E-Paper

প্রতীকী

তদন্ত ও বিচারের গতিপ্রকৃতি যখন এমন, সেই সময়ে রাজ্যের রাজনীতি পরিসরে বন্ধ্যাত্ব, নীতিহীনতা ও চূড়ান্ত অবিবেচনাকেও পশ্চিমবঙ্গের বর্তমানের সূচক ও দ্যোতক হিসাবে দেখা সম্ভব।

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৫ ০৮:৩৩

কোন ঘটনা কখন কী ভাবে প্রতীকী হয়ে ওঠে, বলা যায় না। আর জি করের অভয়া-কাণ্ড আক্ষরিক ভাবেই বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির বাস্তবের প্রতীক। লক্ষণীয়, এক বছর ঘোরার পরও আর জি কর কাণ্ডকে কেন্দ্র করে নতুন করে ‘অনভিপ্রেত ও দুঃখজনক’ ঘটনা ঘটল, স্বয়ং পুলিশ কমিশনার জানিয়ে দিলেন নির্যাতিতার মা-কে গত শনিবারের মিছিলে ‘যদি’ পুলিশ মেরে থাকে, তা দুর্ভাগ্যজনক। বলা বাহুল্য, ‘যদি’ শব্দটি আলঙ্কারিক মাত্র। যে প্রশাসন সামান্য অজুহাতে যে কোনও দায় ও দায়িত্ব ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে সিদ্ধহস্ত, তার পক্ষ থেকে ‘যদি’-র উল্লেখমাত্রই আসলে স্বীকৃতি। তবে এহ বাহ্য। এই ঘটনার এক বছর কাটলেও এখনও কোনও সঙ্গত বিচার হয়নি, কেননা যেটুকু হয়েছে, তাতে উত্তরের থেকে প্রশ্ন বেশি তৈরি হয়েছে। তখন যে সব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল— তড়িঘড়ি একটি মর্মান্তিক হত্যাকে আত্মঘাত বলে দেওয়া, পুলিশ আসার আগেই হাসপাতালের নির্দেশে দ্রুত দেহ মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া, পুলিশের পক্ষ থেকে দ্রুত সৎকারের ব্যবস্থা করে ফেলা, ফরেনসিক তথ্যসংগ্রহে ব্যাপক অবহেলা, তদন্তে বাধা দান ও তথ্যপ্রমাণ লোপ, অপরাধের অকুস্থলে আকস্মিক সংস্কার শুরু, সিবিআই প্রথমেই ‘উদ্বেগজনক ও বিচলিত’ তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও পরে কোনও কিছু অভয়ার পরিবার বা সমাজের গোচরে না আনা, সিবিআইয়ের সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট এখনও পেশ না করা— বহু ঘটনা এখনও এক বছর আগের মতোই বিশালাকার উল্লম্ব প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যতেও কোনও উত্তর মিলবে না, সুবিচারও নয়। এই স্তব্ধবিচার অনাচারই আজ পশ্চিমবঙ্গের বাস্তব। ‘অভয়া’ ঘটনা তার প্রতীক।

তদন্ত ও বিচারের গতিপ্রকৃতি যখন এমন, সেই সময়ে রাজ্যের রাজনীতি পরিসরে বন্ধ্যাত্ব, নীতিহীনতা ও চূড়ান্ত অবিবেচনাকেও পশ্চিমবঙ্গের বর্তমানের সূচক ও দ্যোতক হিসাবে দেখা সম্ভব। তৃণমূলের ভূমিকা— আদ্যন্ত রাজনৈতিক, প্রশাসনিক নয়। প্রতি পদক্ষেপই করা হয়েছে দলীয় যন্ত্রের প্রয়োজনে, অভয়া-হত্যার রহস্য নিরসনে নয়। শাসকঘনিষ্ঠ অর্থপুষ্ট সমাজবলয়, সিভিক পুলিশ, সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে দলদাস ক্ষমতাবানদের দুরাচার ও অনাচার এই রাজ্যকে আজ সর্বনাশের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এমন সঙ্কটমুহূর্তে, বিরোধী রাজনীতিও লক্ষ্যভ্রষ্ট। নতুবা আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ডাক্তারদের নিজস্ব দাবিদাওয়াকেই পাশার দান করে ফেলার মতো নির্বোধ আত্মঘাত ঘটত না, এবং তার সুযোগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীও মূল বিষয়টিকে গৌণ করে ফেলার অবকাশ পেতেন না। আজ যে আন্দোলন-বিক্ষোভ তার মূল জোরটিই হারিয়ে ফেলেছে, তার আংশিক দায় গত বছরের অনশন আন্দোলনবাদীদের উপর বর্তায় বইকি। এবং আজ যে অভয়া আন্দোলনের মূল কান্ডারি হয়ে দাঁড়িয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী প্রমুখ বিজেপি নেতাগণ, যাঁদের দলশাসিত রাজ্যগুলিতে নারীনির্যাতন ও ধর্ষণের অপরাধীরা শাসকের আশ্রয়-প্রশ্রয় ইতিমধ্যেই কিংবদন্তিসম— তার দায়ও গত বছরের আন্দোলনের পথনির্ধারকদেরই নিতে হবে, যাঁদের মধ্যে সিনিয়র-জুনিয়র ডাক্তারদের ভূমিকা বহুজ্ঞাত।

এক বছর পর ফিরে তাকিয়ে পশ্চিমবঙ্গের জীবনখাতার হিসাবনিকাশে সুতরাং একটিই প্রাপ্তি উজ্জ্বল— নাগরিক আন্দোলনের পুনর্জীবন লাভ। ২০২৪ সালের ১৪ অগস্ট-এর রাত জাগো কার্যক্রম থেকে যে জন-আন্দোলন ঐতিহাসিক আকার ধারণ করেছিল, তা অবশ্যই শাসকের ত্রাস তৈরির পক্ষে যথেষ্ট। নাগরিকের লাগাতার শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধ ও অবরোধের মাধ্যমে শাসকের ত্রাস ধরিয়ে দেওয়া সহজ কথা নয়। বিভিন্ন প্রকার বন্ধ্যাত্ব ও বৈকল্য সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তা পেরেছিলেন। অভয়া জেনে গেলেন না, তাঁর কারণেই একটি দীপ জ্বলে উঠেছিল। অন্ধকার হতাশ্বাস সমাজে সে দীপালোকের মূল্য অপরিসীম।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

R G Kar Medical College And Hospital Incident Crime Against Women

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy