন্যের প্রতি। সংক্রমণের সম্ভাবনা হইতে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখিবার পরামর্শ, জনসমাগম যথাসাধ্য এড়াইয়া চলিবার পরামর্শ, নিজের শরীর, বিশেষত হাত দুইটিকে যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখিবার পরামর্শ— সব কয়টিই প্রাথমিক ভাবে নিজের প্রতি দায়িত্ববোধ অনুশীলনের কথা বলে। কিন্তু এই প্রতিটি অভ্যাসই আবার অন্যের সংক্রমণের আশঙ্কাও কমাইয়া দেয়— নিজে জীবাণুমুক্ত থাকিলে লাভ নিজেরও, অপরেরও। আবার, নিজে সংক্রমিত হইলে বা তাহার কোনও লক্ষণ বুঝিলে অবিলম্বে নিজেকে অন্য সকলের সংস্পর্শ হইতে সরাইয়া লইবার নির্দেশটি সরাসরি সামাজিক দায়িত্বকেই চিহ্নিত করে। সংক্রমণের মোকাবিলায় ব্যক্তি-মানুষের নিকট সামাজিকতার এই দাবি মনে করাইয়া দেয় যে, বহু জনের সহিত জীবনযাপনকে ভাগ করিয়া লইতে হয় বলিয়াই সামাজিক মানুষের নিরাপত্তা পরস্পরের উপর বিশেষ ভাবে নির্ভর করে।
এই পারস্পরিকতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তাহার অগণিত নিদর্শন চতুর্দিকে ছড়াইয়া রহিয়াছে। বিশ্ব পরিবেশ দূষণের অতিকায় সঙ্কটের চেহারা এবং চরিত্র চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে যে, এই গ্রহের সমস্ত অধিবাসী একে অন্যের উপর কী অনুপাতে নির্ভরশীল। আধুনিক অর্থশাস্ত্র ব্যক্তিস্বার্থ-প্রধান, অনেকাংশেই ব্যক্তিস্বার্থ-সর্বস্ব। কিন্তু সেই শাস্ত্রও এই পারস্পরিকতাকে অস্বীকার করিতে পারে নাই, ‘এক্সটার্নালিটি’ বা অতিক্রিয়া-র ধারণাটি উদ্ভাবন করিয়াছে। মানুষ যাহা করে তাহার পরিণাম বিচারের জন্য ইহার বিবেচনা জরুরি। ব্যক্তিগত ভালমন্দ, প্রাতিষ্ঠানিক লাভক্ষতি, আঞ্চলিক বা জাতীয় স্বার্থ— যে কোনও স্তরের সীমাবদ্ধ হিসাবনিকাশের বাহিরে বৃহত্তর পরিসরে সেই পরিণাম প্রসারিত হয়। বস্তুত, ইহা নিছক অতিক্রিয়া নহে, এই পারস্পরিকতায় নিহিত রহিয়াছে এক গভীরতর জীবনদর্শনের সূত্র— অপরকে আপনার সহিত এবং আপনাকে অপরের সহিত সম্পৃক্ত করিয়া দেখিবার সূত্র। বিশ্ব-উষ্ণায়নের মতোই, সংক্রামক ব্যাধির আক্রমণও জানাইয়া দেয়, ইহা কেবল তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নহে, জীবনমরণের কঠোর বাস্তবও বটে। অতি বড় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ও এই সত্যকে অস্বীকার করিতে পারে না। নোভেল করোনাভাইরাস সেই বাস্তবকেই আরও এক বার প্রকট করিয়া তুলিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কথা অনুসরণ করিয়া বলা চলে, ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় যেন এক বিন্দু আপস না করা হয়।