E-Paper

নিষিদ্ধ

সরকার তথা রাষ্ট্র এই বই নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে আসলে যে পথে হাঁটছে, তার হাঁটার ভঙ্গি যে রকম— তা নিয়ে কথা বলা বরং বেশি জরুরি।

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৭
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

জম্মু ও কাশ্মীরের উপরাজ্যপালের ঘোষণায় ২৫টি বই সম্প্রতি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে বরং বইগুলি নিয়ে কৌতূহল বেড়ে গিয়েছে কাশ্মীরের সাধারণ পাঠকসমাজে, যাদের একটা বড় অংশই এই প্রজন্মের। এ আদৌ বিস্ময়ের নয়। সরকারি ফরমানে বাজার থেকে ‘নিষিদ্ধ’-ছাপ বই তুলে নেওয়া আর তার সমস্ত ছাপা কপি বাজেয়াপ্ত করার কথা ঘোষণা হলে, এমনকি তা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পালিত হলেও সেই বই মুছে যায় না— কোনও দেশে কোনও উপায়েই তা মোছা যায়নি, এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়ঙ্করতম সময়েও নয়। আর একুশ শতকের এই প্রযুক্তি-শাসিত, প্রযুক্তি-চালিত যুগে তো বই নিষিদ্ধ করার ভাবনাটিই হাস্যকর। সে দিক দিয়ে অরুন্ধতী রায়, ভিক্টোরিয়া স্কোফিল্ড, সুমন্ত্র বসু, অনুরাধা ভাসিন, এ জি নুরানি প্রমুখ লেখক নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন— এ ক্ষেত্রে দ্বার বন্ধ করে রাষ্ট্র ‘ভ্রম’ রুখতে চাইলেও ‘সত্য’ ঠিকই সমাজমনে প্রবেশের পথ করে নেবে।

সরকার তথা রাষ্ট্র এই বই নিষিদ্ধের মধ্য দিয়ে আসলে যে পথে হাঁটছে, তার হাঁটার ভঙ্গি যে রকম— তা নিয়ে কথা বলা বরং বেশি জরুরি। সরকারের বক্তব্য, নিষিদ্ধ বইগুলি নাকি কাশ্মীরে ভ্রান্ত ভাষ্য ও বিচ্ছিন্নতাবাদ ছড়াচ্ছে, ইতিহাস-রাজনীতি বিশ্লেষণের ছলে কাশ্মীরের তরুণদের বিপথে চালনা করছে, তাদের মধ্যে অভিযোগ-অনুযোগ ও ‘ভিক্টিমহুড’-এর ‘সংস্কৃতি’ ছড়াচ্ছে, ফলে বাড়ছে ভারতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও হিংসা। বই কী করতে পারে তার পরিচয় ভারতে নানা জমানায় নানা শাসকই পেয়েছেন; এখনকার ভারত-শাসকেরাও বিলক্ষণ জানেন যে, ২০১৯-এর ৫ অগস্ট ৩৭০ ধারা রদ করে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা মুছে দেওয়ার পর এই ছয় বছরে সেখানে গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা-সহ সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার ও মূল্যবোধগুলি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, নিষিদ্ধ বইগুলির কোনও কোনওটি সেই নগ্ন সত্যই তুলে ধরেছে। কোনও বই বুঝিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রের হাতেই কাশ্মীরের মানুষের বঞ্চনা ও নিপীড়নের ইতিহাস, প্রবল সামরিক উপস্থিতি দিয়ে যা ঢাকাচাপা দেওয়ার বন্দোবস্ত হয়ে আসছে অদ্যাবধি। কোনও বই হাট করে দিয়েছে বর্তমান সরকারের কাশ্মীর নীতির নানা দুর্বলতা। প্রকৃত তথ্য ও সত্য যে বই তুলে ধরে, তার উপরে নিষেধের খাঁড়া তো নামবেই।

কেন্দ্র যতই এই সময়ের কাশ্মীরকে স্বাভাবিকতার স্বর্গ বলে তুলে ধরুক, আসল পরিস্থিতি যে তার ধারেকাছেও নয় তা সাম্প্রতিক কালে তুলে ধরেছিল কাশ্মীরের সংবাদমাধ্যম। তার জেরে নানা সংবাদপত্র ও অন্য প্রচারমাধ্যমের উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে, বহু সাংবাদিক নিগৃহীত হয়েছেন। হুমকি, হেনস্থা, ভয় দেখানোর এই যে আবহ, কাশ্মীরে তা তৈরি করেছে খোদ রাষ্ট্র— তার সব দুর্বলতা ও অক্ষমতা যাতে বেরিয়ে না পড়ে তার মরিয়া চেষ্টায়। বই নিষিদ্ধ করার কাজটিকে এরই প্রসারিত কৌশল হিসাবে দেখতে হবে; সংবাদ ও বই এই দুইয়ের ‘বিরুদ্ধ’স্বরের কণ্ঠরোধে সাফল্য এলে নাগরিকের উপরে রাষ্ট্রযন্ত্রের আধিপত্যবাদ পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পায়। এপ্রিলের পহেলগাম এখনও দগদগে ক্ষত, তার ‘বদলা’ নিতে রাষ্ট্র হাবেভাবে যত গর্জেছে কাজ ততটা বর্ষায়নি, এই আবহে সত্যসন্ধানী বইয়ের মতো বিষফোড়া আর কী। ভয় পেয়েছে, তাই এত ভয় দেখানো।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Kashmir

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy