Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

তেত্রিশ বৎসর কাটিল

লজ্জাবোধ অন্য কারণেও জরুরি। এই অন্যায় প্রথা রদ হইবার প্রহরেও আইনসভায় বিরোধীরা যে তীব্র প্রতিবাদের নমুনা দেখাইলেন, তাহা নিরপেক্ষ নাগরিকের মাথা হেঁট করাইয়া দেয়।

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৯ ০০:১৩
Share: Save:

লোকসভার চলতি অধিবেশনটি বিল পাশের ক্ষেত্রে স্মরণীয় হইয়া থাকিবে। তন্মধ্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলিতে হইবে মুসলিম নারী (বিবাহ-সংক্রান্ত অধিকার রক্ষা) বিলটিকে। বহু যুগ ধরিয়া মুসলিম সমাজে চালু একটি অতীব অন্যায় প্রথা তিন তালাককে বেআইনি ঘোষণা করিয়া এই বিল ভারতীয় মুসলিম নারীকে এক বহু-প্রতীক্ষিত অধিকার ও মর্যাদা অর্পণ করিল। তিন তালাক প্রথা ছিল নারীর চূড়ান্ত অবমাননা। বহু মুসলিম দেশে ইতিমধ্যেই ইহা আইনত নিষিদ্ধ, এমনকি পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও। বিলম্বে হইলেও ভারতে তাহা এত দিনে নিষিদ্ধ হইল। ভারতীয় আইনসভা এই মুহূর্তে গর্বিত হইতে পারে। উনিশশো আশির দশকে অতিপরিচিত শাহবানো মামলায় পরিত্যক্ত স্ত্রী শাহবানোর পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর ১৯৮৬ সালের যে আইনে সর্বোচ্চ আদালতের রায়টিকে উল্টাইয়া দেওয়া হইয়াছিল, তাহা এতদ্দ্বারা বরবাদ হইল। ভারতের মাটিতে বিবাহিত নারীর যে অধিকার-সুরক্ষা পাইবার কথা, তাহা হইতে মুসলিম নারীকে বঞ্চিত করা হইয়াছিল ’৮৬-র আইনটিতে। তেত্রিশ বৎসর লাগিল অন্যায়ের পরিবর্তন সাধনে। গৌরবের সহিত ভারতীয় সমাজের কিছু লজ্জাবোধও হইতেছে কি?

লজ্জাবোধ অন্য কারণেও জরুরি। এই অন্যায় প্রথা রদ হইবার প্রহরেও আইনসভায় বিরোধীরা যে তীব্র প্রতিবাদের নমুনা দেখাইলেন, তাহা নিরপেক্ষ নাগরিকের মাথা হেঁট করাইয়া দেয়। বিরোধীদের বক্তব্য— হঠাৎ কেন মুসলিম নারীদের প্রতি আইনের এই করুণাবর্ষণ? কই, স্বামী-পরিত্যক্ত হিন্দু নারীর বিষয়ে পদক্ষেপ করা হইতেছে না তো? স্বভাবতই ইঙ্গিতটি বিজেপির মুসলিম-বিরোধী রাজনীতির দিকে। বিরোধীরা ভুলিয়া যাইতেছেন যে, তিন তালাক যে ভাবে মুসলিম নারীকে আইনের সামনে অধিকারহীন করিয়া আসিয়াছে, স্বামী-পরিত্যক্ত হিন্দু নারীর কিন্তু সেই আইনি অধিকারহীনতা ছিল না। অর্থাৎ তিন তালাকের ক্ষেত্রটি সম্পূর্ণ পৃথক ভাবে বিবেচ্য, সেখানে অমুসলিম সমাজের লিঙ্গবৈষম্যের উদাহরণ টানিয়া আনা— শুধু অযৌক্তিক নহে, অনুচিত। আর একটি প্রশ্নও উঠিবে। কোনও নির্যাতিত গোষ্ঠীর প্রতি সুবিচারের অর্থ কি অন্যান্য নির্যাতিত গোষ্ঠীর অবহেলা? এ হেন যুক্তিতে তো কোনও সংস্কারকার্য কোনও কালেই সম্ভব নয়! বাস্তবিক, যে দলের প্রধানমন্ত্রী শাহবানো সংক্রান্ত অতীব অবমাননাকর আইনটির হোতা ছিলেন, সেই কংগ্রেসের এ বিষয়ে বক্তব্যপ্রকাশের ‘মুখ’ই থাকিতে পারে না। মুসলিম সমাজের সর্বাপেক্ষা রক্ষণশীল অংশটির সামনে নিজেদের দুর্বলতা দেখাইয়া অহেতুক মুসলিম-তোষণের অভিযোগ তাঁহারা অর্জন করিয়াছিলেন। এবং নিজেদের তথা দেশের জন্য সমূহ ভবিষ্যৎ বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছিলেন। আজ যে সংখ্যাগুরুবাদ এত প্রবল, তাহার পিছনে রাজীব গাঁধী সরকারের ওই একটি অক্ষমণীয় সংস্কারের ভূমিকা অসামান্য।

বিজেপি ও তাহার প্রধানমন্ত্রী যে বিষয়টি লইয়া রাজনীতি করিতেছেন, তাহাও অনস্বীকার্য। মুসলিম সমাজ কতটা পশ্চাৎপদ, কংগ্রেস কতটা সংখ্যালঘু-তোষণকারী, তাঁহারা কত ‘সুবিচার’পন্থী ইত্যাদি দর্শাইবার জন্য তাঁহারা অতিশয় ব্যগ্র। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে সন্ত্রাসবাদের সহিত তিন তালাককে অপরাধের এক স্তরে বসাইয়াছেন! মুশকিল হইল, ভারতীয় রাজনীতি সর্বদা অতিরেকেই চলিয়া থাকে। অতিরেকের দাপটে যদি প্রগতি ও মুক্তির অধিকার-রাজনীতিকে নিজের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়, তবে গভীর বিপদ। ভারতীয় লিবারালরা এই বিপদে ইতিমধ্যেই জর্জরিত, আবারও যদি তাঁহারা সেই একই ভুল করেন এবং নারীর অধিকার রক্ষণশীল সরকারের হাত ধরিয়া আসিতেছে বলিয়াই তাহাকে ‘অধিকার’ বলিয়া চিনিতে না পারেন— বিপদ তবে গভীরতর হইয়া তাঁহাদের অচিরে নিমজ্জিত করিবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Triple Talaq Parliament Opposition
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE