Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বৃদ্ধির হার নিয়ে তর্কটা আদৌ রাজনৈতিক হওয়ার কথা নয়

অস্বচ্ছতা থেকে গেল কেন

যা ছিল অর্থনীতির নীরস কচকচি, হঠাৎই সেই জাতীয় আয়ের হিসেব হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক তরজার বিষয়।

পিনাকী চক্রবর্তী ও লেখা চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

যা ছিল অর্থনীতির নীরস কচকচি, হঠাৎই সেই জাতীয় আয়ের হিসেব হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক তরজার বিষয়।

জিডিপি পরিসংখ্যানের নতুন সিরিজ় প্রকাশিত হওয়া ইস্তক প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করেছে হিসেবের পদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। কী অসীম দুর্ভাগ্য। স্বাধীনতার পর থেকে বহু যত্নে যে পরিসংখ্যান ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, পদ্ধতির অস্বচ্ছতায় তার বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট হয়ে গেল। কী ভাবে জিডিপি-র সংখ্যাগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তা নিয়ে অস্বচ্ছতাই এই অবিশ্বাস তৈরি করল। প্রবাদপ্রতিম সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের নেতৃত্বে সেন্ট্রাল স্ট্যাটিস্টিকাল অফিস (সিএসও) গড়ে ওঠার পর সম্ভবত এই প্রথম বার ভারতীয় পরিসংখ্যান নিয়ে এতখানি অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে।

এ বছরের গোড়ার দিকে সিএসও যে ব্যাক সিরিজ় পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা গেল, ইউপিএ-র আমলে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার বর্তমান সরকারের আমলে আয়বৃদ্ধির হারের

চেয়ে বেশি। পরিসংখ্যান প্রকাশিত অল্প দিনের মধ্যেই সিএসও-র ওয়েবসাইট থেকে সেটা সরিয়ে ফেলা হল। তার পর প্রকাশিত হল নতুন ব্যাক সিরিজ় পরিসংখ্যান। এ বার তা তৈরির দায়িত্বে ছিল নীতি আয়োগ।

আগের ব্যাক সিরিজ় পরিসংখ্যান ফেলে দিতে হল কেন, রাশিবিজ্ঞানের ভাষায় তার কোনও পরিষ্কার যুক্তি পাওয়া যায়নি। এ বছর নভেম্বরে যে সংশোধিত ব্যাক সিরিজ় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক কালে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১০-১১ অর্থবর্ষে— ৮.৫ শতাংশ। আগের ব্যাক সিরিজ়েও সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির হার ছিল ২০১০-১১ সালেই, কিন্তু সেই হার ছিল অনেক বেশি। ১০.৩ শতাংশ। বৃদ্ধির হার হঠাৎ এতখানি কমে গেল কী করে, স্বভাবতই তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, বিতর্ক হয়েছে। এবং, তার ফলেই প্রশ্ন উঠেছে সিএসও-র গণনাপদ্ধতির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই। দাবি উঠেছে, সিএসও-র এই নতুন পরিসংখ্যানকে ফের খুঁটিয়ে দেখা হোক, পরিসংখ্যানগুলি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য কি না, যাচাই করা হোক।

এত দিন অবধি জাতীয় আয়ের হিসেব কষা হত রাষ্ট্রপুঞ্জের সিস্টেমস অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস (এসএনএ)-এর ১৯৯৪ সালের নিয়মবিধি মেনে। এ বারের সিরিজ় তৈরি হয়েছে এসএনএ-র ২০০৮ সালের নিয়মবিধি অনুসারে। দুটো ব্যবস্থার মধ্যে ফারাক হল, ২০০৮ সালের নিয়মবিধিতে অর্থনৈতিক উৎপাদনের গণ্ডি বাড়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ আগে জাতীয় আয়ের হিসেবের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, এমন বেশ কিছু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এই নতুন সিরিজ়ে ঢুকেছে। তার জন্য গণনার পদ্ধতিও পাল্টেছে, ডেটাবেস বা তথ্যভাণ্ডারও পরিবর্তিত হয়েছে। পাশাপাশি পাল্টেছে গণনার ‘বেস-ইয়ার’, অর্থাৎ যে বছরের আয়ের স্তরকে ধরে পরের বছরগুলোর বৃদ্ধির হার কষা হয়। এখন জাতীয় আয় হিসেব করার ‘বেস-ইয়ার’ ২০১১-১২ অর্থবর্ষ।

আমরা প্রথমে দেখব, ডেটাবেসে ঠিক কী পরিবর্তন হল। তার পর দেখব, হিসেবের পদ্ধতি কী ভাবে পাল্টাল। দুটো নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। জিডিপি সিরিজ় হিসেব করার জন্য যে ডেটাবেস ব্যবহৃত হয়, তাতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে নির্মাণ ক্ষেত্রের হিসেবে। আগে নিয়ম ছিল, অ্যানুয়াল সার্ভে অব ইন্ডাস্ট্রিজ় (এএসআই)-এর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে নির্মাণ ক্ষেত্রের গ্রস ভ্যালু অ্যডেড বা মোট সংযোজিত মূল্যের হিসেব কষা হবে। এই নতুন জিডিপি সিরিজ়ের ক্ষেত্রে তার পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে ‘কর্পোরেট ফাইনান্সিয়াল ডেটা’।

জিডিপি অ্যাট কারেন্ট প্রাইসেস বা বর্তমান মূল্যস্তরের নিরিখে জাতীয় আয়ের নতুন হিসেবে নির্মাণশিল্পের বৃদ্ধির হার আগের সিরিজ়ের তুলনায় অনেকখানি বেড়েছে (প্রায় দুই শতাংশ-বিন্দু)। তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের— নির্মাণক্ষেত্রের— বৃদ্ধির হার সিএসও-রই দুটো হিসেবে এতখানি আলাদা হল কী করে।

নির্মাণক্ষেত্রের মোট সংযোজিত মূল্যের হিসেব কষতে কোন ডেটাবেস ভাল— কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের, না কি এএসআই-এর— তার কোনও নির্দিষ্ট উত্তর নেই। সিএসও জানিয়েছে, তারা কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের পরিসংখ্যান ব্যবহার করেছে, কারণ তাতে “কারখানার চত্বরের বাইরে, কিন্তু সংস্থার ভিতরে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে”, তার ছবিটা অপেক্ষাকৃত ভাল ধরা পড়ে।

আসল প্রশ্ন হল, নির্মাণক্ষেত্রের মোট সংযোজিত মূল্য মাপার জন্য কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের যে পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়েছে, তা ২০১১-১২ অর্থবর্ষের আগের কোনও বছরের জন্য পাওয়া যায় না। ব্যাক সিরিজ় হিসেব করার ক্ষেত্রে এটা একটা অলঙ্ঘ্য বাধা, কারণ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রক আর এএসআই-এর পরিসংখ্যান তুলনীয় নয়। প্রথমটির ক্ষেত্রে পাঁচ লক্ষ সংস্থার পরিসংখ্যান রয়েছে, সেখানে এএসআই-এর পরিসংখ্যান তৈরি হয়েছে মাত্র কয়েক হাজার সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে।

যে সংস্থাগুলি কর্পোরেটেড নয়, সেগুলির ক্ষেত্রে ২০১১-১২ সালের আগেকার বছরগুলোর জিডিপি-র হিসেব কষা হবে কী ভাবে, সেটা ছিল মস্ত একটা সমস্যা। কিন্তু, সিএসও সেই সমস্যার কোনও সন্তোষজনক সমাধান করতে পারেনি। কী ভাবে নির্মাণক্ষেত্রের গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড-এর হিসেব কষা হল, সেই পদ্ধতি স্পষ্ট ভাবে জানা যায়নি। সেখান থেকেই ধোঁয়াশার সৃষ্টি। কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের পরিসংখ্যান থেকে যে বছরগুলোর হিসেব পাওয়া যাচ্ছে, স্বভাবতই তাতে নির্মাণশিল্পের বৃদ্ধির হার বেশি, কারণ তার মধ্যে কারখানার চত্বরের বাইরের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের হিসেবও ঢুকে পড়েছে। এএসআই-এর পরিসংখ্যান তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে না স্বাভাবিক ভাবেই।

যে পরিসংখ্যানের মধ্যে চরিত্রগত মিল নেই, তাকে জিডিপি-র সিরিজ়ে মেলানো হচ্ছে কোন মন্ত্রে, সেটা বড় প্রশ্ন। আরও বড় প্রশ্ন হল, নতুন সিরিজ়ে যে বৃদ্ধির হার পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর সাযুজ্য নেই কেন? মোট স্থাবর মূলধন নির্মাণ, বিনিয়োগ, খাদ্য ব্যতীত অন্য ক্ষেত্রে ঋণ ইত্যাদি কোনও সূচকের বৃদ্ধির হারই জিডিপি-র বৃদ্ধির সঙ্গ তুলনীয় নয়। প্রশ্ন উঠছে, ঋণ থেকে বিনিয়োগ, সঞ্চয়, সব কিছুর বৃদ্ধির হারই যদি নিম্নমুখী হয়, জিডিপি-র বৃদ্ধির হার এত বেশি হয় কী করে?

প্রশ্ন উঠছে মেথডলজি বা গণনাপদ্ধতি নিয়েও। এই লেখায় সেই পদ্ধতির ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে বিশদে যাব না, তবে সিএসও-র নতুন সিরিজ় বলছে, ভারতে কখনও চড়া হারে আর্থিক বৃদ্ধি হয়নি। ২০০৫-০৬ থেকে ২০১১-১২ অবধি ভারতীয় অর্থনীতি বছরে গড়ে ছয় শতাংশের ধারেকাছে বৃদ্ধির হার বজায় রেখেছিল। নীতি আয়োগের তত্ত্বাবধানে যে নতুন সিরিজ় তৈরি হল, তাতে এই পরিসংখ্যানই দেখা যাচ্ছে।

দুটো কথা স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন। এক, যত ক্ষণ অবধি এএসআই আর কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের পরিসংখ্যানকে মেলানোর কোনও সর্বসম্মত উপায় পরিসংখ্যানবিদরা খুঁজে না পাচ্ছেন, তত ক্ষণ মেনে নিতে হবে যে ভারতের জিডিপি পরিসংখ্যানে ২০১১-১২ সালে একটা ‘স্ট্রাকচারাল ব্রেক’ আছে— আলোচনা করতে হবে সেই কথাটা মাথায় রেখেই। এবং, দ্বিতীয় কথা হল, বৃদ্ধির হারের এই হিসেবটা রাজনৈতিক তরজার বিষয় নয়। সমস্যা যেটা আছে, তা একান্তই ‘টেকনিকাল’। তার সমাধানসূত্র রাজনীতিকদের হাতে নেই, ওটা বিশেষজ্ঞদের কাজ।

সিএসও-কে রাজনৈতিক ঝগড়ার ময়দান থেকে যত দ্রুত সরিয়ে আনা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতা ফেরানো যায়, ততই মঙ্গল।

নয়াদিল্লির ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসি-তে অর্থনীতিবিদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Economy Finance Politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE