অপারেশন সিঁদুর-এর সাফল্য নিয়ে প্রত্যেক ভারতবাসীই গর্বিত। সে গর্ব স্বাভাবিক। ভারতের মাটিতে যারা সন্ত্রাসবাদী হামলা চালায়, এবং সেই জঘন্য অপরাধীদের যারা মদত দেয়, তাদের সমুচিত জবাব দেওয়া জাতীয় কর্তব্য ছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী নিশ্চিত ভাবেই অপারেশন সিঁদুর-এর সাফল্যের অংশীদার। কিন্তু, কয়েকটি কথা তাঁকেও স্মরণে রাখতে হবে। প্রথমত, এমন একটি সামরিক অভিযান, তা যতই সফল হোক না কেন— গর্বের বিষয় হতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক প্রচারের বস্তু হতে পারে না। গত কয়েক দিনে প্রধানমন্ত্রী যতগুলি জনসভা করেছেন, তার প্রতিটিতেই বিশেষ ভাবে গুরুত্ব পেয়েছে অপারেশন সিঁদুরের প্রসঙ্গ। সেনাবাহিনীর শৌর্যের প্রশংসার ছলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন তাঁর নিজের কথা— বলেছেন, আতঙ্কবাদীরা ভাবতেও পারেনি যে, মোদীর মোকাবিলা করা কতখানি কঠিন; হুঙ্কার দিয়েছেন যে, রুটি খাও, নয়তো আমার গুলি তো আছেই; বলেছেন, তাঁর শিরা-ধমনীতে রক্ত নয়, গরম সিঁদুর বইছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এই সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু, অভিযানের প্রশস্তির সিংহভাগ জুড়ে যদি উত্তমপুরুষ একবচন থাকে, তা হলে সংশয় হয়, অভিযানের কৃতিত্বটি তিনি একাই আত্মসাৎ করতে চান। এই সংশয় দুর্ভাগ্যের— কারণ, এ সাফল্য কোনও ব্যক্তিবিশেষের নয়, কোনও দলের নয়, এই সাফল্য দেশের। গোটা বিরোধীপক্ষ যখন রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে এই মুহূর্তে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন প্রধানমন্ত্রীরও কর্তব্য ছিল ক্ষুদ্রতার অমোঘ আকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে প্রকৃত দেশনেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।
আলিপুরদুয়ারে তাঁর বক্তৃতার পরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়ার ভঙ্গিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে— বিশেষত, ব্যক্তি-আক্রমণকে রাজনীতির অস্ত্র করে তুললে তাতে আপত্তি জানানোই বিধেয়। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্নগুলি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সামরিক অভিযানের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের একটি প্রকট প্রতীকের ব্যবহার কেন থাকবে, সে প্রশ্নটির কোনও সদুত্তর থাকা মুশকিল। দুর্জনে বলতে পারে, রাজনৈতিক বিপণনে কার্যত অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানমন্ত্রী নামকরণের মুহূর্ত থেকেই তার পরবর্তী রাজনৈতিক ব্যবহার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। অন্য দিকে, যে প্রশ্নে বিরোধী দলগুলি প্রধানমন্ত্রীকে নিঃশর্ত সমর্থন জানিয়েছে, তাকেই রাজনৈতিক জনসভার মূল আলোচ্য বানিয়ে তোলার মধ্যে একটি বিশ্বাসভঙ্গও রয়েছে— যাকে সব ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে জাতীয় প্রশ্ন হিসাবে দেখা হচ্ছে, তাকেই রাজনীতির অস্ত্র করে তুললে ভবিষ্যতে বিরোধীরা কি সরকারকে একই ভাবে বিশ্বাস করতে পারবেন? কোন মূল্যে জাতীয় ঐক্যের সেই ক্ষতি করা হচ্ছে, দেশের নেতা হিসাবে প্রধানমন্ত্রীরই সে কথা ভাবা উচিত ছিল না কি?
আরও একটি কথা স্মরণে রাখা জরুরি। অপারেশন সিঁদুরে সেনাবাহিনীর পরাক্রম যতই প্রশংসাযোগ্য হোক না কেন, তা গৌরবের বিষয় হতে পারে, কিন্তু উল্লাসের নয়। পাক-মদতপুষ্ট জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এই অভিযানের ভাষ্যটিকে কত সহজে দেশের সংখ্যালঘু মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে, ভারত তা অভিজ্ঞতায় জানে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অতঃপর এই অভিযানকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেশবাসীর। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান আপাতত বিদেশি (অর্থাৎ, চিনা) পণ্য ব্যবহার কমানোয় সীমাবদ্ধ— কিন্তু, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাতে পড়লে আহ্বানটির ব্যাপ্তি বাড়া বা অভিমুখ পরিবর্তন ঘটা কিছুমাত্র আশ্চর্যের নয়। প্রসঙ্গটিকে অতীতে রেখে অগ্রসর হওয়াই ভারতের কর্তব্য। এবং, সেই অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর। কোনও দলের বা কোনও বিশেষ ধর্মের নেতা হিসাবে নয়, গোটা দেশের নেতা হিসাবে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)