Advertisement
E-Paper

আগে সবই ভাল ছিল বুঝি?

অতীত নিয়ে মনপোড়ানি, ‘পুরানো সেই দিনে’ ফেরার আকুতি। দুনিয়া জু়ড়ে এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের যে বাড়বাড়ন্ত, তার অন্যতম চালিকাশক্তি নস্টালজিয়া।

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৮ ০০:২৫

নস্টালজিয়া শব্দটার যথাযথ বাংলা প্রতিশব্দ আছে? ‘অতীতচারিতা’ কিছুটা কাছাকাছি যায় হয়তো। অতীত নিয়ে মনপোড়ানি, ‘পুরানো সেই দিনে’ ফেরার আকুতি। দুনিয়া জু়ড়ে এখন উগ্র জাতীয়তাবাদের যে বাড়বাড়ন্ত, তার অন্যতম চালিকাশক্তি নস্টালজিয়া। যে অতীত নিয়ে মনপোড়ানি, তার নির্মাণ যে ইতিহাসের পোক্ত ভিতের ওপরই হতে হবে, সে রকম কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।

যেমন, উন্নত বিশ্বের অনেকেই মনে করছেন পঞ্চাশ বছর বা তারও আগের জীবনটা বেশ ছিল। অথচ জীবনযাত্রার মানের যে চালু সূচকগুলি রয়েছে, তার নিরিখে এই কথা বলা যায় না। এমনকি যদি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জীবন ঘিরে অনিশ্চয়তা, এ সবের নিরিখেও দেখি, কোনও ভাবেই বলা যায় না যে অতীতটা ভাল ছিল। অতীতে গড়পড়তা মানুষের জীবনে মন্দের অভাব ছিল না। উন্নয়নশীল বিশ্বে এটা আরওই সত্যি। বেশির ভাগ মানুষেরই জীবন ছিল রুক্ষ, কঠোর, অনিশ্চিত। গণতন্ত্রের ধারণাটিও তখন অর্বাচীন; সর্বজনীনতার রূপ পায়নি। ব্যক্তির জীবনযাত্রার মানের নিরিখে যে হেতু বলা যাচ্ছে না অতীতটা ভাল ছিল, তাই দেশ বা জাতি ঘিরে এক মহিমান্বিত অতীতের ছবি আঁকা হত, যে ছবির সঙ্গে এক রকম অলীক বিজয়গৌরব মিশিয়ে দেওয়া হয়।

ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে যাঁরা রায় দিয়েছিলেন, তাঁদের ভাবনাতেও ছিল এক বলীয়ান ব্রিটেনের ধারণা, যে ধারণা ভিক্টোরিয়ান বা এডওয়ার্ডীয় যুগে যতটা বাস্তবানুগ ছিল, এখন তেমন নয়। আর সেই তথাকথিত বলীয়ান ব্রিটেনেও সব শ্রেণির মানুষ যে সমান ভাল ছিলেন, তাও বলা যায় না। তবু সেই অলীক শ্রেষ্ঠত্বের কল্পনায় যুক্তরাজ্যবাসী মনে করলেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে সবার সঙ্গে চলতে গিয়ে তাঁদের আভিজাত্য খর্ব হচ্ছে। ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় পাওয়া যাচ্ছে ৫৯ শতাংশ ব্রিটিশ নাগরিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিয়ে গর্ববোধ করেন, আর এক-তৃতীয়াংশ মনে করেন সাম্রাজ্যটা থাকলে বেশ হত। অন্যত্রও মানুষ অতীত কল্পনায় বুঁদ হয়ে থাকতে চাইছেন। রাশিয়ার বহু মানুষ নাকি এখনও সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে পড়া নিয়ে শোকবিহ্বল। ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলে চলেছেন আমেরিকাকে আবার শ্রেষ্ঠ স্থানে নিয়ে যাবেন। এ বার সেই কল্পিত অতীতের কোন শতাব্দীতে কে বলীয়ান ছিল, তা ভেবে নিয়ে আজ যদি সবাই এক সঙ্গে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে চড়ে বসতে চায়, তা হলে তো ধুন্ধুমার কাণ্ড হবে!

একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। এক আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে এক আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বোঝাচ্ছিলেন, আমেরিকা তার বিশ্বনেতার ভূমিকা থেকে কী ভাবে অবনমিত হয়েছে এবং কী প্রকারে সেই গৌরবটি ফিরে পেতে পারে। দেখি, ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীরা উসখুস করছেন। শেষে এক জন আর থাকতে না পেরে যথাসম্ভব সরল মুখভঙ্গি করে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা, আমেরিকাকে নেতৃত্ব দিতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছেন? এ হেন আপত্তিতে বক্তা অবাক! জলের মতো স্বচ্ছ কথাটিও এই ভারতীয় বোঝেন না? সত্যি বলতে, এই মার্কিন পণ্ডিতটির মতো সরল জাতীয়তাবাদী সমাজবিজ্ঞানী বিরল, এমনকি আমেরিকাতেও। তিনি ছেলেবেলা থেকে এটাই জেনে এসেছেন যে আমেরিকাকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নেতৃত্ব দিতে হবে। হলিউডেও বিস্তর ছবি এমনই। এ নিয়ে যে প্রশ্ন উঠতে পারে, ভাবেননি তিনি। সুতরাং ট্রাম্প যে তাঁর দেশবাসীর অনেকের মনের কথাই বলছেন এমন মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। ব্রিটেনেও ব্রেক্সিট নিয়ে ভোটাভুটির আগে দেখা গেল সে দেশের সিনেমা, টেলিভিশন, বইপত্রে ব্রিটেনের তথাকথিত স্বর্ণযুগ নিয়ে, খাঁটি ইংরেজত্ব নিয়ে, নস্টালজিয়ার বাড়াবাড়ি।

মার্ক্সের পূর্ববর্তী সমাজতান্ত্রিক ভাবুকরা এক কল্পরাষ্ট্রের স্বপ্ন বুনতেন, যেখানে ধনী-দরিদ্রের বিভেদ থাকবে না। মার্ক্স তাঁদের ‘ইউটোপিয়ান সোশ্যালিস্ট’ বলে তীব্র সমালোচনা করেছেন। মার্ক্স এবং এঙ্গেলস বার বার স্পষ্ট করেই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন কেন তাঁদের সমাজতন্ত্রের ধারণাটি ‘বৈজ্ঞানিক’, ইউটোপিয়ান নয়। মনে রাখতে হবে, ইউটোপিয়ান ভাবুকদের জনপ্রিয়তা সে সময়ে কিছু কম ছিল না। কিন্তু এখনকার যে রামরাজ্যের কল্পনা, একে ইউটোপিয়া না বলে ‘রেট্রোপিয়া’ বলাটাই যথাযথ হবে, কারণ তা অতীতচারী। সমাজবিজ্ঞানী জ়িগমান্ট বাউমান সম্প্রতি এই নামে একখানি গোটা বই লিখে ফেলেছেন। বাউমান দেখাচ্ছেন, কী ভাবে চাকরি ও রোজগার ঘিরে অনিশ্চয়তা, অসাম্যের বাড়বাড়ন্ত ইত্যাদি এক ধরনের কল্পিত অতীতকে ‘ফিরিয়ে’ আনার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করছে কৌম চেতনায়, যা মানুষজনকে বিশ্বজনীনতার বিপরীতে এক সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক অবস্থানে এনে ফেলছে।

নস্টালজিয়া শব্দটির উৎস কিন্তু সাহিত্য বা দর্শন নয়। এর উৎপত্তি অতীতের চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে। দেশান্তরে যুদ্ধে যাওয়া সুইস সৈন্যদের ঘরে ফেরার আকুতি দেখে সপ্তদশ শতকে এক সুইস চিকিৎসক নস্টালজিয়া শব্দটি তৈরি করেন গ্রিক ‘নস্তস’ থেকে— অর্থ, ঘরে ফেরা। ঘরে ফেরার আকুতি থেকে যে অবসাদ, তাকেই নাম দেওয়া হল নস্টালজিয়া, যাকে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা হিসেবেই দেখেছিলেন সেই ডাক্তারবাবু। এই ঘরে ফেরার আকুতি থেকে অনুষঙ্গ হিসেবে এসে পড়ে অতীতকে আদর্শস্বরূপ ভেবে বর্তমান বাস্তবকে কদর্য মনে করা। এর তীব্রতা এমনই হতে পারে যে মানসিক অসুস্থতার পরিচিত শারীরিক লক্ষণগুলি, যেমন, বমিভাব বা খিদে কমে যাওয়া, অলীক কণ্ঠস্বর শোনা— দেখা দিতে পারে। কিন্তু পরবর্তী কালে নস্টালজিয়া অর্থে অতীতচারী মনোভাবকেই বুঝে থাকি।

নস্টালজিয়ায় ডুব দেওয়া নতুন ব্যাপার নয়, অস্বাভাবিকও নয়। সর্বদাই কিছু মানুষ থাকবেন, যাঁরা বলবেন ব্রিটিশ রাজত্ব কিংবা নেহরু আমল ভাল ছিল। এই নস্টালজিয়াকে ব্যক্তিবিশেষের মনপোড়ানি হিসেবে দেখা যায়। কিন্তু বর্তমানে নস্টালজিয়াকে যে রকম পরিকল্পিত ভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে এক ধরনের উৎকট স্বাদেশিকতাকে উস্কে দেওয়ার জন্যে, তা বিপজ্জনক।

‘ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’ তখন আর নির্ভেজাল স্বপ্নের বিষয় থাকে না। এই ‘আবার’ শব্দটির মধ্যেই ইঙ্গিত রয়েছে এক কল্পিত অতীত গৌরবের, যখন ভারত শ্রেষ্ঠের আসনে ছিল। সেই শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্য পড়়শিকে সবক শেখানোর পেশি আস্ফালনের শ্রেষ্ঠত্ব নয়, তাতে সব ধর্মের মানুষের এক হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আহ্বান ছিল। নাগপুরের জাতীয়তাবাদ সেই কথাটা ভুলিয়ে দিতে চাইবে। কিন্তু, তার চেয়ে আরও বড় প্রশ্ন হল, অতীতের সেই শ্রেষ্ঠত্বের ছবিটা যেমন, তা নিয়ে আপত্তির ঢের কারণ থাকতে অতুলপ্রসাদ মনে করিয়ে দিয়েছেন, আমরা মৈত্রেয়ী, খনা, সতী, সাবিত্রী, সীতার সন্ততি। এই নারীরা কেন মহান, সেই কারণও কবি জানিয়েছেন— এঁরা ‘পতিপুত্র তরে সুখে’ প্রাণ ত্যাগ করেছেন। প্রাচীন যুগের কতিপয় স্বনামধন্যা নারীতে পিতৃতন্ত্র নির্মিত বিশেষ গুণাবলি আরোপ করে ‘মহতী’ করে তোলার যে পরম্পরা, অতুলপ্রসাদ তাতেই জলসিঞ্চন করেছেন।

অতীতের কোনও কালেই যে সমাজে নারীর অবস্থা গর্ব করে বলার মতো ছিল না, সেটা জানার জন্য সুকুমারী ভট্টাচার্যের লেখাপত্র খানিক ঘাঁটলেই চলবে। তাঁর ‘বৈদিক সমাজে নারীর স্থান’ প্রবন্ধের শেষ বাক্যগুলি বিশেষ ভাবে প্রণিধানযোগ্য। ‘‘শুধু আমাদের এখানেই জোর করে বলবার চেষ্টা হয়, বৈদিক যুগে নারী নাকি স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। এতে শুধু সত্যের অপলাপ হয় তা নয়, অতীতকে যথার্থ ভাবে না দেখতে পাওয়ার জন্যে অতীতের যে বিষ বর্তমান সমাজদেহে সঞ্চারিত, তাকে চিনতে, তার প্রতিষেধ তৈরি করতে এবং সুস্থ এক ভবিষ্যতের প্রস্তুতি বিধান করতে অনাবশ্যক দেরি হয়ে যায়।’’ শ্রেষ্ঠ ভারতের রূপকল্পে নারী বা দলিত বা সংখ্যালঘুর অবস্থান ঠিক কী হবে, তার নিষ্পত্তি করার দায় অতীতবিলাসী জাতীয়তাবাদের নেই।

অতীতে আমরাই সেরা ছিলাম, এই কথাটাকে জনমানসে প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারলে বর্তমানের খামতিগুলোকে ঢেকে রাখা যায়, তেমনই সেই অতীতের দোহাই দিয়ে চালিয়ে যাওয়া যায় হরেক অন্যায়। নস্টালজিয়া বস্তুটা ব্যক্তিপরিসর ছাপিয়ে রাজনীতির পরিসরে ঢুকে পড়লেই তাই ঘোর বিপজ্জনক হয়ে উঠতে থাকে।

ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা-র অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত

Nostalgia Nationalism Extremist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy