Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

বাংলাভাষা নয়, মাতৃভাষা দিবস

ভাষাশুমারির গোড়ায় মাতৃভাষার যে সংজ্ঞাটা লেখা থাকে, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘‘ছোটবেলায় কোনও ব্যক্তির প্রতি তাঁর মা যে ভাষায় কথা বলেন, তা-ই হল মাতৃভাষা। ব্যক্তির জন্মের সময় মায়ের মৃত্যু ঘটলে, ছোটবেলায় ব্যক্তির বাড়িতে যে ভাষা বলা হত, তা হবে মাতৃভাষা।’’ গৃহস্থালি তফসিলের (হাউসহোল্ড শেডিউল) ১০ নম্বর প্রশ্ন অনুসারে ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া উত্তর অনুযায়ী তৈরি হয় ভাষাশুমারি।

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০২
Share: Save:

ভাষাশুমারির গোড়ায় মাতৃভাষার যে সংজ্ঞাটা লেখা থাকে, তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘‘ছোটবেলায় কোনও ব্যক্তির প্রতি তাঁর মা যে ভাষায় কথা বলেন, তা-ই হল মাতৃভাষা। ব্যক্তির জন্মের সময় মায়ের মৃত্যু ঘটলে, ছোটবেলায় ব্যক্তির বাড়িতে যে ভাষা বলা হত, তা হবে মাতৃভাষা।’’ গৃহস্থালি তফসিলের (হাউসহোল্ড শেডিউল) ১০ নম্বর প্রশ্ন অনুসারে ব্যক্তির কাছ থেকে পাওয়া উত্তর অনুযায়ী তৈরি হয় ভাষাশুমারি।

সেই অর্থে ধরতে গেলে মালদহের কেদারনাথ মণ্ডলের মাতৃভাষা বাংলা নয়। চাঁই। ছোটবেলায় সে ভাষাতেই তিনি বড় হয়েছেন। আজও নিজের সম্প্রদায়ের মধ্যে সে ভাষাতেই কথা বলেন। কিন্তু ‘দেশের সামগ্রিক জনসংখ্যা’কে যথাযথ তুলে ধরার প্রতিজ্ঞা করেও তা রাখতে পারেনি জনগণনা। বাংলার ছাতার নীচে এসেছে হাতে গোনা কিছু উপভাষা, রাজবংশী, হাইজোং, চাকমা ও অন্যান্য! পুরনো হিসেব বলছে, ‘অন্যান্য’তে থাকতে পারে বাহে, বারিক, ভাটিয়ারি, দেহারি— যদিও এ সব কোনও হিসেবই বাস্তবের ধারেকাছে নয়। ২০১১-র শেষতম হিসেবেও কেদারবাবুর মাতৃভাষা বাংলা। তিনি বলছিলেন, ‘‘এক বার এক জায়গায় ফর্ম ফিল আপ করতে গিয়ে সাব-কাস্টের খোপে লিখেছিলাম সি-এইচ-এ-আই-এন। যিনি ফর্ম জমা নিচ্ছিলেন, আঁতকে উঠেছিলেন।’’ জনতার অজ্ঞানতায় কিঞ্চিৎ রাষ্ট্রীয় অনুপ্রেরণা নেই, এমন কি কেউ বুক ঠুকে বলতে পারবেন?

কেদারবাবুর সঙ্গে মালদহের আরও কিছু গ্রামে ঘুরে জানা যায়, বিন্দ বা রবিদাসদেরও অবস্থাও চাঁইদের মতোই। তাদেরও সম্প্রদায়ের নামে ভাষা। বয়স্করা এখনও সেই ভাষা বলতে পারেন, বলতে চান। কিন্তু নবীন প্রজন্ম তাদের আসল মাতৃভাষাটা জানেই না। তাদের মাতৃভাষা স্পষ্টতই বাংলা। প্রবীণদের আক্ষেপ, যারা শিক্ষিত হয়ে উঠছে, অর্থাৎ স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া শিখছে, তারাই খাঁটি বাঙালি হয়ে যাচ্ছে। সে দিক থেকে, শিক্ষার আলো তত না পৌঁছলেও অন্তত আর কিছু দিন বাঁচত চাঁই বা ওধিয়া ভাষা। যদিও, ভাষাশুমারিতে লেখানোর সুযোগ না থাকায়, সব মিলিয়ে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

আমার ভাষা: ভাষা দিবসে খেলুন কুইজ আর জিতুন পুরস্কার

পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় এমন কম শক্তিশালী ভাষা ছড়িয়ে আছে বা ছিল। ছিল বলছি, কারণ কিছু ভাষা বাংলার বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে মরে গিয়েছে, অর্থাৎ অধুনা বিলুপ্ত। সেগুলো কী? সংখ্যায় কত? উত্তর নেই। পশ্চিমবঙ্গের কথ্য ভাষা সংক্রান্ত চর্চায় জেলা ধরে ধরে কত রকমের ভাষা বৈচিত্র উপস্থিত, তার কিছু খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হয়। যেমন, সুন্দরবনের জনজাতির মানুষদের মধ্যে ‘সাদ্‌রি’ নামে একটি ভাষা চলে। বহু কাল আগে ছোটনাগপুর থেকে এই অঞ্চলে চলে এসেছিল সাঁওতাল, মুন্ডা, ওরাওঁ, ভূমিজরা। তাদের নিজেদের মধ্যে বলার জন্য একটা সাধারণ ভাষার নাম সাদ্‌রি। আবার, কোচবিহার জেলায় থাকেন রাজবংশী ভাষাভাষীরা। ১৯৯১ জনগণনায় উত্তরবঙ্গে তাঁদের সংখ্যা প্রায় ২২ লক্ষ। তবে রাজ্যের সমগ্র ছবিটা অজানা। রাজ্যে সরকারি ভাষা বাংলা হওয়ার ফলে ছোট ভাষাগুলোর স্বীকৃতি নেই। ক্ষমতা কেবল ক্ষমতাবানেরই।

এখানে কী কর্তব্য, জানা নেই। কারণ আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোই এমন, যেখানে সংখ্যালঘু ভাষাকে খুব বেশি তুলে ধরার সুযোগ নেই। ধরা যাক, আজ প্রবল গণতন্ত্রকামী কোনও শাসক বললেন, আলিপুরদুয়ারের জনজাতি টোটো-রা টোটো ভাষাতেই পড়াশোনা করবে। সম্ভব? মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ, কত দূর? তা হলে প্রতিটি ভাষায় সমমানের প্রাইমার থেকে বিষয়ভিত্তিক বই লিখতে হবে, শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। ‘ভাষা জিজ্ঞাসা’ বইয়ে শিশিরকুমার দাস লিখেছিলেন, ‘‘কথাটা দাঁড়াচ্ছে এই যে পৃথিবীতে মানুষকে প্রধান আর অপ্রধান ভাষার একটা পার্থক্য স্বীকার করে নিতে হবে। যে গোষ্ঠী একটি অপ্রধান ভাষায় কথা বলেন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণেই সাধারণত তাদের একটি প্রধান ভাষা লিখতে হয়।’’

তবে, কর্তব্য নেই বলে দায়িত্বও নেই, এমন নয়। সংখ্যাগুরুর দায় আছে। যারা বাঙালি নয়, তাদের ঘাড় ধরে বাঙালি বানানোর চেষ্টা করব না, বা বাঙালি বলে চিহ্নিত করব না— এটুকু করাই যায়। কিংবা যদি দেখা যায় কোনও কুরুখভাষী ছেলে বাংলায় লেখাপড়া করার পর মাতৃভাষা সম্পর্কে সচেতন হয়ে কুরুখের প্রাইমার লিখছে বা গীতা অনুবাদ করছে, তাকে সে কাজে উৎসাহ দেওয়া যায়। ভাষা সংরক্ষণের কাজে যেটুকু সাহায্য করা যায়, সেটা করা যায়। অন্তত নুনিয়া জনজাতির কাউকে যেন আর ‘‘মাতৃভাষা কী’’ প্রশ্নের উত্তরে বলতে না হয়— ‘‘পশ্চিমবঙ্গে থাকি, বাংলাই হবে।’’

না হলে আর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে কিসের গর্ব? মাতৃভাষা বাংলা এক সময় হুমকির মুখে লড়াই করে দাবি আদায় করেছিল বলে এই সর্বজনীন স্বীকৃতি। সেই বাংলা যদি কেবল নিজেকে নিয়েই মেতে ওঠে, অন্যকে চুপচাপ মুছে দেয়, তবে এত বড় সংগ্রাম নিষ্ফল হয়ে যায়। কোন মুখেই বা তবে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ বা ‘বেংলিশ’-এর বিরুদ্ধে লড়া যায়?

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE